করোনা মহামারি শেষ না হলেও বাংলাদেশে শেষ হলো করোনার একটা অধ্যায়। করোনা শুরুর মাসখানেকের মাথায় পৃথিবীতে যখন করোনা ভ্যাকসিনের রোলআউট শুরু হলো, তখন একেবারে শুরুর দিকেই সেই তালিকায় নাম লিখিয়েছিল বাংলাদেশ।

পৃথিবীর অল্প কয়েকটি দেশের মানুষের মধ্যে সৌভাগ্যবান ছিলাম আমরা, বিশেষ করে আমার মতো বাংলাদেশের ফ্রন্টলাইনাররা, যারা ডেল্টার জন্মের ঢের আগেই করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে আগেভাগেই প্রস্তুত ছিলাম কোমর বেঁধে মোকাবিলা করার জন্য।

এদেশে করোনা ভ্যাকসিনেশনের গল্পটা চড়াই আর উতরাইয়ে মেলানো। শুরুতে করোনার ভ্যাকসিনে ‘বুড়িগঙ্গার পানি’ থেকে ‘মুরগির ভ্যাকসিন’ বলে মানুষকে ভড়কে দেওয়ার কম চেষ্টা চালায়নি একদল অন্ধকার আশ্রিত মানুষ। সেই প্রচারণা সবাই দেখেছেন। তারপর ডেল্টার ঢেউয়ের তোড়ে তো রীতিমতো ভ্যাকসিন সংকটেই পড়েছিল বাংলাদেশ।

করোনা আছে ঠিকই, কিন্তু তার আগের সেই তেজটা আর নেই। আর এর মাঝেই ব্যর্থ বিশেষ ক্যাম্পেইনের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হলো বাংলাদেশে করোনা ভ্যাকসিনের প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ প্রদান কর্মসূচি।

প্রধানমন্ত্রীর সক্রিয় হস্তক্ষেপে সেই খারাপ সময় কাটিয়ে এসেছি আমরা। শুরুতে যখনই ভ্যাকসিন পাওয়া গেছে, হাজার-হাজার মানুষ ভ্যাকসিন নিয়েছে। ভ্যাকসিনের শিডিউল পাওয়ার জন্য তদবির কম পোহাতে হয়নি আমার মতো ডাক্তারদেরও।

শুরুতে নিজস্ব কোনো ভ্যাকসিন না থাকা সত্ত্বেও একদিনে কোটি ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়ার অনন্য রেকর্ডও গড়েছে বাংলাদেশ, ভারত আর চীনের পর তৃতীয় দেশ হিসেবে, যেখানে পৃথিবীতে কোটি জনসংখ্যার দেশের সংখ্যা একশ’র কাছাকাছি। শুধু তাই নয়, শতভাগ বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেওয়ার অনন্য মানবিক নজিরও স্থাপন করেছেন বাংলাদেশ সরকার। সেখান থেকে অনেকটাই বিপদমুক্ত আজকের পৃথিবী।

করোনা আছে ঠিকই, কিন্তু তার আগের সেই তেজটা আর নেই। আর এর মাঝেই ব্যর্থ বিশেষ ক্যাম্পেইনের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হলো বাংলাদেশে করোনা ভ্যাকসিনের প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ প্রদান কর্মসূচি। এখন থেকে বিশেষ কারণ ছাড়া কেউ আর প্রথম বা দ্বিতীয় ডোজ করোনা ভ্যাকসিন পাবেন না। তবে যথারীতি চালু থাকবে করোনা ভ্যাকসিনের বুস্টার ডোজ প্রদানের কর্মসূচি।

এক সময় যা ছিল সোনার হরিণ, সেই ভ্যাকসিনের প্রায় এক কোটি ডোজ মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়ায় ফেলে দিতে হবে সরকারকে।

প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে হঠাৎ কেন এই ইউটার্ন? যে মানুষ এক সময় লাইন দিয়ে, তদবির করে করোনার টিকা নিত, কী এমন ঘটলো যে তারা সহসা ভ্যাকসিন বিমুখ হয়ে পড়ল। বিষয়টা একটু বোঝার জন্য দু’জন পরিচিত মানুষকে প্রশ্ন করেছিলাম, অনেকটা র‌্যান্ডম সিলেকশনের ভিত্তিতেই।

মানুষ ভ্যাকসিন নিচ্ছে না কেন জানতে চাইলে প্রথমজনের সোজা উত্তর, ‘করোনা তো শেষ হয়ে গিয়েছে’! অন্যজন তো আরেক কাঠি সরেস। জবাব দিল, “ঠিকই বলেছেন, হেপাটাইটিস বি’র ভ্যাকসিন শিগগিরই নিয়ে নিতে হবে”। বুঝলাম করোনা এখন আর আমাদের মনস্তত্ত্বে নেই।

আমরা ধরেই নিয়েছি করোনা হেরে গেছে, বিদায় নিয়েছে। মানুষকে ঠেলে আইসিইউতে পাঠানোর মতো মাজায় অত জোর হালের এই ওমিক্রনের নেই। এটি এখন সর্দি-কাশির মতোই মামুলি ব্যাপার। কাজেই আমার মনে হয় না হাজার প্রচারণায়ও আমরা মানুষকে আর এক বছর আগের মতো ভ্যাকসিন নিতে অথবা মাস্ক পরতে উজ্জীবিত করতে পারব। যে মানুষ মাস্কের থোড়াই পরোয়া করে, সে ভ্যাকসিন নিবে কোত্থেকে?

তবে এটাতো সত্যি যে করোনা এখনো বিদায় নেয়নি। নেবে সেই প্রত্যাশাটুকু আছে ঠিকই, তবে সেই সুদিন এখনো বহু দূর। পাশাপাশি ওমিক্রন যে সবসময় এমন নরমসরম টাইপ হয়েই থেকে যাবে, তার যে কখনো নখ-দাঁত গজাবে না তাইবা কে হলফ করে বলতে পারে?

প্রায় এক বছরের বেশি সময় ধরে ওমিক্রন দুনিয়া শাসন করছে বলে ভবিষ্যতে যে ডেল্টার মতো আবারও কোনো করোনা দানবের উত্থান হবে না, তা কিন্তু এখনই বলা যাচ্ছে না, বরং বলা ভালো, অনেকেরই শঙ্কা যে আমাদের এই উদাসীনতার সুযোগে করোনা আবার যেকোনো সময় মাথাচাড়া দিয়ে উঠতেই পারে। সেই বিবেচনায় মেয়াদোত্তীর্ণ করোনা ভ্যাকসিনগুলো আমরা ফেলে দিব ঠিকই, কিন্তু তাই বলে ভ্যাকসিন ভাণ্ডার খালি রাখা যাবে না।

প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে হঠাৎ কেন এই ইউটার্ন? যে মানুষ এক সময় লাইন দিয়ে, তদবির করে করোনার টিকা নিত, কী এমন ঘটলো যে তারা সহসা ভ্যাকসিন বিমুখ হয়ে পড়ল।

ন্যাসভ্যাক নামক থেরাপিউটিক ভ্যাকসিন নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণার সুবাদে আমার ভ্যাকসিন নিয়ে টুকটাক নাড়াচাড়া আর জানাশোনার সুযোগ হয়েছে। আমি জানি পৃথিবীতে এখনো অনেক দেশ আছে যারা নিয়মিত গুটিবসন্তের ভ্যাকসিন উৎপাদন ও সংরক্ষণ করে, যদিও এই ভাইরাস মানুষ বহু আগেই পৃথিবী ছাড়া করেছে। তাছাড়া করোনা ভ্যাকসিনের চতুর্থ অর্থাৎ দ্বিতীয় বুস্টার ডোজ তো এখন নিখাদ বাস্তবতা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ইসরাইল এমনি অনেক দেশেই এখন দ্বিতীয় বুস্টার চলমান। তবে প্রথমে করোনা আর তারপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে জর্জরিত বৈশ্বিক অর্থনীতির নেতিবাচক গতিবিধির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষেও অন্য আর দশটি দেশের সরকারের মতোই আগামীতে হাজার-হাজার কোটি টাকা খরচ করে মানুষকে করোনার বুস্টার ডোজ দেওয়ার কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়াটাও যে আর বাস্তবসম্মত নয়, সেটাতো বলাই বাহুল্য।

এই যখন বাস্তবতা, তখন বোধহয় সময় এসেছে করোনা ভ্যাকসিন কর্মসূচি নিয়ে নতুনভাবে ভাবার। তবে মুক্তবাজার অর্থনীতির অজুহাতে এদেশে একদল ব্যবসায়ী যেভাবে তেল থেকে চাল আর ডিজেল থেকে ডাল, কোনো কিছুতেই ষোলআনার চেয়েও বাড়তি মুনাফা ঘরে তুলতে ছাড়ে না, সেদেশে করোনা ভ্যাকসিনের বাজারও যাতে একদল লোভী ভ্যাকসিন ব্যবসায়ীর পকেটের ভেতরে গিয়ে না ঢুকে, সেজন্য দেশেই ভ্যাকসিন উৎপাদনের উপর জোর দেওয়া জরুরি।

প্রয়োজনে এই খাতে অল্প-বিস্তর সরকারি প্রণোদনা দেওয়ার বিষয়ও আমার মতে বিবেচনার দাবি রাখে। আমরা টেক-ট্রান্সফারের মাধ্যমে বিদেশি ভ্যাকসিন দেশে উৎপাদন করতেই পারি, তবে সেক্ষেত্রে কিছুটা সীমাবদ্ধতা থেকেই যাবে। পেটেন্টের বেড়াজালে সেই ভ্যাকসিন শুধু দেশেই ব্যবহার করা যাবে, সুযোগ পেলেও পাঠানো যাবে না বিদেশে।

বাংলাদেশে করোনা ভ্যাকসিনের বাজার যখন ক্রমেই সংকুচিত, পৃথিবীর দেশে-দেশে তা কিন্তু এখনো অবারিত। কাজেই আমরা যদি দেশে আবিষ্কৃত, দেশীয় পেটেন্টের ভ্যাকসিনের উপর জোর দেই তাতেই বোধ করি, ‘ধন্য রাজার, পুণ্য দেশ’ আরও বেশি করে নিশ্চিত হবে।

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল) ।। ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়