ছবি : সংগৃহীত

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস কাদের জন্য? এখানে কি বহিরাগতদের আগমন নিষেধ? এই প্রশ্নগুলো প্রায়ই শোনা যায় বা শুনতে হয়। কেন আসে প্রশ্নগুলো?

ঢাকার জনসংখ্যা কত? ঢাকা শহরের রাস্তার পরিমাণ কত? ঢাকা শহরের বিনোদনের জায়গা যেমন মাঠ, পার্ক, লেক, নদী ঘেঁষে রাস্তা কয়টা আছে এবং থাকলে সেগুলোর অবস্থা কী? সেখানে কি সবাই যেতে পারে? সেই পরিবেশ কি সরকার দিতে পেরেছে? যদি তা না হয় তবে তো মানুষ যেকোনো জায়গায় আসবে এইটাই স্বাভাবিক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বুয়েট যদি তাদের ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের চলাচল বন্ধ করে দেয় তাহলে কী পরিস্থিতি দাঁড়াবে তা কি আমারা ভেবেছি? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বুয়েটের ভেতর দিয়ে রাস্তা যদি জনসাধারণের গাড়ি, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বন্ধ করে দেওয়া হয় তাহলে ঢাকা শহরের যানজটের অবস্থা কোথায় দাঁড়াবে? তা কি আমরা ভেবেছি?

আরও পড়ুন : বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাঙ্কিং ও বিজ্ঞান শিক্ষার মান 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে শহরের অন্য যেকোনো জায়গা থেকে দেখতে কি আলাদা লাগে? ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে হেঁটে গেলে কি মনে হয় বাংলাদেশের যেকোনো জায়গা থেকে এইখানে উচ্চশিক্ষিত মানুষের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি?

ক্যাম্পাসের ভবন, গাছপালা, খোলা জায়গা, হেঁটে যাওয়া মানুষদের দেখলে কি বিস্ময় জাগে? ক্যাম্পাসের যেকোনো আবাসিক হলে ঢুকে সেই পরিবেশ দেখলে কি মনে হয় এইটা ঢাকা শহরের অন্য যেকোনো জায়গা থেকে অনেক সুন্দর পরিপাটি? তাহলে কেন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে আলাদা করা হবে?

গাদাগাদি করে আবাসিক হলে থাকছে শিক্ষার্থীরা। এত বছরে এর কোনো পরিবর্তন হয়নি। ক্যাম্পাসের মধ্যে দলীয় কোন্দল, রাজনৈতিক সমাবেশ সবই হয়। তা কি হওয়ার কথা ছিল?

বিশ্বের যেকোনো একটি ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ঢুকে দেখুনতো কেমন দেখতে? একদম পার্কের মতো লাগবে। এমনকি ইন্ডিয়া ইন্সস্টিউট অব সাইন্স [Indian Institute of Science-IISc]-এর ক্যাম্পাস দেখুন! কী সুন্দর পার্কের মতো মনোরম পরিবেশ।

ঢাকা শহরের যেকোনো জায়গা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের যেকোনো প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকলেই সাধারণ মানুষদের বুঝতে হবে যে এইমাত্র তারা একটি অসাধারণ জায়গায় ঢুকতে যাচ্ছে। ক্যাম্পাসের রাস্তাঘাট, গাছপালা, ভবন এইসব কিছুর এক অনন্য হারমোনি থাকার কথা। তা কি আছে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস এমন হওয়ার কথা যা দেখলে দেশের সাধারণ মানুষ বুঝবে যে এখানে উচ্চশিক্ষিত মানুষেরা থাকে। বুঝতে হবে শিক্ষিত মানুষদের রুচিবোধ কত সুন্দর। শিক্ষিত মানুষদের পোশাক, চালচলন, কথাবার্তা সবকিছুই যদি অন্যদের জন্য অনুকরণীয় না হয় তাহলে কীভাবে আমরা বলব মানুষ শিক্ষিত হলে দেখো এইরকম হয়।

আরও পড়ুন : বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি কতটা যৌক্তিক? 

আমাদের ছাত্ররা ক্যাম্পাসে যেইসব আচার-আচরণ দেখে, তা পরবর্তীতে কর্মস্থলে প্রয়োগ করে। এইখানে হলে থাকা অবস্থায় শিক্ষার্থীরা মারামারি করছে, ক্লাস ফাঁকি দিচ্ছে, দলীয় এজেন্ডা পূরণ করছে।

ক্যাম্পাসে কোথাও খোলা মাঠে খাওয়া-দাওয়ার অনুষ্ঠান থাকলে যত্রতত্র আবর্জনা ফেলা দেখলেই বোঝা যায় আমরা কেমন মানসিকতার শিক্ষার্থী তৈরি করছি।

আবাসিক হলের টয়লেটের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় নাক-মুখ বন্ধ না করে যাওয়া যায় না। গাদাগাদি করে আবাসিক হলে থাকছে শিক্ষার্থীরা। এত বছরে এর কোনো পরিবর্তন হয়নি। ক্যাম্পাসের মধ্যে দলীয় কোন্দল, রাজনৈতিক সমাবেশ সবই হয়। তা কি হওয়ার কথা ছিল?

শিক্ষা যে এই দেশে গুরুত্বহীন তার প্রতিফলনই হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের দৈন্যতা। এর ফলে পুরো দেশেই দৈন্যতার ছাপ স্পষ্ট। কবে মুক্তি পাব আমরা? এর উত্তরও অজানা।

আমাদের আমলা, বিচারক, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, এমপি, মন্ত্রী সব তো এখান থেকেই তৈরি হয়। এটাইতো সূতিকাগার বা আঁতুড়ঘর। এটা ঠিক না করলে বাংলাদেশ ঠিক হবে না। এটা ঠিক নাই বলেই আমাদের সবকিছুই ব্যর্থ। তা ঠিক করার দায়িত্ব যাদের তারা এখানকার তৈরি। এখন কারা আগে ঠিক হবে? আমরা না তারা?

মোটাদাগে বলা যায়, বাংলাদেশ চালায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এক আশ্চর্য কারণে এখান থেকে পাস করে গিয়ে তারা নিজের বিশ্ববিদ্যালয় ভালোভাবে গড়ে তুলতে কোনো অবদান রাখে না। অথচ তারা অ্যালামনাইয়ের মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করছে।

বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বুয়েটের ক্যাম্পাস হওয়া উচিত ছিল ন্যূনতম ক্যান্টনমেন্ট এবং বিজিবি ক্যাম্পাসের মতো। ক্যান্টনমেন্ট, বিজিবি বা রাইফেল স্কয়ার সুন্দর তাতে কোনো আপত্তি নেই। এই উল্টো দেশে সবকিছুই উল্টো।

আরও পড়ুন : পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্য রন্ধ্রে রন্ধ্রে

শিক্ষা যে এই দেশে গুরুত্বহীন তার প্রতিফলনই হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের দৈন্যতা। এর ফলে পুরো দেশেই দৈন্যতার ছাপ স্পষ্ট। কবে মুক্তি পাব আমরা? এর উত্তরও অজানা।

মুক্তির জন্য দরকার একজন আলোকিত নেতা। কারণ এখন আমরা যেই অবস্থায় পৌঁছে গেছি সেই অবস্থায় নিচ থেকে পরিবর্তন অসম্ভব। পরিবর্তনটা এখন আসতে হবে উপর থেকে।

রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মানুষকে বুঝতে হবে সব উন্নয়নই বৃথা যাবে যদি শিক্ষায় জাতির উন্নয়ন না ঘটে। একটা দেশ তার সেরা বিশ্ববিদ্যালয় পঙ্গু বানিয়ে রেখে উন্নত হয়েছে এমন উদাহরণ নেই। আগে একটি উন্নত মানের বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজন এরপর শিক্ষার মান এবং গবেষণা প্রয়োজন। এতে করে আমাদের উচ্চশিক্ষার মান নিশ্চিত হবে। না হয় আমরা কখনোই নিজেদের আলাদা প্রমাণ করতে পারব না।

ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়