ছবি : সংগৃহীত

দস্যুমুক্ত হওয়ার আগের গল্প
আত্মসমর্পণের মাধ্যমে সুন্দরবনের দস্যুতা বন্ধ? কিছুতেই সম্ভব না। এটা হচ্ছে আইওয়াশ। বনদস্যুদের কাছে এত এত অস্ত্র থাকার কথা নয়। অস্ত্রগুলো র‍্যাবই দিয়ে দিচ্ছে। এগুলো সব নাটক.... ২০১৬ সালের নভেম্বরে রাসমেলার আগের সন্ধ্যায় দুবলার চরে কথাগুলো বলছিলেন সুন্দরবন-সাগরের বড় এক মাছ ব্যবসায়ী।

২০১৬ সালের ৩১ মে থেকে শুরু, ততদিনে ৭টি দস্যুদল আত্মসমর্পণ করে ফেলেছে। আমাকে বলা হলো, এসবের মধ্যে আমি কেন জড়িয়েছি? সেই বিগ শট ব্যবসায়ী আমাকে বলছিলেন, বারবার একই অস্ত্র দেখিয়ে আত্মসমর্পণ দেখানো হচ্ছে।

আমি বললাম, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে অস্ত্র জমা দেওয়ার পর সেগুলো মামলার আলামত হিসেবে থানা হয়ে আদালতে পৌঁছে যাচ্ছে। তাহলে সেই একই অস্ত্র কীভাবে বারবার দেখাবে র‍্যাব? জবাবে তিনি বললেন, এসব লোক দেখানো কাজ। ক্রসফায়ার ছাড়া সুন্দরবনের দস্যুদের দমন করা যাবে না।

আরও পড়ুন : জলদস্যুতার সংবাদ : কিছু কথা, কিছু অভিজ্ঞতা 

মধ্যস্থতা করতে গিয়ে সুন্দরবনের দস্যুদের আদ্যোপান্ত জেনেছি। আর পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে ঢুকে পড়েছিলাম বলে বুঝেছিলাম কী কারণে, কারা আত্মসমর্পণের পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছিলেন।

যাই হোক, মৃদু প্রতিবাদ করে নীরবে নিজের মতো করে কাজ করে যাচ্ছিলাম। এরপর ধাপে ধাপে আড়াই বছরে সুন্দরবন দস্যুশূন্য হয়। ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর শেষ ৬টি দস্যুদলের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে সুন্দরবনে সংগঠিত দস্যুবৃত্তির অবসান ঘটে।
আক্রান্ত সুন্দরবন

বড়শি হাতে বসে থাকি জঙ্গলে। এক একটা গলদা চিংড়ি ধরার জন্য কত হাজারবার যে উপরওয়ালার নাম নেই! সেই মাছ যখন ডাকাতে নিয়ে যায় তখন কী কষ্টটা যে লাগে! ও আপনারা বুঝবেন না… খুলনার এক প্রবীণ মাছ শিকারি বলছিলেন কথাগুলো।

সুন্দরবনের মাছ, কাঁকড়া কিংবা মধু আহরণকারীদের নিয়েই ছিল বনদস্যুদের কারবার। এর বাইরে বড় কয়েকটি দস্যুদল সাগরে যেত, জেলেদের অপহরণ করে মুক্তিপণ নিত, কেড়ে নিয়ে আসতো মাছ।

সুন্দরবনের হাড়বাড়িয়ায় দেখা হয়েছিল তার সঙ্গে। প্রতি গোন (গোন অর্থ হলো চাঁদের হিসাবে মাছ ধরার সময়)-এ একা একা নৌকা বেয়ে খুলনা থেকে আসেন তিনি সুন্দরবনে। গোন শেষে আবার ফিরে যান। 

কয়েক হাজার কাঁকড়া শিকারি সুন্দরবনে যাওয়া আসা করেন সারা বছর। বনের এই সম্পদটি বেশ দামি। অথচ কাঁকড়া আহরণের এই মহাযজ্ঞ সুন্দরবনে চলে নীরবে। কোটি কোটি টাকার সম্পদ উঠে আসে বন থেকে। সেই অর্থের একটি অংশের দাবি করে দস্যুদলগুলো। অবশ্য দস্যুদের সঙ্গে কাঁকড়া শিকারিদের দেখা হলেও টাকা পয়সার লেনদেন তারা সরাসরি করতো না।

আরও পড়ুন : জলবায়ু পরিবর্তন : তলিয়ে যেতে পারে বাংলাদেশের ১৩ শতাংশ ভূমি

লোকালয়ে বসবাস করা কিছু ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে এই লেনদেন হতো। সুন্দরবনের মাছ, কাঁকড়া কিংবা মধু আহরণকারীদের নিয়েই ছিল বনদস্যুদের কারবার। এর বাইরে বড় কয়েকটি দস্যুদল সাগরে যেত, জেলেদের অপহরণ করে মুক্তিপণ নিত, কেড়ে নিয়ে আসতো মাছ।

চাঁদা আর মুক্তিপণ লেনদেন
সশস্ত্র জলদস্যু-বনদস্যুদের এই দলগুলো পরিচালনা করা হতো লোকালয় থেকে। চাঁদা সংগ্রহ, মুক্তিপণের টাকা লেনদেন, অবৈধ অস্ত্রগুলো সরবরাহ থেকে শুরু করে বাজার পাঠানোর কাজটিও করতো ডাঙ্গার কিছু মানুষ, যাদের বনদস্যুদের গডফাদার বলা হতো। বনের দস্যুদের রোজগার করা অর্থের বড় অংশই তাদের পকেটে যেত। 

দস্যুতার চক্র নির্মূলে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সদিচ্ছা ছিল। তাই গঠন করা হয় টাস্কফোর্স। র‍্যাবের নেতৃত্বে এই টাস্কফোর্সের উপস্থিতি শুরু থেকেই ছিল। চেষ্টা চলছিল। কিন্তু শুধু অভিযান করে কি এত বড় একটি গহীন বনের অপরাধীদের ধরা সম্ভব?
দস্যুমুক্ত হওয়ার গল্প

২০০৯ সালে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস আইলা’র পর দস্যুমুক্ত করার ব্যাপারে নিবিড়ভাবে কাজ শুরু করেছিলাম। সুন্দরবন উপকূলে কাজ করতে গিয়ে জানতে পারি যে দস্যুদের নিয়ে ভয়াবহ বিপদে আছে জেলেরা। এই বিপন্ন জনপদের কথাগুলো মূল ধারার সংবাদ মাধ্যমে আসে না।

আরও পড়ুন : রোহিঙ্গা ইস্যু: সংকট উত্তরণে সহায়ক হবে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন 

প্রথমত একটি একটি করে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন শুরু করলাম। কাজ করতে গিয়ে কথা হলো বড় বড় দস্যুনেতাদের সঙ্গে। জানলাম দস্যু জীবন তারাও উপভোগ করে না। বরং সেই জীবন অনেক বেশি আতঙ্কের। দিন-রাত মৃত্যু আতঙ্ক নিয়ে বনের ভেতরে ঘুরে বেড়ায় তারা।

ডাকাতি, চাঁদাবাজি আর মুক্তিপণের টাকা দিয়ে শুধু অস্ত্রগুলো কিনতে পারতো তারা। বাকি টাকা খেয়ে ফেলতো নানা জনে। কাজেই ফেরারি জীবনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার নজর থেকে দূরে থাকা ছাড়া দস্যু জীবনে আর তেমন কোনো প্রাপ্তি ছিল না।

২০১৮ সালের ১ নভেম্বর শেষ দস্যুদলগুলো আত্মসমর্পণ করে। সুন্দরবন হয় দস্যুমুক্ত। সেই অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যোগ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তাহলে এই জীবনে আছেন কেন? আত্মসমর্পণ করেন না কেন? উত্তরে বনদস্যুরা বলতো ক্রসফায়ারের কারণে তারা আর ফিরতে পারছেন না। কিন্তু ইচ্ছে আছে।

তখন থেকেই দস্যুদলগুলো নিয়ে সংবাদ সংগ্রহের পাশাপাশি আত্মসমর্পণে মধ্যস্থতার চিন্তা মাথায় আসে। পরবর্তীতে তিন দফা প্রস্তাব আসে আত্মসমর্পণের। কিন্তু সরকার তাতে সাড়া দেয়নি।

সংশ্লিষ্টরা ভেবেছিলেন আভিযানিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে নির্মূল হবে দস্যুতা। কিন্তু পরে সেই ধারণা থেকে বের হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। চতুর্থ দফায় আবারও একটি বড় দস্যুদলের আত্মসমর্পণের প্রস্তাব নিয়ে হাজির হই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের কাছে। তখন র‍্যাব মহাপরিচালক ছিলেন ড. বেনজীর আহমেদ। সিদ্ধান্ত হয়, আত্মসমর্পণে রাজি সরকার। 

আরও পড়ুন : সীমান্ত সংকট ও মিয়ানমারের সামরিকায়ন : কী করছে বিশ্ব? 

২০১৬ সালের ৩১ মে প্রথম দস্যুদলটি আত্মসমর্পণ করে। এরপর ধাপে ধাপে আত্মসমর্পণ এগিয়ে চলে। ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর শেষ দস্যুদলগুলো আত্মসমর্পণ করে। সুন্দরবন হয় দস্যুমুক্ত। সেই অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যোগ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সাবেক দস্যুদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব নেন তিনি। একই সঙ্গে তাদের মামলাগুলো প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দেন। 

দস্যুমুক্ত হওয়ার পরের গল্প
২০১৮ থেকে ২০২২। ৩২টি বনদস্যু-জলদস্যু দলের ৩২৮ জন আত্মসমর্পণ করে, জমা দেয় ৪৭০টি বন্দুক ও সাড়ে ২২ হাজার গুলি। এরপর চার বছর পেরিয়েছে। সুন্দরবন এখনো দস্যুমুক্ত আছে। মাঝে মাঝে কিছু ছোট গ্রুপ আবারও দস্যুতায় নামার চেষ্টা করে। কিন্তু আগের সেই পরিবেশ নেই বলে তারা টিকতে পারে না। ফলে সংগঠিত দস্যুতা এখনো ফেরেনি সুন্দরবনে।

তার মানে কী সামনেও সুন্দরবন দস্যুমুক্ত থাকবে? বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। কারণ সুন্দরবনে এবার দস্যুতা ফিরলে আবারও নতুন করে এই বন দস্যুমুক্ত করা যাবে না। আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত দস্যুতার অবসান ঘটলেও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কখনোই। তারা আবারও নড়াচড়া শুরু করেছে।

আরও পড়ুন : ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং : প্রস্তুতি ও মোকাবিলা জরুরি 

সুন্দরবনের দস্যুদের পৃষ্ঠপোষক ও সহায়তাকারীদের প্রায় সবাই চিহ্নিত। বহাল তবিয়তেই আছে তারা। সময় সুযোগ আসলেই আবারও আগের ভূমিকায় নামার জন্য অপেক্ষায় তারা। এই বিষয়ে সংশ্লিষ্টদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

দস্যুতার কারণে বড় বিপদে থাকা বড় বড় মাছ ব্যবসায়ীরা খুশি হয়নি কেন? ভাবতে হবে। সুন্দরবনকে আবারও ঝুঁকিতে ফেলা যাবে না কিছুতেই। 

এদিকে সাবেক বনদস্যুদের পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া চলছে। সামাজিক পুনর্বাসন হয়েছে। তবে অর্থনৈতিকভাবে দৈন্যদশায় তারা। তার উপরে মামলা চালানোর খরচ চালাতেও হিমশিম খাচ্ছে তারা। তবুও এই জীবনে ফিরে আসা নিয়ে সন্তুষ্ট তারা। শুধু সরকারের প্রতিশ্রুত মামলাগুলোর প্রত্যাহার করা হলেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে তারা।

মোহসীন-উল হাকিম ।। বিশেষ প্রতিনিধি, যমুনা টেলিভিশন