ছবি : সংগৃহীত

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিওএইচও) সড়ক দুর্ঘটনাকে একটা রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং তাদের দেওয়া তথ্যমতে পুরো পৃথিবীতে যেসব রোগে মানুষ মারা যায় তার প্রথম দশটির মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা সপ্তম এবং এখনই যদি কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া হয় তাহলে তা তৃতীয় কারণে চলে যাবে।

প্রশ্ন হচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনা কমানো যায় কীভাবে? জাতিসংঘ বিশ্বব্যাপী সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে একটি কৌশল প্রণয়ন করছে যেখানে তারা পাঁচটি বিষয় প্রাধান্য দিয়েছে যেমন সড়ক ব্যবস্থাপনা, নিরাপদ সড়ক, নিরাপদ যানবাহন, নিরাপদ সড়ক ব্যবহারকারী এবং দুর্ঘটনা পরবর্তী রেসপন্স ব্যবস্থা।

এই পাঁচটির মধ্যে প্রথম চারটি বিষয় দুর্ঘটনা পূর্ববর্তী ব্যবস্থাপনার সাথে সংশ্লিষ্ট এবং এদের মধ্যে প্রথম তিনটি সরাসরি প্রকৌশল ও প্রযুক্তির সাথে সংশ্লিষ্ট।

একটি মানসম্মত সড়ক কীভাবে নির্মাণ করতে হবে তা যেমন বিভিন্ন ম্যানুয়ালে লেখা আছে তেমনি একটি আধুনিক যানবাহনে কোন ধরনের নিরাপত্তা উপকরণ থাকতে হবে সেই বিষয়ে বিজ্ঞান আজ অনেকদূর এগিয়েছে আর অন্যদিকে পরিকল্পিত সড়ক ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন মডেল অনেক দেশেই সফলভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন : এই মৃত্যু উপত্যকাই আমার দেশ!

এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমরা যদি সেগুলো মেনে আমাদের দেশের সব রাস্তা পাঁচ তারকা মানের করে ফেলি (ইন্টারন্যাশনাল রোড এসেসমেন্ট প্রোগ্রাম [International Road Assessment Programme : iRAP], এর স্টার রেটিং করা হয় রাস্তায় ইন্সপেকশনের মাধ্যমে। যেখানে একটি স্টারের অর্থ হলো খুব ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তা আর পাঁচটি স্টারের অর্থ হলো নিরাপদ রাস্তা) অথবা আমরা যদি আমাদের দেশের সব মোটরযান পাঁচ তারকা মানের করে ফেলি তাহলে কি আর কোনো দুর্ঘটনা ঘটবে না? তারপরেও দুর্ঘটনা ঘটবে বা ঘটার সম্ভাবনা থাকবে যদি না আমরা নিরাপদ সড়ক ব্যবহারকারী তৈরি করতে পারি।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে যারা সড়ক দুর্ঘটনা সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসতে পেরেছে তারা তাদের আইন ও বিভিন্ন নীতিমালায় এই পাঁচটি রিস্ক ফ্যাক্টর সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে।

নিরাপদ সড়ক ব্যবহারকারী তৈরি করা একটি কষ্টসাধ্য প্রক্রিয়া কারণ মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার শতভাগ সফল কোনো বুদ্ধি নেই। জাতিসংঘ সড়ক ব্যবহারকারীদের পাঁচটি আচরণগত ঝুঁকি বা রিস্ক ফ্যাক্টরের উপর গুরুত্ব দিয়েছে যার কারণে শতভাগ নিরাপদ রাস্তা, মোটরযান বা ব্যবস্থাপনা থাকলেও সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। সেগুলো হলো—অতিরিক্ত গতি, অনিরাপদ হেলমেট, সিটবেল্ট, নেশাগ্রস্ত গাড়ি চালনা ও গাড়িতে বিশেষ শিশু বন্ধনী না থাকা।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে যারা সড়ক দুর্ঘটনা সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসতে পেরেছে তারা তাদের আইন ও বিভিন্ন নীতিমালায় এই পাঁচটি রিস্ক ফ্যাক্টর সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে।

আরও পড়ুন : রেলক্রসিং কেন অরক্ষিত? 

বাংলাদেশ সরকারও সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাসে ও সড়কে শৃঙ্খলা বৃদ্ধিতে ২০১৮ সালে, দীর্ঘ যাচাই-বাছাই ও মতবিনিময় পূর্বক মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ সালে সংশোধন, পরিমার্জন করে আধুনিক সড়ক ব্যবস্থাপনার সাথে মিল রেখে ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮’ প্রণয়ন করছে।

আইনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এটা যেমন সত্য তেমনি কিছু বিষয় পুনঃবিবেচনার পাশাপাশি অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। বিশেষ করে এই আইনে পাঁচটি রিস্ক ফ্যাক্টর নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়ে স্পষ্ট ও কার্যকর দিক নির্দেশনার অভাব রয়েছে।

প্রথমত, আইনে বলা আছে গতিসীমা মানতে হবে এবং কর্তৃপক্ষ সড়কে গতিসীমা স্থাপন করবে। কিন্তু আমাদের দেশে গতিসীমা স্থাপনের জন্য কোনো গাইডলাইন নেই অর্থাৎ কোন রাস্তায়, কোন পরিস্থিতিতে গতিসীমা কত হবে তা আইনে স্পষ্ট করা হয়নি।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গতিসীমা নিয়ন্ত্রণে গাইডলাইন রয়েছে যা তাদের আইন বা বিধি দ্বারা স্বীকৃত এবং যার সাহায্যে কর্তৃপক্ষ রাস্তায় গতিসীমা স্থাপন ও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে এখনো পর্যন্ত সড়কে যে গতিসীমা আমরা দেখে থাকি তা রাস্তা নির্মাণকারী কর্তৃপক্ষ তাদের অভিজ্ঞতা থেকে প্রদান করে থাকে যা অনেক সময় রাস্তায় পরিবেশের সাথে মানানসই হয় না।

আরও পড়ুন : পরিকল্পিত মেট্রোরেল কেন জরুরি 

অন্যদিকে প্রদত্ত গতিসীমা নিয়ন্ত্রণ কীভাবে করা সম্ভব তারও কোনো নির্দেশনা না থাকায় চালকেরা বেশিরভাগ সময় অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালায় ও দুর্ঘটনা ঘটায়। তাই বাংলাদেশের উপযোগী একটি বিজ্ঞানভিত্তিক গতিসীমা নিয়ন্ত্রণে গাইডলাইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন এবং ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ বা এর বিধি দ্বারা সেই গাইডলাইন মেনে চলার বিষয় নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

দ্বিতীয়ত, এই আইনে হেলমেট পরে মোটরসাইকেল চালনা এই সংশ্লিষ্ট শাস্তির কথা বলা থাকলেও হেলমেটের মান কেমন হবে বা কীভাবে নিরাপদভাবে হেলমেট পরিধান করতে হবে তা উল্লেখ নেই।

এই সুযোগে অনেক মোটরসাইকেল আরোহী একদিকে যেমন নিন্মমানের হেলমেট ব্যবহার করে তেমনি অন্যদিকে সঠিকভাবে হেলমেট পরিধান করে না। কিন্তু আইনে যেহেতু হেলমেটের মান কেমন হবে বা কীভাবে পরতে হবে তা বলা নেই তাই ট্রাফিক পুলিশের পক্ষে এই ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। হেলমেটের মান নির্ধারণ করে ও সঠিকভাবে ব্যবহারের পদ্ধতি আইনে বা বিধিতে থাকা প্রয়োজন।

আমাদের দেশে গতিসীমা স্থাপনের জন্য কোনো গাইডলাইন নেই অর্থাৎ কোন রাস্তায়, কোন পরিস্থিতিতে গতিসীমা কত হবে তা আইনে স্পষ্ট করা হয়নি...

তৃতীয়ত, সিটবেল্টের ব্যবহার। বর্তমান আইনে চালকের সিটবেল্ট ব্যবহারের বিষয় স্পষ্ট করা হলেও সিটবেল্ট কীভাবে পরবে তা বলা হয়নি। এছাড়াও যাত্রীদের সিটবেল্ট পরার বিষয়ে বিধিতে উল্লেখ থাকবে বলা হলেও বিধিমালা প্রকাশিত না হওয়ায় এই সংশ্লিষ্ট আইন বাস্তবায়নে পুলিশ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।

চতুর্থত, আইনে মদ্যপান বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করে চালক বা শ্রমিক গাড়ি চালাতে পারবে না উল্লেখ করা আছে কিন্তু এর কোনো লিমিট বা মাত্রা দেওয়া হয়নি।

অনেক সময় বিভিন্ন ওষুধ সেবনে বা নির্দিষ্ট কিছু খাদ্যে মানুষের শরীরে অ্যালকোহলের উপস্থিতি পাওয়া যেতে পারে, তাই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ গাড়ি চালনার সময় রক্তে অ্যালকোহলের মাত্রার সীমা প্রদান করে থাকে যেমন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে Blood alcohol content (BAC) প্রতি ১০০ মিলি লিটারে ০.০৩ শতাংশ এবং মালয়েশিয়ায় যা প্রতি ১০০ মিলিলিটার রক্তে Blood alcohol content (BAC) ০.০৩ শতাংশ।

আরও পড়ুন : আলমডাঙ্গা মহাসড়কের একদিন 

আবার অনেক দেশ আছে যেখানে যেকোনো মাত্রার নেশাজাতীয় দ্রব্য খেয়ে গাড়ি চালনা অপরাধ। তাই আমাদের দেশের জন্য কোন পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে তা নির্দিষ্ট করা প্রয়োজন তা না হলে অনেক চালক বা শ্রমিক হয়রানির শিকার হতে পারে।
সবশেষে যে রিস্ক ফ্যাক্টরের কথা বলা আছে তা হলো চলন্ত গাড়িতে শিশুদের নিরাপত্তার জন্য আলাদা শিশু সিট বা চাইল্ড রেস্ট্রেইনের ব্যবস্থা করা।

অর্থ বিনিয়োগ করে চাইলেই আমরা ভালো রাস্তা নির্মাণ করতে পারি, চাইলেই দামি গাড়ি কিনতে পারি কিন্তু আমরা যদি আমাদের আচরণগত যে ঝুঁকি রয়েছে সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি তাহলে দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো সড়ক আর সবচেয়ে নিরাপদ বাহনও আমাদের সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে না। আর আমাদের আচরণগত ঝুঁকি বা রিস্ক ফ্যাক্টর নিয়ন্ত্রণ করতে আইনে এই বিষয়গুলো সঠিকভাবে ও সুনির্দিষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।  

কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ ।। সহকারী অধ্যাপক, এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট, বুয়েট