ছবি : সংগৃহীত

শীতের সময় অসুখ-বিসুখ বাড়ে না; বরং কিছু কিছু রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। তাই তীব্র শীত আসার আগেই কিছু রোগের প্রকোপ ঠেকাতে সতর্ক থাকা ভালো। প্রয়োজন কিছুটা বাড়তি সচেতনতা।

শীতে প্রধানত বাড়ে শ্বাসতন্ত্রের রোগ। যদিও এসব রোগের প্রধান কারণ ভাইরাস, তবু তাপমাত্রার সঙ্গে এর সম্পর্ক রয়েছে। শীতে বাতাসের তাপমাত্রা কমার সঙ্গে আর্দ্রতাও কমে যায়, যা শ্বাসনালির স্বাভাবিক কর্মপ্রক্রিয়া বিঘ্নিত করে ভাইরাসের আক্রমণ সহজ করে। শুষ্ক আবহাওয়া বাতাসে ভাইরাস ছড়াতে সাহায্য করে। এছাড়া ধুলাবালির পরিমাণ বেড়ে যায়। ঠাণ্ডা, শুষ্ক বাতাস হাঁপানি রোগীর শ্বাসনালি সরু করে দেয়, ফলে হাঁপানির টান বাড়ে।

সর্দি কাশি

শীতের শুরু ও শেষে বিশেষত ঋতু বদলে সাধারণ ঠাণ্ডাজনিত সর্দি-কাশি সবারই হয়ে থাকে। চিকিৎসকদের কাছে তা ‘কমন কোল্ড’ হিসেবে পরিচিত। দুইশ’র বেশি ভিন্ন ভিন্ন ভাইরাস সর্দি-জ্বরে ভোগাতে পারে। এই রোগের শুরুতে গলা ব্যথা করে, গলায় খুসখুস ভাব ও শুকনা কাশি দেখা দেয়, নাক বন্ধ হয়ে যায়, নাক দিয়ে অনবরত পানি ঝরতে থাকে এবং ঘন ঘন হাঁচি আসে।

আরও পড়ুন : জীবন নিয়ে খেলা! 

হালকা জ্বর, শরীর ব্যথা, মাথাব্যথা, শরীর ম্যাজম্যাজ করা, দুর্বল লাগা ও ক্ষুধামন্দা দেখা দেয়। এটা মূলত শ্বাসতন্ত্রের ওপরের অংশের রোগ। এই রোগ এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাশি কয়েক সপ্তাহ থাকতে পারে।

মধু, কালিজিরা, আদা চা, লেবু চা এই সময় উপকারী। প্রয়োজনে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে এবং তার পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খেতে হবে। 

শীতে প্রধানত বাড়ে শ্বাসতন্ত্রের রোগ। যদিও এসব রোগের প্রধান কারণ ভাইরাস, তবু তাপমাত্রার সঙ্গে এর সম্পর্ক রয়েছে। শীতে বাতাসের তাপমাত্রা কমার সঙ্গে আর্দ্রতাও কমে যায়....

ইনফ্লুয়েঞ্জা

শীতে ইনফ্লুয়েঞ্জাও বেশি মাত্রায় দেখা যায়। এই রোগ মূলত ভাইরাসজনিত। ঠাণ্ডার অন্যান্য উপসর্গ ছাড়াও এই রোগের ক্ষেত্রে জ্বর ও কাশি খুব বেশি হয় এবং শ্বাসকষ্ট হতে পারে। সর্দি-কাশি-জ্বর, ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রতিরোধে করণীয় হলো—সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত হলে অন্যদের সঙ্গে, বিশেষ করে শিশুদের সঙ্গে মেলামেশায় সতর্কতা অবলম্বন করুন।

হাঁচি দেওয়ার সময় বা নাকের পানি মুছতে রুমাল বা টিস্যু পেপার ব্যবহার করুন। রোগীর ব্যবহৃত রুমাল বা গামছা অন্যদের ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখুন। যেখানে সেখানে কফ, থুথু বা নাকের শ্লেষ্মা ফেলা যাবে না।

আরও পড়ুন : অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক সিলগালা : বেটার লেট দ্যান নেভার 

স্বাস্থ্যকর, খোলামেলা, শুষ্ক পরিবেশে বসবাস করতে হবে। প্রয়োজনমতো গরম কাপড় পড়ুন, বিশেষ করে তীব্র শীতের সময় কান ঢাকা টুপি এবং গলায় মাফলার ব্যবহার করুন।

তাজা, পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ এবং পর্যাপ্ত পানি পান করুন, যা দেহকে সতেজ রাখবে এবং রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করবে। মাঝে মধ্যে হালকা গরম পানি দিয়ে গড়গড়া করুন বা হাত ধোয়ার অভ্যাস করুন।

নিউমোনিয়া

এটি একটা মারাত্মক অসুখ। এই রোগে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি বাড়ে নবজাতক, শিশু, বৃদ্ধ, হাঁপানি রোগী ও ধূমপায়ীদের। পৃথিবীব্যাপী পাঁচ বছরের নিচের শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ নিউমোনিয়া।

বাংলাদেশেও শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণ এই রোগ। যদিও এটি প্রতিরোধযোগ্য এবং চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময়যোগ্য একটি রোগ, তথাপিও মৃদু বা হালকা নিউমোনিয়া থেকে জীবনহানিও হতে পারে।

আরও পড়ুন : স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা রুখবে কে?

নিউমোনিয়া থেকে বাঁচতে কিছু করণীয় হলো—সবসময় সঠিকভাবে শিশুর যত্ন নিন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন, বিশেষ করে সাবান-পানি দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস করুন। শীত উপযোগী হালকা ও নরম গরম কাপড় ব্যবহার করুন। সহনীয় গরম পানিতে শিশুর শরীর ধুয়ে দিন। বেশি মানুষের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন।

অসুস্থ লোক, বিশেষ করে হাঁচি-কাশিতে আক্রান্ত লোকের সামনে শিশুদের যেতে দেবেন না। সুস্থ শিশু সর্দি-কাশি, ব্রংকিওলাইটিস, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুর কাছে যেতে দেবেন না। শিশুর সামনে বড়দের হাঁচি-কাশি না দেওয়া বা মুখে রুমাল বা কাপড় ব্যবহার করার অভ্যাস করান। 

...এই রোগে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি বাড়ে নবজাতক, শিশু, বৃদ্ধ, হাঁপানি রোগী ও ধূমপায়ীদের। পৃথিবীব্যাপী পাঁচ বছরের নিচের শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ নিউমোনিয়া।

সবসময় নাক পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করুন। চুলার ধোঁয়া, মশার কয়েল ও সিগারেটের ধোঁয়া থেকে দূরে থাকুন। সুষম ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়ান, ভিটামিন ‘এ’ ও ‘ডি’ গ্রহণ করুন। ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী করতে পর্যাপ্ত ঘুম, নিয়মিত ব্যায়াম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন।

অ্যাজমা

হাঁপানি বা অ্যাজমা জাতীয় শ্বাসকষ্টের রোগ শুধু শীতকালীন রোগ নয়, তবে শীতের প্রকোপ অনেকাংশে বেড়ে যায়। অ্যাজমা একবার হলে এর ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হয় সারা জীবনই। তবে অ্যাজমাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে জটিলতা বা ঝুঁকি থাকে না বললেই চলে।

আরও পড়ুন : নকল ও ভেজাল ওষুধের প্রভাব ও প্রতিকার 

এজন্য কিছু করণীয় হলো—অ্যাজমার রোগীরা শীতে পর্যাপ্ত গরম জামা-কাপড় পরিধান করুন। ঘরে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস প্রবেশের ব্যবস্থা করুন। বিশেষ করে শোবার ঘর উষ্ণ রাখার চেষ্টা করুন। অ্যাজমার ট্রিগারগুলো জেনে সতর্কভাবে চলুন। শীতের আগেই চিকিৎসক দেখিয়ে ইনহেলার বা অন্যান্য ওষুধের ডোজ সমন্বয় করে নিন।

শীতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী থাকার মানে কেবল অসুখ থেকে দূরে থাকাই নয়; বরং আমাদের চুল, ত্বক ও হাড়ের স্বাস্থ্য ভালো রাখাও এর কাজ। শীতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ঘি, মিষ্টি আলু, আমলকী, খেজুর ও গুড় এই ৫টি খাবার খাবার খাবেন।

সবসময়ই যে শীতে রোগব্যাধি বাড়বে তাও সত্য নয়। সাধারণভাবে শীতকালে মানুষের রোগ কম হয়। তাই বাড়তি সতর্কতার পাশাপাশি অযথা আতঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন নেই।

ড. আনোয়ার খসরু পারভেজ ।। গবেষক ও অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
khasru73@juniv.edu