ছবি : সংগৃহীত

'বড়দিন' যিশুখ্রিষ্টের জন্মদিন। এই দিন দুই হাজার বাইশ বছর আগে ঈশ্বর পুত্র যিশুখ্রিষ্টের জন্ম হয়েছিল মানবজাতির মুক্তির লক্ষ্যে। অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজে আলো জ্বালানোর জন্যই তাঁর আগমন।

ঈশ্বর তাঁর আপন প্রতিমূর্তিতে মানুষ সৃষ্টি করেছিলেন। শাস্ত্রমতে তিনি প্রথম আদমকে সৃষ্টি করেছিলেন। তারপর আদমের পাঁজর থেকে একটি হাড় নিয়ে তাঁর সঙ্গী হবাকে সৃষ্টি করেছিলেন।

ঈশ্বর তাদের এদেন উদ্যানের পূর্বপ্রান্তে রেখেছিলেন। কিন্তু আদম এবং হবা ঈশ্বরের আদেশ অমান্য করায় তাদের এদেন উদ্যান থেকে বিতরণ করে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেন, আর শুরু হয় মানবজাতির জীবন সংগ্রাম।

আরও পড়ুন >>> ধর্মের রাজনীতি নাকি রাজনীতির ধর্ম 

পবিত্র বাইবেল অনুসারে আজ পৃথিবীতে যত মানুষ আছে তারা সবাই আদম এবং হবার বংশধর। কালক্রমে বংশবিস্তারের ফলে মানবজাতির সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে।

একপর্যায়ে মানবজাতি ঈশ্বরের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকে এবং পাপ ও পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। পাপ কার্য, অন্যায়, অবিচার ও অন্যায্যতা প্রাধান্য পেতে থাকে। আর এভাবে মানব সমাজ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।

মনুষ্যজাতির এই অধোগতি দেখে ঈশ্বর ব্যথিত হন কারণ ঈশ্বর মানবজাতি ভালোবেসে সৃষ্টি করেছেন। এমতাবস্থায় ঈশ্বর তাঁর প্রিয় পুত্র যিশুখ্রিষ্টকে এই পৃথিবীতে প্রেরণ করেন মুক্তিদাতা হিসেবে। আর এভাবে ঈশ্বর বা স্বর্গরাজ্যের সাথে মনুষ্যজাতির পুনরায় সম্পর্ক সৃষ্টি হয় যা আদম ও হবার অবাধ্যতার জন্য ছিন্ন হয়েছিল।

যিশুখ্রিষ্টের জন্ম এক অলৌকিক ঘটনা। ঈশ্বরের পরিকল্পনার অংশ, মানব মুক্তির লক্ষ্যে ছিল এই পরিকল্পনা...

মুক্তিদাতা যিশুখ্রিষ্টের জন্ম হয় অত্যন্ত দরিদ্র অবস্থায়। বেথলেহেম নগরীর এক ছোট্ট গোশালায় তাঁর জন্ম হয়েছিল। তাঁর মা ছিলেন কুমারী ম্যারি এবং পালক পিতা সাধু যোসেফ।

পবিত্র আত্মার প্রভাবে ম্যারি গর্ভবতী হয়েছিলেন। যিশুখ্রিষ্টের জন্ম এক অলৌকিক ঘটনা। ঈশ্বরের পরিকল্পনার অংশ, মানব মুক্তির লক্ষ্যে ছিল এই পরিকল্পনা।

যিশু পৃথিবীতে বেঁচে ছিলেন মাত্র ৩৩ বছর। এই ৩৩ বছরের মধ্যে মূলত তাঁর তিন বছরের কার্যক্রমই মানুষকে প্রভাবিত করেছে, মুক্তির দিশা দেখিয়েছে।

আরও পড়ুন >>> অসাম্প্রদায়িক জাতির দেশ 

তিনি মানুষকে শিক্ষা দিতেন উপমার মাধ্যমে। তিনি তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় যে কুসংস্কার, অন্যায়, অবিচার এবং অন্যায্যতা ছিল তা পরিবর্তন বা সংস্কারের জন্য মানুষকে উপদেশ, শিক্ষা বা ধারণা দিতে চেষ্টা করেছেন। প্রচলিত ও পশ্চাৎপদ সমাজের বিরুদ্ধে সংস্কারের কথা তিনি বলেছেন সব সময়।

যিশুখ্রিষ্টের শিক্ষার মধ্যে অন্যতম ছিল ক্ষমা। তিনি বলেছেন, কেউ যদি তোমার এক গালে থাপ্পড় মারে তাহলে অন্য গালটিও দিও। ভালোবাসার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন প্রতিবেশীকে তুমি নিজের মতো ভালোবেসো।

অন্নহীনকে অন্ন, বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দিও। পরস্পর পরস্পরকে ভালোবেসো। প্রচলিত সমাজব্যবস্থা এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কথা বলার কারণে শাসক এবং ভণ্ড যাজক সমাজ তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ ও অভিযোগ এনে ষড়যন্ত্র করে তাঁকে হত্যা করেছে।

আরও পড়ুন >>> বঙ্গবন্ধু ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি 

ক্রুশবিদ্ধ করে নির্মমভাবে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। শারীরিকভাবে তাঁকে হত্যা করলেও তাঁর আদর্শ ষড়যন্ত্রকারীরা হত্যা করতে পারেনি। যুগে যুগে তাঁর আদর্শ বহমান। সারা বিশ্বের ৩৩ শতাংশ মানুষ তাঁকে অনুসরণ করছে।

তিনি মানুষকে শিক্ষা দিতেন উপমার মাধ্যমে। তিনি তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় যে কুসংস্কার, অন্যায়, অবিচার এবং অন্যায্যতা ছিল তা পরিবর্তন বা সংস্কারের জন্য মানুষকে উপদেশ, শিক্ষা বা ধারণা দিতে চেষ্টা করেছেন।

সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশও বড়দিন যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। এক মাসব্যাপী চলেছে আগমন কাল। এই সময়ে  খ্রিষ্টানরা বাহ্যিক এবং আধ্যাত্মিকভাবে প্রস্তুতি নিয়েছে যিশুখ্রিষ্টের আগমন উপলক্ষে।

আজ ২৫ ডিসেম্বর উৎসব পালনের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি হবে বড়দিনের। শুরু হবে নববর্ষ উদযাপনের পালা। নববর্ষকে অনেকে বলেন 'ছোট দিন'। এই দিনটি বিশেষ প্রার্থনা এবং নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালিত হয়ে থাকে।

এই বছর বড়দিন উপলক্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমপি মহোদয় ২১ ডিসেম্বর খ্রিষ্টান সমাজের নেতবৃন্দের সাথে ভার্চুয়ালি শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন।

আরও পড়ুন >>> অসাম্প্রদায়িক মানবিক বঙ্গবন্ধু 

২৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতির সাথে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিগণ শুভেচ্ছা বিনিময় করবেন। আর সবকিছুই একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র চেতনার বহিঃপ্রকাশ। এখানে সব ধর্মের মানুষ তাঁর ধর্ম যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের সুযোগ লাভ করে থাকেন। রাষ্ট্র তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে। এটাই স্বাধীন বাংলাদেশের চেতনাবোধ।

বড়দিন আমাদের জীবনের প্রতিশ্রুতি নবায়নের দিন। সমাজ এবং দেশকে এগিয়ে নেওয়ার প্রেরণা লাভের দিন। যিশুখ্রিষ্টের আদর্শ লালন করে সম্প্রতিপূর্ণ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ের দিন বড়দিন। বড়দিন সবার জীবনে বয়ে আনুক সুখ, সমৃদ্ধি ও আনন্দ।

নির্মল রোজারিও ।। সভাপতি, বাংলাদেশ খ্রিষ্টান অ্যাসোসিয়েশন