বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে শুধু নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা যায় না। কারণ ১৯৪৭-এ দেশ বিভাগের পরপরই পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা বুঝে গিয়েছিলেন যে, পূর্ববঙ্গের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নানারকম লড়াই অবশ্যম্ভাবী। কাজেই পূর্ব পাকিস্তানকে বাংলাদেশে নিয়ে আসতে ২৪ বছর লেগেছে। ঠিক একইভাবে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে যদি কেউ হিসাব করতে বসেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বুদ্ধিজীবীরা নয় মাসে কি অবদান রেখেছেন, তবে সেই হিসাব মিলবে না। সাংবাদিক থেকে শুরু করে আরও অনেককে এরকম প্রশ্ন করতে শুনেছি। শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর ৯৬তম জন্মদিনে তাই সেই হিসাব মেলানোর একটি পথ বাতলে দেওয়ার চেষ্টা করছি।

শৈশব থেকেই পারিবারিক পরিমণ্ডলে মুনীর চৌধুরী যেমন পেয়েছিলেন কঠোর শাসন ও নিয়মানুবর্তিতা, তেমনি পেয়েছিলেন সাধারণ জ্ঞান, বিজ্ঞান, সাহিত্য পাঠ চর্চার সুযোগ ও আগ্রহ সৃষ্টির অনুপ্রেরণা। অবশ্যই এর পেছনে তার বাবা খান বাহাদুর আব্দুল হালিম চৌধুরীর সবচেয়ে বেশি অবদান—মুনীর চৌধুরী ও তার সকল ভাই বোনদের জন্যই। এভাবে ধীরে ধীরে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতে ঢুকতে না ঢুকতেই মুনীর চৌধুরী হয়ে উঠেছিলেন দেশি-বিদেশি সাহিত্য পিপাসু। এর পাশাপাশি পেয়েছিলেন সরদার ফজলুল করিম, মদন বসাক, দেব প্রসাদ, রবি গুহ প্রমুখ বেশ কয়েকজন বাম চিন্তাধারার ছাত্রদের সংস্পর্শ।

মানবতাবাদ, অসাম্প্রদায়িকতা, বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, স্বাধিকার আন্দোলন—এ সবকিছুর পাঠ মুনীর চৌধুরীর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত অবস্থাতেই যার সূচনা। অসাম্প্রদায়িক মানবতাবোধ হয়ে উঠেছিল মুনীর চৌধুরীর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর কিছু উদাহারণ এখানে উল্লেখ করছি মাত্র।

বাংলাসহ সারা ভারতবর্ষে যখন হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ছে, সেই ১৯৪৬-৪৭ সালে তরুণ মুনীর চৌধুরী সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী কর্মকাণ্ডে সরাসরি জড়িত হয়ে পড়লেন। ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে এসেছেন বিপদে পড়া মানুষদের সাহায্য করতে।

স্বভাবতই সেই সময়ে তার উল্লেখযোগ্য অবদান ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে কারাগারে বসে ১৯৫৩ সালে লিখিত বাংলাদেশের প্রথম রাজনৈতিক নাটক ‘কবর’।

আবার ছাত্রাবস্থায় অসাম্প্রদায়িক চিন্তা ভাবনার জন্য কট্টর ইসলামপন্থী ছাত্ররা মুনীর চৌধুরীকে একসময় বই, বিছানাপত্রসহ হল থেকে বের করে দেয়, যদিও পরবর্তীতে কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে তিনি আবার ফেরত আসতে পেরেছিলেন। এসব অভিজ্ঞতার আলোকে কাছাকাছি সময়ে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মানবতাবোধ তুলে ধরে মুনীর চৌধুরী লিখেছিলেন একাঙ্কিকা নাটক ‘মানুষ’, ‘মিলিটারি’ ও ‘একটি মশা’। শুধু নাটক নয়, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও অপব্যাখ্যাকে কটাক্ষ করে ছোট গল্প লিখেছিলেন ‘একটি তালাকের কাহিনী’ ও ‘মানুষের জন্য’।

দেশ বিভাগের পরে অর্থাৎ পঞ্চাশের দশকে পাকিস্তানি শোষণ তথা সাম্প্রদায়িকতার প্রতি বিদ্রূপ করে মুনীর চৌধুরী যেমন সৃজনশীলভাবে তখনকার বাঙালি জাতীয়তাবাদের আন্দোলনে সামিল হয়েছেন, তেমনি তার সহজাত বাগ্মিতার বলে বিভিন্ন মহলে অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করে গেছেন।

স্বভাবতই সেই সময়ে তার উল্লেখযোগ্য অবদান ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে কারাগারে বসে ১৯৫৩ সালে লিখিত বাংলাদেশের প্রথম রাজনৈতিক নাটক ‘কবর’। কিন্তু একজন ভাষা সৈনিক হিসেবে মুনীর চৌধুরীর তৎপরতা, পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের রোষানলের কারণে বারংবার কারাবরণের বিশ্লেষণ—কবর নাটকের আলোচনার ব্যাপ্তির অন্তরালে থেকে গেছে।

সেই ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে প্রথম ছাত্রসভা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেখানে বক্তব্য রাখেন তখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মুনীর চৌধুরী। অসাম্প্রদায়িক বাঙালি চেতনা ও বাংলা ভাষা নিয়ে সাহিত্যকর্ম, গবেষণা ও বিশ্লেষণ থেকে তিনি কখনই সরে আসেননি।

যে কারণে বারবার পাকিস্তানের রক্তচক্ষু তাকে হয় শাসানি দিয়েছে, নয়তো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফরেন সার্ভিসে চাকরির প্রলোভন দেখিয়েছে। সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে সরে আসার অল্প কিছুদিন পর, সক্রিয় বাম রাজনীতি ও বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবি আদায়ে কাজ করার জন্য মুনীর চৌধুরীকে পাকিস্তান সরকার ১৯৪৯ সালে কয়েক মাসের জন্য কারাগারে আটকে রাখে।

কিন্তু ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের সংগঠিত করার অপরাধে পাকিস্তান সরকার আরও কঠোরভাবে মুনীর চৌধুরী ও অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের দমন করার চেষ্টা করে। ২৩ ফেব্রুয়ারি বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ ভবনের পূব দিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কমন রুমের উল্টো দিকের একটি বড় হল ঘরে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। হলরুম ভরা শিক্ষকরা ছিলেন। সেখানে যারা আয়োজক ছিলেন এবং জোরালো বক্তব্য দিয়েছিলেন, মুনীর চৌধুরী ও মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী তাদের মধ্যে অন্যতম। পরদিনই জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয় মুনীর চৌধুরীসহ অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ, অধ্যাপক পৃথ্বিশ চক্রবর্তী ও অধ্যাপক অজিতকুমার গুহ।

পাকিস্তান বিরোধী অবস্থান থেকে শুধু ‘কবর’ নাটক নয়, মুনীর চৌধুরী ১৯৫০ সালে লিখেছিলেন নাটক ‘নষ্ট ছেলে’। নাটকে একটি পরিবারের মেয়ে যে বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িত, তাকে ঘিরেই নাটকের কাহিনি আবর্তিত।

উল্লেখযোগ্য, সেই একই সময় একই আইনের আওতায় গ্রেফতার ও কারাবরণের শিকার হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, মাওলানা ভাসানী, মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশসহ অনেক রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী। রাজবন্দী হিসেবে রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের সাথে বুদ্ধিজীবীদের অন্তরীণ অবস্থার যোগাযোগ, উভয়পক্ষকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যার যার অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখার ব্যাপারে কৌশল ও পরিকল্পনা গ্রহণ করতে সাহায্য করেছে। যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এলে এরা সকলে মুক্তি পান। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও এই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের বিবরণ আছে।

পাকিস্তান বিরোধী অবস্থান থেকে শুধু ‘কবর’ নাটক নয়, মুনীর চৌধুরী ১৯৫০ সালে লিখেছিলেন নাটক ‘নষ্ট ছেলে’। নাটকে একটি পরিবারের মেয়ে যে বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িত, তাকে ঘিরেই নাটকের কাহিনি আবর্তিত। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে গিয়েও পারে না।

আবার ‘কবর’ নাটকে পাকিস্তানি রাজনৈতিক নেতার যে স্বরূপ উন্মোচন করেছেন, তারই আরও খোলস ছাড়িয়েছেন ‘নেতা’ একাঙ্ক নাটকটিতে। মূলত ১৯৫৩ সালে পাকিস্তানের মুসলিম লীগের দুই পক্ষের সংঘাত ও জনগণ বিচ্ছিন্নতা এই বিদ্রূপাত্মক নাটকের উপজীব্য। পরাধীন বাংলাদেশে শাসক নেতাদের প্রতি এই ধরনের বক্রোক্তি করার সৎ সাহস মুনীর চৌধুরী পেয়েছেন তার সূক্ষ্ম রসবোধের সাথে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি অবিচল থাকার মিশেলে।

হয়তো মুনীর চৌধুরীর নাটক ও গল্প ছাপিয়ে গেছে বাংলা ভাষার উৎকর্ষ সাধন এবং একটি অসাম্প্রদায়িক বাঙালি সংস্কৃতি গড়ে তোলার নিরন্তর প্রয়াস পাকিস্তান ও পাকিস্তানপন্থী ধর্মীয়, প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীকে সবচেয়ে বেশি রাগান্বিত করেছিল আর দুশ্চিন্তায় ফেলেছিল। এই প্রচেষ্টা প্রতিভাধর মুনীর চৌধুরীর জন্য ছিল নানামুখী। যেমন ১৯৫৮ সালে পূর্ববঙ্গ সরকারের ভাষা সংস্কার কমিটির রিপোর্টের বস্তুনিষ্ঠ ও তীক্ষ্ণ সমালোচনা, ১৯৬৭-৬৮ সালে বাংলা বর্ণমালা ও বানান পদ্ধতি উর্দু ও রোমান হরফে পরিবর্তনের প্রতিবেদনের বিরোধিতা, ১৯৬৫ সালে বাংলা টাইপরাইটারের কী-বোর্ড তৈরি এবং বাংলা ভাষাতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা উল্লেখযোগ্য।

কাজেই মুনীর চৌধুরীর পাণ্ডিত্য, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, সৃষ্টিশীলতা, গভীর বিশ্লেষণ ক্ষমতা, সূক্ষ্ম রসবোধ ও রুচিবোধ—এ সবকিছুর বিবর্তন ও সমন্বয়ে শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতির জন্য মাত্র ২৬ বছরে অগাধ সম্পদ রেখে গেছেন।

১৯৭১ সালেও তার বেশকিছু অনুবাদ, গল্প, প্রবন্ধ অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। স্বাভাবিক জীবন যদি তিনি পেতেন, অন্তত ২৫-৩০ বছরে আমাদেরকে আরও কত সমৃদ্ধ করতেন তা কি আসলেই ধারণা করা যায়?

আসিফ মুনীর ।। শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর সন্তান; মানবাধিকার ও উন্নয়নকর্মী