তোরা যে যা বলিস ভাই আমার সোনার হরিণ চাই। সোনার হরিণ মানেই সরকারি চাকরি। একবার ধরতে পারলেই নিশ্চিন্ত ভবিষ্যৎ। এই করোনাকালে সবচেয়ে নির্ভার জীবন-যাপন করেছেন সরকারি চাকরিজীবীরা। করোনার শুরুর দিকে অফিসে যেতে হয়নি। কিন্তু বেতন-ভাতা পেতে মোটেও কষ্ট হয়নি। মাসের নির্ধারিত তারিখেই বেতন-ভাতা মিলেছে। বেসরকারি পর্যায়ের চাকরিজীবীরা অনেকেই এখনও করোনার ধাক্কা সামলাতে পারেননি। ফলে বেতন-ভাতার ক্ষেত্রেও অনিশ্চয়তা কাটেনি। সরকারি চাকরিজীবীরা এক্ষেত্রে বেশ ভাগ্যবান।

সরকারি চাকরিতে একবার ঢুকতে পারলেই ভবিষ্যৎ ঝরঝরা। প্রতিমাসের বেতন নিয়ে চিন্তা নেই। বছর শেষে নিয়মমাফিক ইনক্রিমেন্ট, গ্র্যাচুয়িটি এবং অবসর নেওয়ার পর আমৃত্যু পেনশন পেতেও কোনো ঝামেলা নেই। স্বামীর মৃত্যু হলে তার বৈধ স্ত্রী আমৃত্যু মাসে মাসে স্বামীর পেনশনের টাকা পান। আর সরকারি চাকরিজীবী স্ত্রীর মৃত্যু হলে তার বৈধ স্বামী আমৃত্যু পেনশনের টাকা পাবেন, এটাই নিয়ম। অর্থাৎ পেনশনের কারণে সরকারের সঙ্গে নির্ধারিত কর্মকর্তা-কর্মচারীর আমৃত্যু একটা সম্পর্ক থেকেই যায়। এজন্যই সরকারি চাকরিবিধির আইনে উল্লেখ আছে, কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী অবসরে যাওয়ার পর গুরুতর কোনো অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত হলে অথবা মারাত্মক কোনো অপরাধে জড়িয়ে পড়লে, প্রমাণ সাপেক্ষে তার অবসর সুবিধার আংশিক অথবা সম্পূর্ণ অংশ বাতিল করা যাবে।

যেহেতু তারা সরকারি অর্থ গ্রহণ করেন, কাজেই তাদের ওপর সরকারের নজরদারি থাকা যৌক্তিক সিদ্ধান্ত। যাতে তারা কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে না জড়ান।

উদ্বেগজনক খবর হলো, সরকারি চাকরিবিধির এই ধারাটি বদলে যাচ্ছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এ ব্যাপারে একটি নতুন প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে। এই প্রস্তাবের মূলকথা হলো, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অবসরের পর মারাত্মক কোনো অপরাধ করলেও তাদের পেনশন বাতিল বা কর্তন করা যাবে না। এ নিয়ে স্বয়ং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়েই মিশ্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে।

বিষয়টি প্রস্তাব আকারে চূড়ান্ত করা হলেও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সিদ্ধান্ত ছাড়া কার্যকর হবে না। কাজেই আগাম এ ব্যাপারে মন্তব্য করা সমীচীন নয়। তবে যেহেতু প্রস্তাবটি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে, কাজেই বিষয়টি আলোচনারও দাবি রাখে।

বিদ্যমান আইনে আছে, অবসরের পর পেনশনভোগী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী অপরাধ করলে তদন্ত সাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে নির্ধারিত দফতর ব্যবস্থা নিতে পারবে। আইনটি কি খুবই অযৌক্তিক? অবসর গ্রহণ করা সত্ত্বেও পেনশনভোগী একজন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী বলতে গেলে সরকারের নির্ধারিত দফতর বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত থাকেন। কাজেই তিনি যদি কোনো অন্যায় করেন, তার দায়ভারও অনেকটা নির্ধারিত দফতর বা প্রতিষ্ঠানের ওপরেই বর্তায়। এক্ষেত্রে একটা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকা জরুরি। আইনের উপধারাটি বাতিলের সুপারিশ উঠাতে খোদ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়েই ব্যাপক প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে গণমাধ্যমে জেনেছি।

মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট অনেকের মন্তব্য, উপধারাটি বাতিল হলে দুই বছর আগে প্রণীত সরকারি কর্মচারী আইনটি অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়বে। যেহেতু তারা সরকারি অর্থ গ্রহণ করেন, কাজেই তাদের ওপর সরকারের নজরদারি থাকা যৌক্তিক সিদ্ধান্ত। যাতে তারা কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে না জড়ান।
অনেকে হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন, অপরাধ কি শুধু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই করেন, আর কেউ করেন না? বেসরকারি পর্যায়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও অপরাধ করেন। কিন্তু বেসরকারি পর্যায়ে অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে আইনের কোনো ধারা, উপধারা প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় না। তাহলে সরকারি ক্ষেত্রে নতুন নিয়ম হবে কেন?

সরকারি পর্যায়ে আইনের উপধারাটি শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত হলে মারাত্মক অপরাধ করা সত্ত্বেও অবসরপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর পেনশন নির্ধারিত দফতর অথবা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বাতিল বা কর্তন করার কোনো অধিকার থাকবে না। ফলে একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়ার আশঙ্কা দেখা দেবে। যার দায়ভার পড়বে শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রের ওপর। কাজেই এক্ষেত্রে অবশ্যই একটি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অথবা সতর্কতা সংকেত থাকা জরুরি।

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া, জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় এই সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘অবসরের পর অপরাধ করলেও পেনশন বাতিল বা কর্তন করা যাবে না। এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলে নতুন করে কিছু সমস্যার সৃষ্টি হবে। একজন ব্যক্তি অবসরে যাওয়ার পর যদি ধর্ষণ, হত্যাকাণ্ডসহ এ জাতীয় মারাত্মক কোনো অপরাধে যুক্ত হন, তার অবসর সুবিধা রাখতে হবে কোন যুক্তিতে?’

বেসরকারি পর্যায়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও অপরাধ করেন। কিন্তু বেসরকারি পর্যায়ে অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে আইনের কোনো ধারা, উপধারা প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় না। তাহলে সরকারি ক্ষেত্রে নতুন নিয়ম হবে কেন?

ফিরোজ মিয়ার এই বক্তব্য বিশেষভাবে গুরুত্বের দাবি রাখে। যতদিন আপনি পেনশন গ্রহণ করবেন এক অর্থে ততদিনই আপনি সরকারি কর্মচারী। মাসে মাসে সরকারের অর্থ গ্রহণ করবেন অথচ অপরাধ করার পরও অর্থ পেতেই থাকবেন, তা তো হয় না। বরং বিদ্যমান আইনটি সম্পূর্ণ বহাল রাখাই হবে শ্রেয়। এর ফলে পেনশন বাতিল অথবা কর্তনের ভয়ে কেউ সহজে অন্যায় কাজে জড়িত হওয়ার সাহস করবেন না।

একটি সুশৃঙ্খল পরিবেশে মানুষের জীবনমানের উন্নয়নের জন্যই দেশে দেশে আইন প্রণয়ন করা হয়। সেক্ষেত্রে আইনের সঠিক প্রয়োগটাই হলো আসল কথা। কোন দৃষ্টিকোণ থেকে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশন সংক্রান্ত আইনের উপধারা সংশোধনের প্রস্তাব উঠেছে, সেটা স্পষ্ট নয়। তবে গণমাধ্যমের বরাতে জানলাম, অবসর গ্রহণের পর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যেহেতু আর সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর অথবা প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকেন না, কাজেই কোনোভাবেই পেনশন কর্তন বা বাতিলের এখতিয়ারও সংশ্লিষ্ট দফতরের থাকা উচিত নয়।

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতি যথাযথ সম্মান রেখেই বলছি, পেনশনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আইনের এই উপধারা পরিবর্তন করা ঠিক হবে না। বরং পেনশনভোগী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর নিরাপত্তা ও সুরক্ষা কীভাবে আরও নিশ্চিত করা যায়, সে ব্যাপারে আইনের নতুন উপধারা তৈরি করা যেতে পারে।
স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন। অবসরে যাওয়ার পর আমি স্বাধীন হতে চাই। কোনোভাবেই কারও নিয়ন্ত্রণ চাই না। এই ধারণা থেকে যদি আইনের নতুন উপধারা তৈরি করা হয়ে থাকে, তাহলে এক অর্থে সেটা হবে ভুল পদক্ষেপ। স্বাধীনতার জন্য আজ যারা অবসরের পর আর কোনো নিয়ন্ত্রণ চাইছেন না, আমার ধারণা তারাই একদিন নিয়ন্ত্রণের জন্য নতুন দাবি তুলবেন।

রেজানুর রহমান ।। কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার, সম্পাদক, আনন্দ আলো