ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশে শিক্ষার তিনটি ধারা। অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং আনুষ্ঠানিক শিক্ষা। এসব ধারা আবার বিভিন্নভাগে বিভক্ত। বিভক্ত শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীদের বিভিন্নভাবে পড়ানো হয়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সব শ্রেণিতে একমুখী শিক্ষা চালু করতে যাচ্ছে। যদিও অনেকদিন ধরে একমুখী শিক্ষার কথা বলছিলেন শিক্ষানুরাগীরা। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) নতুন সিলেবাস প্রণয়ন, বইয়ের অবকাঠামো তৈরি ও শিক্ষা সংস্কার নিয়ে কাজ করছে। প্রশ্ন হলো, একমুখী শিক্ষা এখন কেন জরুরি হলো?

একমুখী শিক্ষা দ্বারা আমরা বুঝেছিলাম দেশে বিদ্যমান বিভিন্ন ধারা যেমন মাদ্রাসা, বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমের যেই ব্যবধান তা কমিয়ে আনা। সরকার কী বুঝলো আর কী করল? তারা একমুখী শিক্ষার নামে মাধ্যমিক শ্রেণি থেকে বিজ্ঞান, কলা, ব্যবসায় বিভাজন উঠিয়ে দিয়ে একে একমুখী শিক্ষা নামে চালিয়ে দিল। অথচ আমরা বলেছিলাম ব্যবধান কমানোর কথা।

আরও পড়ুন >>> নতুন শিক্ষাক্রমের সমস্যা কোথায়? 

এটা আদতে কোনো সুফল দেবে না। বিভাজন উঠিয়ে দিয়ে প্রথমত মূল ধারার নবম ও দশম শ্রেণি থেকে উচ্চতর গণিত উঠিয়ে দিতে হলো বা উঠিয়ে দিতে হবে।

দ্বিতীয়ত, বিজ্ঞানের ৩টি প্রাথমিক বিষয় যেমন পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান একত্রিত করে বিজ্ঞান নামে একটি বিষয় পড়ানো হবে। কারণ সবাইকে এক নৌকায় আনতে হলে বিজ্ঞানকে ছাড় দিতে হবে এবং কলা-ব্যবসাকে একটু বেশি পড়তে হবে।

মূল ধারার শিক্ষাতো সুদূরপ্রসারী হবে যার ফল আসতে সময় লাগবে। কারিগরি শিক্ষার উদ্দেশ্য থাকবে স্বল্পমেয়াদি ফল পাওয়া।

যারা গণিতের ভয়ে কলা কিংবা ব্যবসা নিয়ে বিজ্ঞান একটু কম পড়তো তারা এখন বিজ্ঞান পড়বে। আর যারা আগে বিজ্ঞানে উচ্চতর গণিত পড়তো তার পরিবর্তে এখন কিছু কলা, ব্যবসার বিষয় পড়বে। এতে কী হলো?

এক গ্রুপকে নিচে নামতে হলো আর বাকিদের কিছুটা উপরে উঠিয়ে একটা গড় জাতি গঠনের ব্যবস্থা করা হলো। এর সাথে কিছু কারিগরি শিক্ষা যেমন ভালো থাকা, প্রযুক্তি ইত্যাদি ঢুকিয়ে দিয়ে সেই গড় মানকে আরেকটু নামিয়ে আনা হলো। বুঝতে পারছেন কি সাংঘাতিক ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছে?

আরও পড়ুন >>> জিপিএ-৫ তৈরির কারখানা! 

ইংরেজি মাধ্যমের নবম ও দশম শ্রেণির পদার্থবিজ্ঞান বইটি দেখছিলাম। কী সুন্দর বই। সেখানে ফোর্স ও মোশন নামে একটি সেকশন, ওয়েভস নামে একটি সেকশন, এনার্জি রিসোর্স ও এনার্জি ট্রান্সফার নামে একটি সেকশন, সলিড-লিকুইড ও গ্যাসেস নামে একটি সেকশন, ম্যাগনেটিজম ও ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিজম নামে একটি সেকশন, রেডিওঅ্যাক্টিভিটি ও পার্টিকেলস নামে একটি সেকশন এবং অ্যাস্ট্রোফিজিক্স নামে একটি সেকশন আছে। কী অসাধারণ!

এখন নতুন কনডেন্সড বিজ্ঞান বইতে কি এইসব থাকবে? উত্তর হলো সম্ভব না। একই কথা জীববিজ্ঞান ও রসায়নের ক্ষেত্রে বলা যায়। বিজ্ঞান, কলা ও ব্যবসাকে একমুখী করার অর্থ বুঝতে পারছেন? আর এটা করতে গিয়ে বিজ্ঞানের আগে প্রযুক্তিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

প্রযুক্তিকে এমনভাবে দেওয়া হবে যেন সবার জন্য হয়। আর সাথে এক চিমটি কারিগরি বিদ্যা ঢুকিয়ে দেওয়া হলো যাতে কেউ যদি এসএসসির পর আর নাও পড়ে সে যেন এসএসসি শেষে কিছু করে খেতে পারে।

আরও পড়ুন : সৃজনশীল ও শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষাব্যবস্থা কেন জরুরি?

মূল ধারার শিক্ষাতো সুদূরপ্রসারী হবে যার ফল আসতে সময় লাগবে। কারিগরি শিক্ষার উদ্দেশ্য থাকবে স্বল্পমেয়াদি ফল পাওয়া। ১০০ বছরে জ্ঞানের বিস্ফোরণ ঘটেছে। জ্ঞান বিজ্ঞান এখন অনেক এগিয়েছে।

এখন বিজ্ঞানে নতুন কিছু আবিষ্কার করতে হলে আগের শিক্ষার্থীদের চেয়ে নতুন শিক্ষার্থীদের আরও বেশি জানতে হবে। অথচ আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের আরও কম জানার ব্যবস্থা করছি...

এখন বিজ্ঞানে নতুন কিছু আবিষ্কার করতে হলে আগের শিক্ষার্থীদের চেয়ে নতুন শিক্ষার্থীদের আরও বেশি জানতে হবে। অথচ আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের আরও কম জানার ব্যবস্থা করছি। এই কম জেনে, কম শিখে এরা আমলা-কামলা হতে পারবে কিন্তু বড় বিজ্ঞানী বা বড় প্রযুক্তিবিদ হতে পারবে না।

প্রযুক্তিবিদ হতে হলে আগে বিজ্ঞান শিখতে হবে তারপর প্রযুক্তি শিখবে। এই দুটো পরিবর্তনযোগ্য না। অর্থাৎ আগেরটা পরে আর পরেরটা আগে করলে এক না।

আরও পড়ুন >>> শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন : বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ 

একমুখী এই গোঁজামিল শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে আমরা ইংরেজি ও বাংলা মাধ্যমের ব্যবধান আরও বাড়িয়ে দেব। ব্রিটিশরা কি আমাদের চেয়ে কম বুঝতো? তারাতো একমুখীর নামে সবাইকে একই বিষয় বাধ্যতামূলক পড়াচ্ছে না। তাদের নবম দশম শ্রেণিতে বিভাজন নেই?

তারা সবাইকে সব বিষয় পড়তে বাধ্য করার বদলে সব উন্মুক্ত করে দিয়েছে। যে যার পছন্দমতো বিষয় পড়ছে। আমরা কেন সেটা করলাম না? কারণ আমাদের উদ্দেশ্য ধনী গরিবের ব্যবধান বাড়ানো, আমাদের উদ্দেশ্য (জেনে হউক না জেনে হউক) ভোক্তার বাজারে পরিণত হওয়া।

আজ হোক কাল হোক, এই শিক্ষাক্রম বন্ধ করতেই হবে। তবে আজকে বন্ধ করতে বাধ্য করতে পারলে দেশের জন্য সবচেয়ে মঙ্গলজনক হতো। একেকটা দিন যোগ হওয়া মানে ক্ষতির পাল্লা ভারি হওয়া।

একদিন এত ভারি হয়ে যাবে যে সেখান থেকে জাতিকে তুলতে আমাদের অনেক মাশুল গুনতে হবে। তাই দেরি হওয়ার আগেই এটা বন্ধ করা জরুরি।

ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়