ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশে ধনী মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। স্বাধীনতার পর থেকে দেশে হু হু করে বেড়েছে। সমাজে বৈষম্য তৈরি না হলে দেশে ধনী মানুষের সংখ্যা বাড়া ইতিবাচক। কারণ এতে বেসরকারি পর্যায়ে শিল্প কারখানাসহ নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়। দেশের অর্থনীতিতেও বড় অবদান রাখেন আমাদের শিল্পপতি, ব্যবসায়ীরা।

বিপত্তি অন্য জায়গায়, ইদানীং বাংলাদেশিদের নাম উঠছে অন্য দেশের ধনীর তালিকায়। যারা বাংলাদেশের আলো-বাতাসে বড় হয়েছেন। দেশে সুযোগ সুবিধা পেয়ে বিপুল সম্পদের মালিক বনেছেন তাদের নাম ভিন দেশে বিনিয়োগ করে ধনীর তালিকায় উঠেছে।

মানি লন্ডারিং আইনে, বাংলাদেশিদের বিদেশে বিনিয়োগের তেমন একটা সুযোগ নেই। উপায় থাকে আমদানি রপ্তানির আড়ালে অবৈধভাবে ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থপাচারের। অন্যথায় হুন্ডি। এই দুই পন্থায় মূলত বিদেশে অর্থপাচার হয়।

আরও পড়ুন >>> বৈশ্বিক সংকট : দরকার মুদ্রানীতি ও বাজেটের যথাযথ সমন্বয় 

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) ২০২০ সালে যে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে তাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়।

আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, দেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হলেও এসব অর্থ ফেরত আসেনি, আসছে না। বলাবাহুল্য দেশে অর্থপাচারের তদন্তকারী সংস্থা রয়েছে কয়েকটি কিন্তু পাচারকারীদের আইনের আওতায় আনতে পারেননি বলা যায়। 

বিদেশে যারা টাকা পাচার করেছেন তাদের শনাক্ত করা কি খুব কঠিন? নাকি স্বদিচ্ছার অভাব? কয়েকবছরে দেশের গণমাধ্যমগুলো বেশকয়েজন পাচারকারীর সম্পদের তথ্য দিয়ে সংবাদ প্রচার-প্রকাশ করেছে....

মানি লন্ডারিং আইনে দুদক, এনবিআরসহ তদন্তকারী সংস্থাগুলো বছরে কয়েকটি মামলা করলেও পাচারের অর্থ ফেরত আনার কোনো উদ্যোগ দৃশ্যত চোখে পড়ে না।

সরকার যদিও পাচারের অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে বড় ছাড় দিয়েছে কিন্তু পাচারকারীরা এটা পাত্তা দিচ্ছে না। কারণ, তারা হয়তো ভেবেছে, ‘দেশের টাকা বিদেশে পার করে বহাল তবিয়তেই তো আছি।’

আরও পড়ুন >>> আইএমএফের ঋণ : ইতিহাস যা বলে 

আমাদের তদন্তকারী সংস্থাগুলোর সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা পাচারকারীদের তারা চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে পারছেন না। তদন্তকারী সংস্থাগুলোও সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারবে না যে, তাদের মামলায় বিদেশে টাকা পাচারের দায়ে জেলখানায় কতজন আছেন? আদালতের মাধ্যমে শাস্তি পেয়েছেনই বা কতজন?

বিদেশে যারা টাকা পাচার করেছেন তাদের শনাক্ত করা কি খুব কঠিন? নাকি স্বদিচ্ছার অভাব? কয়েকবছরে দেশের গণমাধ্যমগুলো বেশকয়েজন পাচারকারীর সম্পদের তথ্য দিয়ে সংবাদ প্রচার-প্রকাশ করেছে। এসব তালিকায় বাংলাদেশের এমপি, আমলা, ব্যাংক মালিক, ব্যবসায়ীদের নাম ছিল। অথচ তদন্তকারী সংস্থাগুলো তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

অর্থপাচার নিয়ে মোটাদাগে এতবার বলার কারণ হচ্ছে, কয়েকমাস ধরে দেশের অর্থনীতির অবস্থা চরম খারাপ গেছে। সরকারের পক্ষ থেকেই তা বলা হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব কিংবা দেশের রিজার্ভের কমতি যাই বলি না কেন, আর্থিকভাবে ভালো যায়নি বাংলাদেশের।

নানাভাবে কৃচ্ছ্রতা সাধনের নানা কৌশলও নিয়েছে সরকার। দেশ চালানোর জন্য আমাদের বড় অংকের ঋণের প্রয়োজন সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। শেষমেশ আইএমএফের কাছে ধার চেয়েছি।

অবশেষে নানা কঠিন শর্তে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন দিয়েছে আইএমএফ। এরমধ্যে প্রথম কিস্তি পেয়েছে বাংলাদেশ। এতে রাষ্ট্র চালানোর যে অর্থ সংকট তা কিছুটা কাটানো যাবে মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। তবে এতে সাময়িকভাবে সংকটের সমাধান হলেও ঋণের বোঝা আরও ভারী হচ্ছে বাংলাদেশের। ফলে অর্থনীতির যে চরম সংকট তা সহজে কাটবে না।

আরও পড়ুন >>> অর্থনৈতিক মন্দার শিকড় কোথায়?

আইএমএফের ঋণ পেতে কম চেষ্টা করেনি সরকার। প্রশ্ন আসে, যে দেশ থেকে বছরেই ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়, সেই দেশকে কেন কঠিন শর্তে আইএমএফ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ নিতে হয়?

দেশে দুর্নীতির ব্যাপকতায় আন্দাজ করা যায়, আইএমএফের কাছ থেকে সরকার যে পরিমাণ ঋণ নিয়েছে তার বহুগুণ অর্থ এই দেশের 'দুর্নীতিবাজ'দের কাছে রয়েছে।

দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করলেও এসব অর্থ মূলত দেশের জনগণের। মানুষকে শোষণ করেই তারা অবৈধ সম্পদের মালিকানা অর্জন করেছেন।

দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত এসব অর্থ 'দুর্নীতিবাজ'রা কৌশলে বিদেশে পার করেন। আরামে থাকেন। বেগমদের নামে বাড়ি ফ্ল্যাট কেনেন ইউরোপ আমেরিকায়। দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের কিছুটা দেশে আবার ফেরত আসলে আইএমএফের ধরনা দিতে হতো না বাংলাদেশকে।

সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল-টিআই এর 'দুর্নীতির ধারণা সূচক' অনেকের চোখে পড়েছে। সূচকে ২০২২ সালে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ ১২তম হয়েছে। 

আইএমএফের ঋণ পেতে কম চেষ্টা করেনি সরকার। প্রশ্ন আসে, যে দেশ থেকে বছরেই ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়, সেই দেশকে কেন কঠিন শর্তে আইএমএফ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ নিতে হয়?

২০২১ সালে তালিকায় বাংলাদেশ ছিল ১৩তম। এবার হয়েছে ১২তম। অর্থাৎ দেশে দুর্নীতি ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে বেড়েছে। আমি মনে করি, টিআই-এর এই সূচক নিয়ে বিতর্ক না তুলে সরকার কিংবা দুদককে দুর্নীতির খাতগুলো চিহ্নিত করা উচিত।

সরকারি কোন কোন দপ্তরে দুর্নীতি হয় এটা সাধারণ মানুষও জানে। এসব দুর্নীতিতে কারা জড়িত তা রাষ্ট্রের তদন্তকারী সংস্থার খুঁজে বের করাও কঠিন নয়।

আমরা দেখেছি, শুনেছি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা দিয়েছেন। এই জিরো টলারেন্স বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্রের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা রয়েছে। তারা কতটা দুর্নীতি দমনে ভূমিকা রেখেছেন তা সহজে অনুমেয়।

আরও পড়ুন : সন্নিকটে সংকট, শঙ্কিত কি অর্থনীতি! 

সর্বশেষ আইএমএফও ঋণ দেওয়ার আগে দুর্নীতি কমানোর শর্ত দিয়েছে। দুদককে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়ার কথা বলেছে।

এটা দেশের সাধারণ মানুষও মনে করে যে, বড় বড় দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় আনতে পারলে দেশে দুর্নীতি কমবে; কিন্তু তা কবে কখন আনা হবে; আর জাতি কবেই বা দেখবে সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।

আদিত্য আরাফাত ।। বিশেষ প্রতিনিধি, ডিবিসি নিউজ