৫ আগস্ট ২০২২। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। প্রজ্ঞাপনে, বিশ্ববাজারের সঙ্গে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করতে ডিজেল ও কেরোসিনের লিটার ৮০ টাকা থেকে ১১৪ টাকা, পেট্রোলের লিটার ৮৬ টাকা থেকে ১৩০ টাকা, অকটেনের লিটার ৮৯ টাকা থেকে ১৩৫ টাকায় বর্ধিত নতুন মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ৬ আগস্ট ২০২২ থেকে বর্ধিত মূল্য কার্যকর হয়েছে।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে আমাদের দেশেও জ্বালানির মূল্য সমন্বয় না করলে অনেক ক্ষতি হয়ে যেত। তাছাড়া, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করার ফলে আমাদের জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করাও জরুরি হয়ে পড়েছিল। কেননা, আমাদের দেশে তেলের মূল্য কম থাকলে তা ভারতে পাচার হয়ে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা থেকেই যায়।

যতদিন সম্ভব ছিল ততদিন জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির করা হয়নি। বর্তমানে, সার্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকটা নিরুপায় হয়েই জ্বালানি তেলের মূল্য কিছুটা সমন্বয় করা হয়েছে। তবে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সেই অনুযায়ী জ্বালানি তেলের দাম পুনর্বিবেচনা করা হবে।

আরও পড়ুন : জ্বলছে জ্বালানি তেল 

বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা মহামারি দীর্ঘায়িত হওয়া, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সরবরাহ বিঘ্নিত ও বৈশ্বিক আর্থিক অস্থিতিশীলতার কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যে আস্ফালন ঘটেছে।

একই সাথে, মার্কিন ডলারের মানও টাকার তুলনায় ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই, উচ্চ মূল্যে জ্বালানি আমদানি করে তা পূর্বের মূল্যে বিক্রি করলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)-কে বিশাল অর্থের লোকসান গুনতে হয়।

জ্বালানি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বিপিসি গত ৬ মাসে জ্বালানি তেল বিক্রি করে লোকসান দিয়েছে ৮ হাজার ১৪ কোটি ৫১ লাখ টাকা। সেই কারণে, বিপিসির লোকসান ঠেকাতে মূল্য সমন্বয় অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। 

আইএমএফ থেকে ঋণ গৃহীত বেশিরভাগ দেশগুলোর অতীত অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়। ১৯৯৭ সালে পূর্ব এশিয়া সংকটের সময় আইএমএফ থেকে ঋণ নিয়েছিল ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া….

তবে, মূল্যস্ফীতির চরম আগ্রাসনে‌ জনজীবন যখন বিপর্যস্ত ঠিক তখনই, হুট করে জ্বালানি তেলের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি বিভিন্ন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে, আইএমএফের ঋণের শর্ত পূরণ করতেই সরকার জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করেছে কি না, তা নিয়ে জনগণের মনে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে!

আরও পড়ুন : সন্নিকটে সংকট, শঙ্কিত কি অর্থনীতি! 

কেননা, কৃষি, শিল্প ও সেবা, প্রতিটি খাতেরই মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে জ্বালানি। আর, জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতির দৌরাত্ম্যকে উসকে দিয়ে জনজীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তুলবে।

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৮৬ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। আমদানি ব্যয় পরিশোধের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে।

দেশে বর্তমানে মজুত আছে ৩ হাজার ৯৬৭ কোটি ৪২ লাখ ডলার। আবার, ডলারের সরবরাহ কমে যাওয়ায় ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যও ক্রমান্বয়ে অবনমন হচ্ছে। খোলাবাজারে ডলার বিক্রি হচ্ছে ১১২ টাকা দরে। আর, অর্থনীতির নীরব ঘাতক মূল্যস্ফীতির হার এখন ৭.৫৬ শতাংশ, যা নয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

আরও পড়ুন : পরিবহন নৈরাজ্য! 

তাই, অর্থনৈতিক সংকট আঁচ করে সাবধানতা হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর কাছে ঋণ চেয়ে আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। গণমাধ্যম সূত্র বলছে, চিঠিতে ঋণের পরিমাণের কথা উল্লেখ নেই। তবে বাংলাদেশ ৪.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ আশা করছে। মূলত লেনদেনের ভারসাম্য ঘাটতি মেটাতে এবং বাজেট সহায়তা হিসেবে ঋণ চাওয়া হয়েছে।

তাছাড়া, ৬ আগস্ট ২০২২ লোকাল গভর্নমেন্ট করোনা রেসপন্স অ্যান্ড রিকভারি প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্ব ব্যাংক একটি ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এই ঋণচুক্তি অনুযায়ী করোনাভাইরাস পরবর্তী সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশকে ৩০ কোটি ডলার ঋণ দিবে বিশ্বব্যাংক।

৫ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ৩০ বছরের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে। উত্তোলিত ঋণের ওপর বার্ষিক ০.৭৫ শতাংশ হারে সার্ভিস চার্জ এবং ১.২৫ শতাংশ হারে সুদ প্রদান করতে হবে।

প্রশ্ন হচ্ছে, আইএমএফের ঋণ আমাদের আতঙ্ক বাড়াবে, নাকি স্বস্তি দেবে? এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করছে সরকারের ঋণ ব্যবস্থাপনার দক্ষতার উপর।

সংকট থেকে উত্তরণের জন্য ঋণ নেওয়া যেতেই পারে! তবে, লক্ষ্য রাখতে হবে ঋণের শর্ত পূরণ করতে গিয়ে সংকট যেন আরও ঘনীভূত না হয়। আইএমএফ থেকে ঋণ গৃহীত বেশিরভাগ দেশগুলোর অতীত অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়।

আরও পড়ুন : টাকা পাচারকারীর তালিকাটা অন্তত মানুষ জানুক

১৯৯৭ সালে পূর্ব এশিয়া সংকটের সময় আইএমএফ থেকে ঋণ নিয়েছিল ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড। ঋণের শর্ত মানতে গিয়ে দেশগুলোতে অর্থনৈতিক মন্দা ও বেকারত্ব আরও তীব্রতর হয়েছিল।

২০০১ সালে আর্জেন্টিনাকে উদ্ধারেও ব্যর্থ হয় আইএমএফ। বাংলাদেশও ২০১২ সালে আইএমএফের কাছে থেকে ৯৮৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণ নিয়েছিল।

আইএমএফের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ হচ্ছে, শর্ত পূরণ করতে গিয়ে ঋণ গ্রহীতা দেশগুলো ঝামেলায় পড়ে ও তাদের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আইএমএফের সঙ্গে আমাদের ঋণ চুক্তির শর্ত সমূহ এখনো জনসম্মুখে প্রকাশ পায়নি। তথাপি অনুমেয় যে, আইএমএফের ঋণের শর্ত সমূহ প্রতিটি দেশের জন্য প্রায় একই। এর অনেকগুলোই অজনপ্রিয়।

আরও পড়ুন : গণপরিবহন কি জনভোগান্তির অপর নাম?

বিশেষ করে ভর্তুকি হ্রাস, কর মওকুফ সুবিধা প্রত্যাহার, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, সুদের হারের সীমানা তুলে দেওয়া, বিনিময় হারের নমনীয়তা ইত্যাদি। আর সেই কারণেই এটি মনে করা হচ্ছে যে, আইএমএফের ঋণের শর্ত পূরণ করতে গিয়েই সরকার জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি করেছে যাতে এই খাতে ভর্তুকির পরিমাণ হ্রাস করা যায়।

মুদ্রাস্ফীতির আস্ফালন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রা ও জ্বালানি তেলের মজুত হ্রাস, ইত্যাদি নিয়ে মানুষ আসলেই আতঙ্কে আছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আইএমএফের ঋণ আমাদের আতঙ্ক বাড়াবে, নাকি স্বস্তি দেবে? এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করছে সরকারের ঋণ ব্যবস্থাপনার দক্ষতার উপর।

সরকার যদি স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, সময়মতো ও কৃচ্ছ্রতার সাথে সঠিক খাতে এটা ব্যবহার করতে পারে তবে আমরা অবশ্যই স্বস্তিতে থাকব।

তাছাড়া, অনেকে আইএমএফের ঋণকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। কেননা, বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অনেক খাতই সংস্কারহীন অবস্থায় আছে। এখন, আইএমএফের শর্ত মেনে সেসব সংস্কার হলে অর্থনীতির ভিত মজবুত হবে ও বিশ্ব বাজারে আমাদের ভাব মূর্তি আরও উজ্জ্বল হবে।

নীলাঞ্জন কুমার সাহা ।। ডিন, ফ্যাকাল্টি অব বিজনেস স্টাডিজ ও সহযোগী অধ্যাপক, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়