সমাজে অবক্ষয়ের ডাল-পালা মেললে অন্যায়, অপরাধ বাড়বে, এটা স্বাভাবিক। এরকম একটা অস্বাভাবিক স্বাভাবিকতার মধ্যে আমাদের বসবাস এখন! ঘরে-বাইরে সব জায়গায় নৈতিকতার অবক্ষয়। যার সামান্য কিছু হয়তো গণমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সৌজন্যে আমরা দেখছি বা শুনছি। আর তাতে আঁতকে উঠছি! এই অবক্ষয়ের পুরো চিত্রটা কতটা ভয়ংকর, সেটা এখন ভাবনারও অনেক দূরে।

মূল্যবোধের গোড়াপত্তনটা কোথা থেকে হবে? পরিবার। কিন্তু সেই পরিবারগুলোর মধ্যে এখন নানারকম টানাপোড়েন। সেটা অর্থনৈতিক কারণে। কখনো বাড়তি উচ্চাভিলাষের কারণে।

এক ঘরের বাসিন্দা হয়েও মানুষগুলো কেন যেন এখন আর একজন আরেকজনের কাছের মানুষ নয়। এই যে তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লব, সেটা অনেক নুতন সম্পর্কের জন্ম দিচ্ছে। অ-নে-ক দূরের একজনকে খুব কাছে, মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। কত অপরিচিত মানুষকে কাছের মানুষ বানিয়ে দিচ্ছে।

মোবাইল, ইন্টারনেট, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপের মধ্যে আমরা এখন বুঁদ হয়ে পড়ে থাকছি! বিশাল পৃথিবীটা আমাদের কাছে অনেক ছোট হয়ে ধরা দিচ্ছে। কিন্তু এতটাই ছোট করে ফেলছি, যে কাছের মানুষটাকেও দেখতে পাচ্ছি না! বা দেখার চেষ্টা করছি না! অন্যের সঙ্গে নতুন নতুন সম্পর্ক হচ্ছে। কিন্তু নিজেদের অজান্তে পারিবারিক সম্পর্কগুলো আলগা হয়ে যাচ্ছে।

দিনে দিনে বেশিরভাগ সম্পর্ক কেমন যেন যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে! আবার হঠাৎ যে নতুন সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে, তার ভিতটাও বড় নড়বড়ে। যেখানে নীতি-নৈতিকতা বলে কিছু থাকছে না। শুধুই আবেগতাড়িত এক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছি। পারিবারিক সম্পর্কে ফাটল ধরলে, সেখানে সুখ-দুঃখের মুহূর্তগুলো ভাগাভাগি করার সুযোগ থাকে না। বাবা ছেলেকে বলার সুযোগ পাচ্ছেন না, তার কী করা উচিত, কী করা উচিত নয়! মা মেয়ের সঙ্গে মিশতে পারছেন না বন্ধুর মতো।

এই কথা বলার জায়গাটা সংকুচিত হয়ে আসছে পরিবারে। যা ডেকে আনছে ভয়াবহ এক পরিণতি। আমাদের জীবনচর্চায় অনেক কিছু হারিয়ে গেছে।

যে কারণে মূল্যবোধ, দায়িত্ববোধের অবক্ষয়ের চোরা স্রোত আরও প্রবল বেগে ঢুকে পড়ছে আমাদের পরিবারে, সমাজে, চিন্তায়-মননে। আর চূড়ান্ত প্রকাশ দেখছি, শিক্ষা-শিল্প-ব্যবসা-রাজনীতি-অর্থনীতি সব জায়গায়!

শিক্ষাক্ষেত্রে অবক্ষয়ের নমুনা নিয়ে হাজার হাজার পাতা লেখা যাবে। শিক্ষায় নৈতিকতার অবক্ষয়ের শুরু পরিবার থেকে। একটা শিশুকে তার শিক্ষা জীবনের শুরুতেই বলা হচ্ছে; তোমাকে জিপিএ ফাইভ পেতে হবে! তার জন্য তার কাঁধে এক গাদা বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে থেমে থাকছেন না অভিভাবকরা! সেই শিশুকে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে কোচিং সেন্টার নামক জিপিএ ফ্যাক্টরিতে! জিপিএ ফাইভ পেতেই হবে—তার জন্য টাকার বিনিময়ে প্রশ্নপত্র কিনে দিতেও কার্পণ্য করেন না অনেকে! প্রশ্নপত্র বিক্রিরও একটা বড় সিন্ডিকেট নির্ভর বাজার তৈরি হয়েছে। অর্থের বিনিময়ে কেনা প্রশ্নের সৌজন্যে মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তিও হওয়া যাচ্ছে। চাকরি পাওয়া যাচ্ছে। সবই হচ্ছে।

যেখানে মেধার চেয়ে অর্থের জোর বেশি, সেই সমাজে মানুষ অর্থের পেছনেই ছুটবে। এটা স্বাভাবিক। সেখানে নীতি-নৈতিকতা, ন্যায়-অন্যায়, দায়িত্ববোধ, মূল্যবোধ কোনোকিছুই আর তাদের পেছনের দিকে টেনে রাখতে পারে না। অর্থকেই তারা পাখির চোখ করে ছোটে! যে সমাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে নৈতিকতা বর্জিত কাজের অভিযোগ ওঠে, সেই সমাজ কতটা ভঙ্গুর অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে, সেটা বুঝতে বাকি থাকার কথা নয়! তারপরও সেই শিক্ষকদের সংবাদ সম্মেলন করে বলতে হয়, ‘আমি দুর্নীতি করিনি। আমার বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগ ভিত্তিহীন!’ অথবা আরও মোটা দাগে বলতে হয়; ‘আমাকে বলির পাঁঠা বানানো হয়েছে!’ আসলে দোষটা তাদের নয়।

শিক্ষক থেকে উপাচার্য নিয়োগ হচ্ছে যোগ্যতার চেয়ে দলীয় আনুগত্যকে প্রাধান্য দিয়ে, তখন তারা শিক্ষকতার চেয়ে দলীয় আনুগত্যকেই বড় যোগ্যতা মনে করবেন। ওপরে ওঠার জন্য যা যা করার সবই করবেন। সবকিছু মিলিয়ে এখন এক বড় বিতর্ক— শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের শ্রদ্ধা করছে না, নাকি শিক্ষকরা নিজেরা শ্রদ্ধার জায়গাটা হারিয়েছেন!

শুধু শিক্ষকতা কেন, প্রত্যেকটা পেশায় এখন নৈতিকতা-মূল্যবোধের ধ্বস নেমেছে। সাংবাদিকের কলম থেকে বিবেচক উধাও! একজন বিচারপ্রার্থী বিচারালয়ে ঢুকে শুনতে পান, দেশের একজন সাবেক প্রধান বিচারপতির নামে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে! একজন আইন প্রণেতার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালতে প্রমাণিত। অথচ তিনি স্থগিতাদেশ নিয়ে সংসদ সদস্য হিসেবে বহাল আছেন! আরেকজন সংসদ সদস্য বিদেশের জেলখানায় ঘুষ কেলেঙ্কারির দায়ে! অবশেষে তার সদস্যপদ বাতিল হয়েছে। তারা এখন আইন প্রণেতার আসনে!

ধর্ষণ-করোনা ভাইরাসের চেয়েও বড় মহামারি আকার ধারণ করছে আমাদের সমাজে। যৌন নিপীড়নের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না সাত বছরের শিশু থেকে সাতান্ন বছরের নারী! নিপীড়নের এই চিত্র ঘরে-বাইরে সব জায়গায়। এক সময় মনে হয়েছে; অবক্ষয়ের চোরা স্রোত বইয়ে যাচ্ছে আমাদের সমাজে। এখন মনে হয়, ধারণাটা ভুল। চোরা স্রোত নয়। রীতিমতো বন্যার মতো অবক্ষয় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের সমাজটাকে। এই অবক্ষয়ের মাঝে নৈতিকতার পতাকা উঁচিয়ে ধরে এগিয়ে যাওয়ার লোকের বড্ড অভাব এখন। অবক্ষয় শব্দটাই এখন মনে হয় অন্যায়, অপরাধের আবছায়া মাত্র। গোটাটা নয়।

অঘোর মন্ডল ।।  জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলাম লেখক