ছবি : সংগৃহীত

২০১৮ সালে আইয়ুব বাচ্চু প্রয়াত হয়েছেন। কিন্তু আজও দুই বাংলার নবীন প্রজন্ম আইয়ুব বাচ্চুর গান শোনেন। আজও তারা আপ্লুত হন তার গিটারের ঝংকারে। গিটারিস্টরা এখনো অনুসরণ করেন তার রেখে যাওয়া টংকার। হয়তো এমন শিল্পীদের কালজয়ী বলা হয়।

আইয়ুব বাচ্চু, ব্যান্ড এলআরবি। পুরো নাম লাভ রানস ব্লাইন্ড (Love Runs Blind)। ১৯৯০ সালে এর যাত্রা শুরু। শুরুতে নাম রাখা হয়েছিল লিটল রিভার ব্যান্ড। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ডাবল অ্যালবাম প্রকাশ করেছিল এলআরবি। আইয়ুব বাচ্চুকে বুঝতে হলে বাংলা ব্যান্ডকে বুঝতে হবে। ব্যান্ড হচ্ছে কালেক্টিভ নাউন। যেমন ‘ব্যান্ড অফ রবার্স'। বাংলায় ‘দল। যে দল হরিণেরা বাঁধে। আমরা বলি একপাল। ওরা বলে ‘ফ্লক’ বা ‘হার্ড’।

ছোটবেলায় একদল একসঙ্গে গান বাজনা করলে তাদের অর্কেস্ট্রা বলতো। এখন বলে ব্যান্ড। কিন্তু এই ব্যান্ড সংগীতের পত্তন কোথা থেকে? মৃদু ধারণা পেতে গেলে আমাদের যেতে হবে বাংলা সংগীতের ইতিহাসের অঙ্গনে। 

আরও পড়ুন >>> আইয়ুব বাচ্চু : রুপালি গিটার ফেলে 

বাংলা গানের সূচনা হয়েছিল আজ থেকে প্রায় হাজার বছর আগে। একাদশ শ্রেণিতে আমরা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে দেখেছি যে বাংলা ভাষার প্রথম সাহিত্য হলো চর্যাপদ। এই চর্যাপদগুলোও আসলে গান। চর্যাপদ হলো বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের সাধন সংগীত। m

শুরু হলো মহীনের ঘোড়াগুলির জার্নি। খুব সহজ যাত্রা নয়। ব্যান্ড নিয়ে তখনো পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির কোনো ধারণাই নেই। পাশ্চাত্যের বিটলস, পিংক ফ্লয়েড, লেনন-ডিলান শুনছেন কেউ কেউ।

চর্যাপদের পর বাংলা গানের ইতিহাসে যে গ্রন্থটির নাম করা যায় তা হলো শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। এটি বাংলা সাহিত্যের আদি-মধ্যযুগের একমাত্র সাহিত্যিক নিদর্শন। এটি একরকমের নাটগীতি। লিখেছিলেন বড়ু চণ্ডীদাস। এরপর একে একে আসে অনুবাদ সাহিত্য, মঙ্গলকাব্য এবং বৈষ্ণব পদাবলি। এরপরে বাংলা গান পাঁচালি, মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলি, কীর্তন, আখড়াই, হাফ-আখড়াই গান, কবিগান, টপ্পা, খেয়াল ও টপখেয়াল, ধ্রুপদ, ঢপকীর্তন, ঠুমরি, ধ্রুপদ, বাউল, লোকসংগীতের রাস্তায় এগিয়ে চলে।

সত্তরের দশকে ‘পপ সংগীত’ নামে বাংলা গানের যে নতুন ধারা তৈরি হয়েছিল তা চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত হতেই বেশ জনপ্রিয়তা পায়। পপুলার শব্দ থেকে পপ সংগীতের উৎপত্তি। এর সাথেই আসে রক সংগীত।

রক সংগীত উৎসারিত হয়েছে ফোক সংগীত, ক্লাসিক্যাল সংগীত এবং জ্যাজ সংগীত থেকে। এর তীব্রতা বৃদ্ধি করে নাম হয় হার্ড রক। এরপরে আসে মেটাল ও হেভি মেটাল যা রক সংগীতের বিবর্ধিত রূপ। উচ্চকিত ভয়ংকর শব্দের বিস্তৃতি। এইসব বিভিন্ন ধারার গান নিয়ে সত্তর সাল থেকে তৈরি হতে থাকে গায়ক ও বাজনদার মিলে এক একটি দল। একেকজন একেক ধারার অনুসারী।

আরও পড়ুন >>> আজম খান : আসি আসি বলে তুমি আর এলে না 

বাংলাদেশে ব্যান্ডের সূত্রপাত হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতের বহু আগে। পাক-ভারত বিভক্তির পরে ১৯৬৩ সালের ১৮ মার্চ ঢাকার সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলের এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রথম ব্যান্ড ধাঁচের গানের খবর পাওয়া যায়। সেই অনুষ্ঠানে ১৭ বছর বয়সী কিশোর টেলফার জনসন গিটার বাজান আর ক্লিফ রিচার্ডের গান পরিবেশন করেন। একই স্কুলের নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া ফজলে রব, আলমগীর [পরবর্তীকালে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের জনপ্রিয় গায়ক], রফিক ও সাব্বির ব্যান্ড দল গঠন করেন।

বলা হয়, তাদের হাতেই জন্ম নেয় বাংলাদেশের প্রথম ব্যান্ড আইওলাইটস। আইওলাইটসের সমকালীন আরেকটি ব্যান্ডের জন্ম চট্টগ্রামে। নাম জিংগা শিল্পগোষ্ঠী। সংগীতবোদ্ধা ও ইতিহাস রচয়িতাদের মতে 'জিংগা' একটি পারিবারিক ঘরানার ব্যান্ড। কারও কারও মতে, এটি বাংলাদেশের প্রথম ব্যান্ড। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আগলি ফেসেস ও আন্ডার গ্রাউন্ড পিস লাভারস নামের দুটি ব্যান্ড।

১৯৭৪ সালের শেষ দিকে গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে কলকাতার কয়েকজন সংগীতশিল্পী মিলে একটি ব্যান্ড বা দল গঠন করেন। প্রাথমিকভাবে তাদের নাম ছিল সপ্তর্ষি। পরে তাদের নাম পরিবর্তন হয় যেমন তীরন্দাজ এবং গৌতম চট্টোপাধ্যায় বিএসসি এবং সম্প্রদায় একেবারে শেষে রঞ্জন ঘোষাল এই ব্যান্ডটির নাম দেন মহীনের ঘোড়াগুলি। 

সময়টা নব্বইয়ের দশক। মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের যুগ অতিক্রম করে কলকাতা কাঁপাচ্ছেন সুমন চট্টোপাধ্যায়, অঞ্জন দত্ত, নচিকেতা। ব্যান্ডের কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। সেই সময়ে কলকাতায় এলো আইয়ুব বাচ্চুর ‘সেই তুমি’।

শুরু হলো মহীনের ঘোড়াগুলির জার্নি। খুব সহজ যাত্রা নয়। ব্যান্ড নিয়ে তখনো পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির কোনো ধারণাই নেই। পাশ্চাত্যের বিটলস, পিংক ফ্লয়েড, লেনন-ডিলান শুনছেন কেউ কেউ। কিন্তু তা যে বাংলাতেও হতে পারে, ভাবতে পারেননি কেউ। তারা লড়ে গেলেও কলকাতায় ব্যান্ডের প্রতি শ্রোতা দর্শকদের উৎসাহী করার পেছনে যার অবদান সবচেয়ে বেশি তার নাম আইয়ুব বাচ্চু। এই বিবৃতির পেছনে প্রথমেই দেখা যাক যুক্তিগুলি কী কী!

সময়টা নব্বইয়ের দশক। মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের যুগ অতিক্রম করে কলকাতা কাঁপাচ্ছেন সুমন চট্টোপাধ্যায়, অঞ্জন দত্ত, নচিকেতা। ব্যান্ডের কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। সেই সময়ে কলকাতায় এলো আইয়ুব বাচ্চুর ‘সেই তুমি’। সালটা ১৯৯৩। গানটা ছিল যুব সমাজের প্রতি প্রবল ধাক্কা। পেছনে চলে যাওয়া ব্যান্ডের দল আঁকড়ে ধরল গানটা।

আরও পড়ুন >>> ফকির আলমগীর: গণসংগীত যার সম্বল 

যেখানেই তারা সুযোগ পেত ‘সেই তুমি’ গানটা গাইত। আর গাইত বাচ্চু ভাইয়ের অন্যান্য গান। ক্রমাগত বাচ্চু ভাইয়ের গান শুনতে শুনতে তারা খুঁজল আইয়ুব বাচ্চুর অরিজিনাল সিডি। সেই সিডির শত শত কপি বিক্রি হতো ফুটপাথে। রয়ালিটি না পেলেও তার জনপ্রিয়তায় আকাশ ছুঁয়ে ফেলল। গোটা নব্বইয়ের দশক জুড়ে কলকাতায় ব্যান্ড অনুষ্ঠান মানেই ছিলেন বাচ্চু ভাই। কলকাতার ‘বাচ্চুদা’।

১৯৯৫ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেস্টে এলো ‘এলআরবি’। কলকাতার প্রিয় ‘বাচ্চুদা’। বাচ্চুভাই এলেন। গাইলেন। তখন মোবাইলের টর্চলাইট ছিল না। আগুন জ্বলে উঠল তার গিটারের অভিঘাতে। পাগল হলো কলকাতা। কিছুদিনের মধ্যে প্রেমে ধাক্কা খেলে তরুণ-তরুণীরা গাইতেন—‘সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে…।’ আর ‘তোমাকে ছাড়া আমি অসহায়।’

এলিট কলকাতা থেকে আইয়ুব বাচ্চুর গান ছড়িয়ে পড়ল গ্রামেগঞ্জে। খ্যাতির সাথে তার হৃদয় ছোঁয়া ব্যবহার তাকে করে তুলল কলকাতার ঘরের ছেলে। তিনি আজও এতটা জীবিত যে কলকাতার এখনকার টপ রকস্টার রূপম ইসলাম বলেছিলেন, “কলকাতার কোনো এক কনসার্টে বাজিয়ে আইয়ুব বাচ্চু ফিরে এসেছেন গোলপার্কের কাছে তার জন্য নির্দিষ্ট করা গেস্ট হাউসে।

ভেতরে ঢুকবেন-ঢুকবেন করছেন, ফুটপাতের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছেন। হঠাৎ তার কাছে গিয়ে পৌঁছল কাঁধে কিটব্যাগ ঝোলানো এক যুবক। যুবকটি বাংলাদেশের গানবাজনা নিয়ে একটি পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লেখে, নিজেও গান তৈরি করে। 

এলিট কলকাতা থেকে আইয়ুব বাচ্চুর গান ছড়িয়ে পড়ল গ্রামেগঞ্জে। খ্যাতির সাথে তার হৃদয় ছোঁয়া ব্যবহার তাকে করে তুলল কলকাতার ঘরের ছেলে।

দু’চারটে কথাবার্তার পরেই বাচ্চু আবিষ্কার করেন যুবকটির মধ্যে সম্ভাবনাকে। তিনি তাকে ভেতরে নিয়ে যান। একটি বড় ডর্মিটরিতে এলআরবি’র সবাই একসঙ্গে ছিলেন। রাতের রুটি-মাংস খাওয়ার প্রস্তুতি চলছিল। বাচ্চু খাওয়া শুরু করলেন। যুবকের হাতে তুলে দিলেন একটা অ্যাকুস্টিক গিটার। বললেন, ‘গান গা।’ সেই যুবকটি— আমি।

আরও পড়ুন >>> সঞ্জীব চৌধুরী : শহরের নাম না জানা এক মাস্তান 

আমার গানের ক্রুদ্ধ প্যাশন, জোরালো এবং খ্যাপা পরিবেশন তার মনে ধরেছিল। উত্তেজিত হয়ে নিজের ভঙ্গিতে তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘তোদের ধরনটাই পারবে কলকাতায় রক মিউজিক আনতে। তোরা ঠিক যেমনভাবে করছিস তেমনই করে যা। আজ যা নাই, কাল তা আসবে।’ তার ভাষায়—‘আজ যা ভাবছিস খেলা, কাল তাই-ই হবে মেলা!”  

এহেন বাচ্চু ভাইকে নিয়ে কেন গান গাইতে এলো অবসকিওর ও কলকাতার তরুণ দূর্বাদল বিশ্বাস? ১৯৮৪ সালে খুলনার কয়েকজন সদ্য স্কুল পাস করা ছেলে সাইদ হাসান টিপু'র নেতৃত্বে তৈরি করে ‘অবসকিওর’, যাদের বিখ্যাত গান ‘মাঝ রাতে চাঁদ’ কাঁপিয়ে দেয় সারা বাংলাদেশ। এরা প্রবর্তন করে সফট মেলোডির।

এত বছর পরে আগের গরিমায় গান গেয়ে ও শো করে চলেছে একই জনপ্রিয়তা ধরে রেখে যা ব্যান্ডের ইতিহাসে কম কথা নয়। টিপু আমাকে কবিতা লিখিয়ে থেকে শিখিয়ে, পড়িয়ে বানিয়ে দিয়েছে গীতিকার। দূর্বাদল কলকাতার তরুণ সদ্য নামকরা গায়ক এবং টিপুর প্রতি অসম্ভব শ্রদ্ধাশীল। মাত্র দুদিনের জন্যে আমি ও দূর্বাদল ঢাকায় এসেছিলাম অবসকিওরের আগামী অ্যালবাম নিয়ে কথা বলতে, কিন্তু গান পাগলরা এক জায়গায় হলে যা হয়!

কথায় কথায় উঠল বাচ্চু ভাইয়ের কথা। আমরা তো উচ্ছ্বসিত। টিপু বলল, তাহলে ট্রিবিউট টু বাচ্চু ভাই হয়ে যাক, অমিত তুমি লেখ। আজকাল যে বাড়িতে ছাত্র নেই সেই বাড়িতে কাগজ কলম পাওয়া খুব চাপের। সবাই লেখে কম্পিউটারে। ভাগ্য ভালো। শাওন মাহমুদ গৃহিণী হিসেবেও সার্থক। হাজির করল কাগজ কলম।

আরও পড়ুন >>> সংস্কৃতি খাতে বাজেট এত কম কেন? 

আমি একটি স্তবক লিখছি। সঙ্গে সঙ্গে টেনে নিচ্ছে টিপু ও দূর্বা। দূর্বাদল সুর করছে আর টিপু রাস্তা দেখাচ্ছে। আমি পরের স্তবক লিখছি। এভাবে লেখা হয়? মাঝে টিপু, বাচ্চু ভাইয়ের গানের যে দুই পঙ্‌ক্তি যাবে সেটা গেয়ে শোনাল। তার সাথে সাযুজ্য রেখে লিখতে হবে। কী করে যে আমি লিখে ফেললাম আর কী করে যে দূর্বাদল সুর করল এবং টিপু ও দূর্বা রেকর্ড করল, তার যে ব্যাখ্যা যেই দিক না কেন, আমার বিশ্বাস কাজটা আমাদের দিয়ে বাচ্চু ভাই করিয়ে নিলেন।

গানের ‘র’ ভার্সন বিকেলে পাঁচবার শুনলেন আইয়ুব বাচ্চুর স্ত্রী। অঝোরে কাঁদলেন। সব অনুমতি দিলেন। আমাদের প্রতি অনেক স্তুতি জানালেন। তবুও আমার দৃঢ় ধারণা যে আমরা কিছু করিনি, করিয়েছেন বাচ্চু ভাই। কলকাতা আজও যাকে ‘কিংবদন্তি’ ও ‘গিটার জাদুকর’ বলেই উল্লেখ করে সেই মহান স্রষ্টার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলির অংশ নিতে পেরে আমরা প্রত্যেকে সম্মানিত।

অমিত গোস্বামী ।। কবি ও কথাসাহিত্যিক