ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশে ভোটের সাথে জোটের একটা সম্পর্ক আছে। যতই নির্বাচন মানে ভোট কাছাকাছি আসে, ছোট ছোট দলগুলো ততই তৎপর হয় জোটবদ্ধ হতে। নির্বাচন হলো ছোট দলগুলোর মৌসুম। সর্বশেষ নিবন্ধন পাওয়া দলসহ বর্তমানে বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল আছে ৪০টি।

এছাড়া আরও শতাধিক দলের নাম আছে রাজনীতির মাঠে। এরমধ্যে বেশিরভাগই নামসর্বস্ব, ব্যক্তি নির্ভর। এমনকি নিবন্ধিত দলের মধ্যেও নামসর্বস্ব দল আছে। আসলে নিবন্ধিত দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ছাড়া আর কারো তেমন ভোট নেই।

নিবন্ধন বাতিল হওয়া জামায়াতে ইসলামীরও কিছু ভোট আছে। এই চারটি দল মিলেই বাংলাদেশের ভোটের বেশিরভাগ পায়। এর বাইরে দুয়েকটি ইসলামী দলের কিছু ভোটের পকেট আছে। বাকিদের ভোটের হিসাব অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া আবিষ্কার করা যাবে না।

আরও পড়ুন >>> দুর্নীতি কি বন্ধ হবে? 

ভোট না থাকলেও এদের সাইনবোর্ড আছে। সারাবছর ঘুমিয়ে থাকলেও নির্বাচনী মৌসুমে এই দলগুলোর তৎপরতা বেড়ে যায়। এদিক সেদিক ঘোরাফেরা করে। কোনো বড় দলের ছায়ায় আশ্রয় নিতে চায়। কেউ কেউ মনে করতে পারেন, যাদের ভোট নেই, সেই দলগুলো দিনের পর দিন রাজনীতি কেন করে। নির্বাচনী মৌসুম এলে আপনি জবাব পেয়ে যাবেন। নির্বাচনী মৌসুম এলে এই দলগুলোর বাজারদর বেড়ে যায়।

জোটভুক্ত হওয়ার জন্য, নির্বাচনে মনোনয়নের জন্য নানারকম দল কষাকষি চলে। একটা দুইটা আসনে মনোনয়ন পেলেই এরা খুশি। তবে মনোনয়ন সবার কপালে জোটে না। মনোনয়ন না পেলেও নির্বাচনের পর নানা সুবিধা পায়।

...ভোট না থাকলেও এদের সাইনবোর্ড আছে। সারাবছর ঘুমিয়ে থাকলেও নির্বাচনী মৌসুমে এই দলগুলোর তৎপরতা বেড়ে যায়। এদিক সেদিক ঘোরাফেরা করে। কোনো বড় দলের ছায়ায় আশ্রয় নিতে চায়।

দিলীপ বড়ুয়ার মতো মহা ভাগ্যবান কেউ কেউ টেকনোক্র্যাট কোটায় মন্ত্রীও হয়ে যেতে পারেন। তবে এমন রাজকপাল সবার নেই। টুকটাক নিয়োগ, ঠিকাদারিতেও সন্তুষ্ট থাকতে হয়। এভাবেই নির্বাচনী মৌসুমের দর কষাকষিতে তাদের সারা বছরের খোড়াকি জোটে। তবে মূল দল হেরে গেলে তাদের চেয়ে বেশি বিপদে পড়ে ছোট দলগুলো। তাই নির্বাচনের আগে সঠিক দল বাছাই করতে পারা ছোট দলগুলোর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ছোট দলগুলোর জন্য জোটে যাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঠিক আছে। কিন্তু বড় দলগুলোর জোট লাগে কেন? হিসাব যদি শুধু ভোটের হতো, তাহলে তো আওয়ামী লীগের জাতীয় পার্টি আর বিএনপির জামায়াত হলেই চলে। বাকি খুচরা দলগুলো লাগে কেন?

আরও পড়ুন >>> ইভিএম ভীতি, ইভিএম রাজনীতি

আমার কাছে মনে হয়, জোট আসলে একটা পারসেপশন। 'মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সবাই ঐক্যবদ্ধ', 'সরকার বিরোধী দলগুলো সব এক প্লাটফর্মে', 'ইসলামী দলগুলো সব আমাদের সাথে'—ভোটের মাঠে এই ধরনের একটা পারসেপশন তৈরি করা জরুরি।

ভোটের মাঠে একটা হাওয়া, একটা জোয়ার তৈরি করতেই এসব হাঁকডাক লাগে। কখনো কখনো সংখ্যাটাও গুরুত্বপূর্ণ। তাই ভোটের আগে ভোটারবিহীন খুচরা দলগুলোরও জোটের প্রশ্নে দাম বেড়ে যায়। নির্বাচনের আগে দলবদলের মতো জোট বদলের ঘটনাও ঘটে।

জাতীয় পার্টি এখন আওয়ামী লীগের সাথে আছে, একসময় বিএনপির সাথে ছিল। বিকল্পধারা একসময় বিএনপির সাথে ছিল, এখন আওয়ামী লীগের সাথে আছে। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর প্রান্তবদলের লক্ষণ স্পষ্ট হচ্ছে।

জোট এই অঞ্চলের রাজনীতির পুরোনো প্রবণতা। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান গঠনের মাত্র ৭ বছরের মাথায় যুক্তফ্রন্ট গঠন করে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল তখনকার বিরোধী দলগুলো। তারপর থেকে বিভিন্ন সময়ে রাজনীতিতে জোট হয়েছে, জোট ভেঙেছে, দলবদল হয়েছে।

আরও পড়ুন >>> জোশের লাগাম টানতে হবে 

নব্বইয়ের দশকে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে প্রথমে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫ দল এবং বিএনপির নেতৃত্বে ৭ দল মিলে মাঠে ছিল। পরে অবশ্য ১৫ দল ভেঙে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ৮ দলীয় জোট হয়েছিল। আর বাম দলগুলো মিলে ৫ দলীয় জোট করেছিল। তিন জোটের যুগপৎ আন্দোলনেই পতন ঘটেছিল স্বৈরাচারের। আবার ৮৮ সালের নির্বাচনের আগে ৭২ দলের সমন্বয়ে সম্মিলিত বিরোধী দল-কপ গঠন করেই গৃহপালিত বিরোধী দলের নেতা হতে পেরেছিলেন আ স ম রব।

বিএনপি-জামায়াতের ভোট একবাক্সে পড়েছিল বলেই ২০০১ সালে আওয়ামী লীগকে হটিয়ে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসতে পেরেছিল। আওয়ামী লীগ বুঝে গিয়েছিল বিএনপি-জামায়াতের সম্মিলিত ভোটের সাথে পারা মুশকিল। তাই তারা কাছে টেনে নিয়েছিল জাতীয় পার্টিকে।

তবে সমমনা দলগুলো নিয়ে গঠন করা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের অনেকেরই জাতীয় পার্টির ব্যাপারে আপত্তি ছিল। তাই আওয়ামী লীগ ১৪ দল রেখেই জাতীয় পার্টির সাথে মহাজোট গঠন করেছিল।

২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বড় জয়ের পেছনে জাতীয় পার্টির ভোট ব্যাকের বড় অবদান ছিল। ১৪ দল এখনো আছে। তবে বর্তমানে সরকারে তাদের কোনো অংশগ্রহণ নেই। তা নিয়ে মান-অভিমানের কমতি নেই। তবে নির্বাচন সামনে রেখে আবার সক্রিয় হচ্ছে ১৪ দল। ছোট দলগুলোর গুরুত্বও বাড়ছে। শোনা যাচ্ছে, আরও কিছু খুচরা দলও সামিল হতে চাইছে সরকারি জোটে। ইসলামী দলগুলোর সাথেও যোগাযোগ বাড়াচ্ছে আওয়ামী লীগ।

আরও পড়ুন >>> ক্ষমতাবানদের পেছনে গড্ডলিকা 

অনেকদিন ধরেই জাতীয় পার্টির সাথে আওয়ামী লীগের একটা চোর-পুলিশ খেলার সম্পর্ক। কাগজে কলমে জাতীয় পার্টি সংসদে প্রধান বিরোধী দল। কিন্তু বাস্তবে আওয়ামী লীগের পোষা। যখনই জাতীয় পার্টি সত্যিকারের বিরোধী দল হতে চায়, তখনই মামলা, হুমকিতে আবার পোষ মানানো হয়।

জি এম কাদের একটু বিপ্লবী হওয়ার চেষ্টা করাতে মামলা দিয়ে তার রাজনীতিই বন্ধ করার উপক্রম হয়েছিল। জি এম কাদের বুঝে গেছেন, স্বয়ং এরশাদ বেঁচে থাকতেও মামলার ভয়ে বিরোধী দল হতে পারেননি, সেখানে তিনি তো নস্যি। জাতীয় পার্টিকে তাই গৃহপালিত বিরোধী দল হয়েই থাকতে হবে।

তবে নির্বাচন সামনে রেখে জোট প্রবণতার বাইরে চলে যাচ্ছে বিএনপি। অনেকদিন ধরেই ২০ দলীয় জোটের ব্যানারে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছিল বিএনপি। ২০ দলীয় জোটের মূল দল ছিল বিএনপি ও জামায়াত। কিন্তু ২০ দলীয় জোটের ব্যানারে সুবিধা করতে না পেরে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের ব্যানারে ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। কিন্তু তাতে আরও বড় ভরাডুবি ঘটে। এরপর অলিখিতভাবেই হাওয়ায় মিলিয়ে যায় যুক্তফ্রন্ট। নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় ২০ দলও।

নামে ২০ দল হলেও বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকটি দল জোট ছেড়ে গেছে। নির্বাচনের মাঠে জামায়াতই বিএনপির সবচেয়ে বড় শক্তি। কিন্তু রাজনীতির মাঠে এই জামায়াতই আবার বিএনপির সবচেয়ে বড় বোঝা। যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াত সাথে থাকায় বিএনপি বামসহ সরকার বিরোধী অনেকগুলো দল পাশে পাচ্ছিল না।

আরও পড়ুন >>> জনপ্রতিনিধি নাকি জনপ্রিয় প্রতিনিধি? 

ভোটের মাঠে এই দলগুলোর কোনো গুরুত্ব না থাকলেও সরকার বিরোধী সব শক্তি এক সাথে আছে, এই পারসেপশনের জন্য সেই দলগুলোও এখন বিএনপির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। তাই কৌশলের অংশ হিসেবে বিএনপি অলিখিতভাবে ২০ দলীয় জোট বিলুপ্ত করে দিয়েছে।

...এখানে আদর্শের আসলে কোনো বালাই নেই। সবই স্বার্থ। তবে ভোটের রাজনীতি, জোটের রাজনীতি ভুলে দলগুলো যদি জনগণের জন্য একটু রাজনীতি করতো, তাহলে দেশের জন্য মঙ্গল হতো।

জামায়াতের সাথেও তাদের কৌশলগত দূরত্ব তৈরি হয়েছে। বিএনপি ২০ দলীয় জোট ভেঙে আরও বড় সরকার বিরোধী প্লাটফর্ম গড়তে চাইছে। তারা প্রমাণ করতে চাইছে, সরকার বিরোধী সবগুলো দল বিএনপির নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ। যুগপৎ আন্দোলনে বিএনপির সাথে মাঠে ৫৪টি দল আছে।

মজাটা হলো, এখানে ডান আছে, বাম আছে, মধ্যপন্থি আছে। পারফেক্ট জগাখিচুড়ি। তাদের মধ্যে টানাপড়েনও আছে। সমস্যা হলো যুগপৎ আন্দোলনে যে ৫৪ দল আছে, তাদের কর্মসূচিতেও বিএনপি থেকে লোক পাঠাতে হয়।

যুগপৎ আন্দোলনে গণতন্ত্র মঞ্চ নামে ৭ দলের একটি জোট আছে। এই মঞ্চে আ স ম আব্দুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না, জোনায়েদ সাকি, নুরুল হক নুরের মতো বাঘা বাঘা নেতারা আছেন। কিন্তু কে কার চেয়ে বড় বাঘ এই নিয়ে কামড়াকামড়ি শুরু হয়ে গেছে।

আরও পড়ুন >>> রাজনীতি কি মরণ খেলা? 

জামায়াতকে নিয়ে বিএনপি আছে উভয়সঙ্কটে। ভোটের প্রশ্নে জামায়াত ছাড়া তাদের চলবে না। কিন্তু জামায়াত পাশে থাকলে বামসহ অনেকেই কাছে আসতে চাইবে না।

যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতে ইসলামীর কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বিএনপির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। বিএনপি তাই জামায়াতের সাথে একটু দূরত্ব রেখেই চলতে চাইছে। তাতে অভিমান করেছে জামায়াত। আসলে বিএনপি-জামায়াত সম্পর্ক কাঁঠালের আঠার মতো। কেউ কাউকে ছাড়তে পারবে না। জামায়াতের যেটুকু ভোট তা বিএনপির লাগবেই। আবার নিবন্ধনহারা জামায়াতেরও বিএনপি ছাড়া গতি নাই।

জামায়াতের তবু কিছু ভোট আছে, অন্য ইসলামী দলগুলোর তাও নেই। ওয়াজে যত লোক আসে, বাক্সে তত ভোট পড়ে না। হাফেজ্জী হুজুরের বটগাছও মহীরুহ হতে পারেনি, জাকের পার্টির গোলাপ ফুলও সৌরভ ছড়াতে পারেনি, চরমোনাইয়ের হাত পাখার বাতাসও ঝড় তোলেনি। এই দলগুলো মূলত আওয়াজ সর্বস্ব।

আরও পড়ুন >>> সহমতের রাজনীতি

ইসলামী দলগুলো নিজেরা গুরুত্বপূর্ণ নয়, তবে তারা কার সাথে আছে; এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একসময় বাংলাদেশে ইসলামী দলগুলোর অলিখিত নেতা ছিল বিএনপি। এখন আওয়ামী লীগ সেখানে ভাগ বসাতে মরিয়া। হেফাজতে ইসলামকে পোষ মানানো গেছে আগেই। অন্য দলগুলোর সাথেও গোপন যোগাযোগ আছে। অসাম্প্রদায়িক চরিত্রে কিছুটা আপস করে হলেও আওয়ামী লীগ ধর্মীয় দলগুলো পাশে চাইবে।

নির্বাচনের এখনো প্রায় এক বছর বাকি। এই সময়ে আরও মেরুকরণ হবে, কেনাবেচা হবে, দর কষাকষি হবে। এখানে আদর্শের আসলে কোনো বালাই নেই। সবই স্বার্থ। তবে ভোটের রাজনীতি, জোটের রাজনীতি ভুলে দলগুলো যদি জনগণের জন্য একটু রাজনীতি করতো, তাহলে দেশের জন্য মঙ্গল হতো।

প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ