মোহনা সুলতানা। থাকেন খুলনা শহরের খালিশপুরে। একটি উন্নয়ন সংস্থায় মাঠকর্মী হিসেবে কাজ করেন। স্বামী মুত্তালিব সরকার খালিশপুরে একটা মনিহারি দোকান চালান। দুই মেয়ে মল্লিকা ও মালতি স্কুলে যায়। একজন চতুর্থ শ্রেণিতে, অপরজন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। বেশকিছু দিন ধরে মুত্তালিবের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না।

খাবারের রুচি কমে গেছে। কোনো বেলাতেই খেতে ইচ্ছা করে না। মাঝে মাঝে ছোট ছোট নিশ্বাস নিতে হয়। পিঠের পাশে নিচের দিকে ব্যথা হয়। প্রথমে ভেবেছিলেন পেটে হয়ত গ্যাস জমেছে। তাই পাড়ার ‘মায়ের দোয়া’ ফার্মেসি থেকে ‘সেকলো’ ট্যাবলেট কিনে খেয়েছেন। এতে সমস্যার সমাধান তো হয়নি বরং নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে। পানি এসে পা ফুলে গেছে। মোহনা আগেই চিকিৎসক দেখাতে বলেছিলেন। কিন্তু শোনেননি মুত্তালিব।

এবার মোহনা আর তার কথা শুনলেন না। নিয়ে গেলেন খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সবকিছু শুনে চিকিৎসক একজন কিডনি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে বললেন। বিকেলে মোহনা ও মুত্তালিব গেলেন কিডনি বিশেষজ্ঞের চেম্বারে। চিকিৎসক কিছু পরীক্ষা করাতে বললেন। রিপোর্ট নিয়ে দুই দিন পর দেখা করতে বললেন।

মাঝে মাঝে ছোট ছোট নিশ্বাস নিতে হয়। পিঠের পাশে নিচের দিকে ব্যথা হয়। প্রথমে ভেবেছিলেন পেটে হয়ত গ্যাস জমেছে। তাই পাড়ার ‘মায়ের দোয়া’ ফার্মেসি থেকে ‘সেকলো’ ট্যাবলেট কিনে খেয়েছেন। এতে সমস্যার সমাধান তো হয়নি বরং নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে। পানি এসে পা ফুলে গেছে। মোহনা আগেই চিকিৎসক দেখাতে বলেছিলেন। কিন্তু শোনেননি মুত্তালিব

পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে চিকিৎসক জানালেন, মুত্তালিবের কিডনিতে সমস্যা দেখা দিয়েছে। কিন্তু কিডনি সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা না থাকায় চিকিৎসকের কথা শুনে তার মুখ রক্তশূন্য হয়ে পড়ল। চিকিৎসক তাকে কিডনি রোগ সম্পর্কে ধারণা দিতে গিয়ে বললেন, কিডনি যখন তার কার্যক্ষমতা ক্রমান্বয়ে হারাতে থাকে তখন শরীরে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। যদি এ রোগ বেশি বেড়ে যায় তখন রক্তে দূষিত পদার্থ বাড়তে থাকে এবং অসুস্থবোধ হতে থাকে। সেই সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপ, অ্যানিমিয়া (লাল রক্ত কণিকার স্বল্পতা), হাড় দুর্বলতা, পুষ্টিহীনতা, স্নায়বিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।

আরও পড়ুন >> নগরে বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা

মারাত্মক কিডনি রোগের কারণে হৃদরোগ এবং রক্তনালিতে সমস্যা দেখা দিতে পারে। তবে এসব রোগ ধীরগতিতে বিস্তার লাভ করতে থাকে। প্রাথমিক অবস্থায় রোগ নির্ণয় করে দীর্ঘ দিন চিকিৎসা করালে এটি নিরাময় বা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।

যদি রোগ দ্রুত বাড়তে থাকে এবং একপর্যায়ে কিডনি বিকল হয়ে পড়ে তখন কৃত্রিম উপায়ে অর্থাৎ ডায়ালাইসিস পদ্ধতিতে রক্ত পরিশুদ্ধের ব্যবস্থা করতে হয় এবং কিডনি প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে জীবন রক্ষা করা যায়।

বিশ্বব্যাপী কিডনি রোগ একটি অন্যতম প্রধান জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ২০১০ সালে গ্লোবাল বার্ডেন অব ডিজিজ স্ট্যাডি-এর এক প্রতিবেদনে কিডনি রোগকে বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর ১৮তম কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। এটা ১৯৯০ সালে ছিল ২৭তম।

বিশ্বব্যাপী প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া ও সাব-সাহারান আফ্রিকা অঞ্চলে এই সংখ্যা অনেক বেশি। ২০১৫ সালে পরিচালিত এক সমীক্ষা প্রতিবেদন বলছে, উচ্চ-আয়ের দেশগুলোতে যে কোনো পর্যায়ে কিডনি রোগে আক্রান্ত মানুষের মোট সংখ্যা ছিল ১১০ মিলিয়ন। যেখানে পুরুষের সংখ্যা ৪৮.৩ মিলিয়ন এবং মহিলার সংখ্যা ৬১.৭ মিলিয়ন। অপরদিকে, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে এই সংখ্যা ছিল ৩৮৭.৫ মিলিয়ন। যার মধ্যে পুরুষ ১৭৭.৪ মিলিয়ন এবং মহিলা ২১০.১ মিলিয়ন।

কিডনি যখন তার কার্যক্ষমতা ক্রমান্বয়ে হারাতে থাকে তখন শরীরে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। যদি এ রোগ বেশি বেড়ে যায় তখন রক্তে দূষিত পদার্থ বাড়তে থাকে এবং অসুস্থবোধ হতে থাকে। সেই সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপ, অ্যানিমিয়া (লাল রক্ত কণিকার স্বল্পতা), হাড় দুর্বলতা, পুষ্টিহীনতা, স্নায়বিক সমস্যা দেখা দিতে পারে

বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি ঘনবসতিপূর্ণ উন্নয়নশীল দেশ। এখানে কিডনি রোগের প্রকোপ দিন দিন বাড়ছে। ঢাকা শহরে ৩০ বছরের বেশি বয়সী প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে পরিচালিত এক সমীক্ষায় ২৬ শতাংশ কিডনি রোগী পাওয়া গেছে। অন্য একটি সমীক্ষায় ১৫ বছরের বেশি বয়সী শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে ১৩ শতাংশ কিডনি রোগী দেখা গেছে (১)

বাংলাদেশের প্রায় ২০ মিলিয়ন মানুষ দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত। তাদের মধ্যে প্রতি বছর ৩৫ থেকে ৪০ হাজার মানুষ কিডনি রোগের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে যান। দীর্ঘস্থায়ী গ্লোমেরুলোনফ্রাইটিস, ডায়াবেটিস মেলিটাস এবং উচ্চ রক্তচাপ দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের প্রধান কারণ।

কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সাধারণ কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- হাইপোভোলেমিয়া, সেপসিস (রক্তের সংক্রমণ), প্রসব সংক্রান্ত জটিলতা, হারবাল এবং হোমিওপ্যাথিক ওষুধসহ অন্যান্য ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।

বাংলাদেশে কিডনি রোগের তিন ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি প্রচলিত আছে। এগুলো হলো- হোমো ডায়ালাইসিস, পেরিটোনাল ডায়ালাইসিস এবং কিডনি প্রতিস্থাপন। বাংলাদেশে প্রতি ০.৮ মিলিয়ন মানুষের জন্য একজন কিডনি বিশেষজ্ঞ আছেন। একদিকে চিকিৎসকের অপ্রতুলতা অন্যদিকে অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সুবিধা ও উচ্চ স্বাস্থ্য ব্যয়ের কারণে ২৫ শতাংশ কিডনি রোগী চিকিৎসা করানোর সুযোগ পান না।

আরও পড়ুন >> কিডনি রোগের ব্যয় মেটাতে নিঃস্ব হচ্ছেন অনেকে

২০২১ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, ২৪ শতাংশ মানুষ নিজ খরচে চিকিৎসা করাতে পেরেছেন। ৩৫ শতাংশ মানুষ পরিবারের বাইরের কারও কাছ থেকে ঋণ নিয়ে চিকিৎসা করিয়েছেন এবং ১৩ শতাংশ মানুষকে চিকিৎসার জন্য সম্পত্তি (জমি) বিক্রি করতে হয়েছে (২)

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নীতিনির্ধারকদের এ বিষয়ে একটি সমন্বিত স্বাস্থ্য কৌশল গ্রহণ করতে হবে। এটি কিডনি রোগসহ এনসিডি প্রতিরোধ, প্রাথমিক শনাক্তকরণ ও ব্যবস্থাপনাকে অগ্রাধিকার দেবে। পাশাপাশি নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। কারণ, প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্ত হলে রোগ নিরাময় বা নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়।

২০২১ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, ২৪ শতাংশ মানুষ নিজ খরচে চিকিৎসা করাতে পেরেছেন। ৩৫ শতাংশ মানুষ পরিবারের বাইরের কারও কাছ থেকে ঋণ নিয়ে চিকিৎসা করিয়েছেন এবং ১৩ শতাংশ মানুষকে চিকিৎসার জন্য সম্পত্তি (জমি) বিক্রি করতে হয়েছে 

আমাদের দেশের অনেক মানুষ উচ্চ ব্যয়ের জন্য কিডনি রোগের দীর্ঘস্থায়ী চিকিৎসা করাতে পারেন না। কিডনি রোগের ওষুধ ও ডায়ালাইসিসের খরচ সবার নাগালের মধ্যে আনতে হবে যাতে চিকিৎসা করতে গিয়ে কাউকে পথে বসতে না হয়।

কিডনি রোগ প্রতিরোধে চাই সুস্থ জীবনধারা এবং সুষম খাদ্যাভ্যাস। নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম করা দরকার। উচ্চ রক্তচাপ কিংবা ডায়াবেটিস থাকলে অবশ্যই তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। পরিহার করতে হবে ধূমপান ও অ্যালকোহল গ্রহণ। এগুলো মেনে চললে কিডনি রোগের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পাবে দেশ।

লেখক : প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, এমিনেন্স অ্যাসোসিয়েটস ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট; কনসালটেন্ট, ইউনিসেফ 

রেফারেন্স- 

1. Banik S, Ghosh A. Prevalence of chronic kidney disease in Bangladesh: a systematic review and meta-analysis. Int Urol Nephrol. 2021 Apr 1;53. 
2. Rashid H, Alam M, Khanam A, Rahman M, Ahmed S, Arefin S, et al. Nephrology in Bangladesh. In 2021. p. 221–38.