স্থানীয় পর্যায়ে গণমানুষের জন্য সহজলভ্য ও মৌলিক চিকিৎসাসেবাই সাধারণভাবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বলে পরিচিত। ১৯৭৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আলমা আতা (Alma Ata) ঘোষণার মধ্য দিয়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ধারণাটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ধারণাটি স্থানীয় সামাজিক ঐতিহ্য, মূল্যবোধ এবং আর্থসামাজিক ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত বলে দেশে দেশে এর ভিন্নতা দেখা গেলেও সাধারণত সকল দেশের মৌলিক স্বাস্থ্যশিক্ষা, পুষ্টির মানোন্নয়ন, শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্যসেবা, পরিবার পরিকল্পনা, প্রতিষেধক টিকাদান, স্বল্প আঘাত ও সাধারণ অসুস্থতা, সংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধ এবং মহামারি প্রতিরোধে এর প্রয়োগ বিশ্বব্যাপী সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত।

একটি উন্নত সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের আশায় প্রতিনিয়ত মানুষ শহরমুখী হচ্ছে। কৃষিজমির স্বল্পতা বা অনুর্বরতা, সাম্প্রদায়িক বা রাজনৈতিক বিবাদ এবং গ্রামে কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায় মানুষ শহরমুখী হয়। গত কয়েক দশকে দেশে ব্যাপক হারে শহরমুখী অভিগমন বেড়েছে। গ্রাম থেকে আসা এসব মানুষের বেশির ভাগই দরিদ্র। বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে এক মত হয়েছেন যে, শহুরে দারিদ্র্যের জীবনযাত্রার মান গ্রামের থেকে খারাপ। এর কারণ ক্ষণস্থায়ী জীবনযাপন, পরিবেশগত বিপদ, সামাজিক বিভক্তি, অপরাধের সংস্পর্শ, সহিংসতা এবং দুর্ঘটনা। প্রায়ই শহুরে দরিদ্ররা বস্তিতে বসবাস করেন। বস্তির বাসিন্দারা যেসব বঞ্চনার মুখোমুখি হন তার মধ্যে স্বাস্থ্যের দিকটা থাকে সবার আগে। নিম্ন আয়ের শহুরে পরিবারগুলো প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল জীবনধারা, অপুষ্টি, ক্রমাগত সামাজিক বৈষম্য, অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা এবং অস্থিতিশীল সামাজিক জীবন, অসংক্রামক রোগ এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার মতো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে।

গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য, পুষ্টিনীতি ও কর্মসূচিগুলো মূলত গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা ও ফলাফলের উপর দৃষ্টি দিয়েছে। গ্রামীণ জনসংখ্যা বিশেষ করে দরিদ্ররা প্রাথমিক রোগের চিকিৎসা এবং মাতৃস্বাস্থ্য পরিচর্যার জন্য ওয়ার্ড পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিকে যেতে পারেন। নগর দরিদ্রদের জন্য এ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়নি। বড় মাপের মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি হাসপাতাল এবং চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে আমাদের নগর পরিপূর্ণ। গ্রামাঞ্চলের তুলনায় শহরাঞ্চলে স্বাস্থ্যকর্মীদের উপস্থিতিও অনেক বেশি। তবুও শহরে দরিদ্র ও বস্তিবাসী প্রাথমিক পর্যায়ের রোগে আক্রান্ত হলে চিকিৎসা পান না। কারণ, বেসরকারি পর্যায়ের হাসপাতালগুলোর চিকিৎসার উচ্চ ব্যয় নির্বাহ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। আর সরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রায়শই রোগীর চাপ অনেক বেশি এবং দীর্ঘ লাইন থাকায় সময় মতো স্বাস্থ্যসেবা পাওয়াটা দুরূহ হয়ে পড়ে। এ কারণে তারা হাতের কাছে থাকা ঔষধের দোকান থেকে অসম্পূর্ণ ও ভুল ঔষধ কিনে সুস্থ হওয়ার চেষ্টা করেন। রোগ জটিল হলে নগরবাসী (যাদের হাতে কিছু টাকা থাকে) বাধ্য হয়ে চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে অথবা বেসরকারি হাসপাতালে যান। তখন পকেট থেকে বড় অঙ্কের অর্থ বেরিয়ে যায়, যা তাদের সর্বস্বান্ত করে দিচ্ছে।

বাংলাদেশ হেলথ অ্যাকাউন্টের তথ্য অনুযায়ী, স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে বছরে ৬৪ লাখ মানুষ গরিব থেকে আরও গরিব হচ্ছে। তাদের মধ্যে ১৫ শতাংশ চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ছে (৩)। আর বস্তিতে বসবাসকারী অতি দরিদ্র শ্রেণির রোগীরা মারাত্মক বা অন্তিম পর্যায়ে পৌঁছে নগরের হাসপাতালে যান। সেখানে জরুরি ও দ্রুত চিকিৎসা ব্যবস্থার ঘাটতিতে বিপুল সংখ্যক রোগীর প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যু ঘটে। আমাদের গ্রামাঞ্চলে এখন বহু স্তরের শক্তিশালী গ্রামীণ প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন সাব-সেন্টার, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স। অন্যদিকে, নগরে তেমন সরকারি প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কার্যত অনুপস্থিত।

বাংলাদেশে ২০০৯ সালের আইনে নগর জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্ব স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা) প্রতিষ্ঠানের হাতে অর্পণ করা হয়। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে (ঋণে) ১৯৯৮ সাল থেকে ২৩ বছর ধরে স্থানীয় সরকার বিভাগের
অধীনে চলমান রয়েছে ‘আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সার্ভিসেস ডেলিভারি’ প্রকল্প। সঠিক দিকনির্দেশনাহীন বিভিন্ন দুর্বলতায় ভরা এই প্রকল্প নগর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে দুর্বল করে রেখেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

নগরে গড়ে ওঠেনি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের সরকারি সক্ষমতা বা অবকাঠামো। দরপত্রের মাধ্যমে এনজিওদের কাছ থেকে স্বাস্থ্যসেবা ক্রয় করা হয় এই প্রকল্পে। এক্ষেত্রে এনজিওদের জনবল, দক্ষতা ও মানসম্পন্ন সেবা প্রদানের সক্ষমতা বিবেচনায় রাখাটা দৃশ্যমান নয়। এককভাবে স্বতন্ত্র একটি এনজিও’র পক্ষে সম্পূর্ণ ও সমন্বিত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার মতো সক্ষমতা তৈরি প্রায় অসম্ভব। নগরে টেকসই প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের অবকাঠামো তৈরির উপযোগী নয় তাদের অস্থায়ী সেবা ও মোটিভেশন। ‘আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সার্ভিসেস ডেলিভারি’ প্রকল্প থেকে একেবারে যে কেউই সেবা পাননি, এমনটা নয়। ঋণের অর্থে পরিচালিত এই প্রকল্প থেকে স্বাস্থ্যসেবা পেয়েছেন কিছু দরিদ্র নগরবাসী। তবে, প্রয়োজনের তুলনায় তা নিতান্তই অপ্রতুল।

আলো ঝলমলে নগরগুলোর তুলনামূলক অন্ধকারে অবস্থিত বস্তিতে বসবাসকারী দরিদ্র মানুষগুলোর শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্যসেবা, অপুষ্টিজনিত স্বাস্থ্য সমস্যা, কিশোর-কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকালীন সমস্যা, পরিবার পরিকল্পনা, প্রতিষেধক টিকাদান, স্বল্প আঘাত ও সাধারণ অসুস্থতার সেবা বিনামূল্যে বা স্বল্প মূল্যে নিশ্চিত করতে না পারাটা সত্যিই কষ্টের। দারিদ্র্য বিমোচন ও সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য চাই শক্তিশালী নগর প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া নগরবাসীর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার সমস্যাগুলো দূর করা সম্ভব নয়। স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সম্পৃক্ততা রয়েছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন সিটি করপোরেশনগুলো মূলত নগর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। প্রতিটি সিটি করপোরেশনেই নগর স্বাস্থ্যসেবা দেখাশোনার একটি বিভাগ থাকে। নগরবাসীর স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার বিষয়টি সিটি করপোরেশনের কর্মকাণ্ডের ওপরই নির্ভর করে। ইচ্ছা করলেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তাদের কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। তবে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নগর স্বাস্থ্যসেবার প্রধান দায়িত্ব নিলে এবং সিটি করপোরেশনগুলো সহযোগী হিসেবে দায়িত্ব পালন করলে সর্বজনীনভাবে নগর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সহজ হবে বলে বিশেষজ্ঞগণ অভিমত দিয়েছেন।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ছাড়াও নগর স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে পরোক্ষভাবে শিল্প, বাণিজ্য ও পরিবেশসহ আরও কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সম্পৃক্ততা রয়েছে। নগর স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন ঘটাতে হলে এসব মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় থাকতে হবে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর দেশ যখন উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় অগ্রসরমান তখন নগরবাসী তাদের আবাসগৃহের কাছে থাকা নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে স্বল্পমূল্যে এবং সমতার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির প্রত্যাশা করতেই পারে।

লেখক : প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা
গবেষণা সহকারী : শাম্মি আখতার ও মো. মোস্তাফিজুর রহমান
এমিনেন্স এসোসিয়েটস ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট