জনৈক খ্যাতিমান বিদেশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মূল্যায়ন করেছেন এইভাবে— ‘প্রায় বারো শ বছর পর বাঙালি জাতির পুনর্জন্ম হয়েছে এবং হাজার বছর পরে বাংলাদেশ এমন নেতা পেয়েছে যিনি রঙে-বর্ণে, ভাষায় ও জাতি বিচারে প্রকৃতই একজন খাঁটি বাঙালি। বাংলাদেশের মাটি ও ইতিহাস থেকে তার সৃষ্টি এবং তিনি বাঙালি জাতির স্রষ্টা।’ স্পষ্টতই, স্বাধীন সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের স্রষ্টা হিসেবেই বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে উপরোক্ত মন্তব্য করা হয়েছে।

বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। জাতীয় আয়ের সিংহভাগ আসে কৃষি থেকে। বঙ্গবন্ধু দেশ পুনর্গঠনের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে গিয়েছিলেন কৃষকের কাছে। বঙ্গবন্ধু গভীর চিত্তে উপলব্ধি করতেন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে হলে প্রয়োজন কৃষি ও কৃষকের সামগ্রিক উন্নতি। আর এজন্য ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দান করেন।

কৃষি ও কৃষকের প্রতি বঙ্গবন্ধুর গভীর মমত্ব ও ভ্রাতৃত্ববোধ ছিল। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে গোটা কৃষি ব্যবস্থাকে ব্যাপক আধুনিকীকরণে ও লাগসই উন্নয়নে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।

সেই ১৩ ফেব্রুয়ারির বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু কৃষিবিদদের উদ্দেশে বলেন, ‘শুধু কাগজে-কলমে আর বই পড়েই কৃষিকাজ হয় না। ছোট ভাইয়েরা তোমরা মনে কিছু করবে না। বই পড়ে তোমরা যা শেখ, গ্রামে যারা অর্থাৎ বুড়ো কৃষক, নিজের অভিজ্ঞতায় কম শেখে না। যদি তাদের জিজ্ঞেস করো এ জমিতে কী লাগবে, কতটুকু সার লাগবে, সে নির্ভুল বলে দিতে পারবে। তোমরা পাঁচ বছরে বই পড়ে যা শিখবে না, তার কাছে দেখো উত্তর সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে যাবে। বইয়ের সঙ্গে সঙ্গে একটু প্র্যাকটিক্যাল কাজ করতে হবে। প্যান্ট-শার্ট-কোট একটু খুলতে হবে। তা না হলে কৃষি বিপ্লব করা যাবে না। বাংলাদেশে প্যান্ট-শার্ট-কোট ছেড়ে মাঠে না নামলে বিপ্লব করা যাবে না, তা যতই লেখাপড়া করা যাক, কোনো লাভ হবে না। গ্রামে যেয়ে আমার চাষি ভাইদের সঙ্গে বসে প্র্যাকটিক্যাল কাজ শিখতে হবে।’

কৃষি ও কৃষকের প্রতি বঙ্গবন্ধুর গভীর মমত্ব ও ভ্রাতৃত্ববোধ ছিল। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে গোটা কৃষি ব্যবস্থাকে ব্যাপক আধুনিকীকরণে ও লাগসই উন্নয়নে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘খাদ্য বলতে শুধু ধান, চাল, আটা, ময়দা আর ভুট্টাকে বোঝায় না বরং মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, শাক-সবজি এসবকে বোঝায়। সুতরাং কৃষি উন্নতি করতে হলে এসব খাদ্যশস্যের উৎপাদন উন্নতি করতে হবে।’

১৯৭২-৭৩ সালে ৫০০ কোটি টাকা উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ ছিল। তার মধ্যে ১০১ কোটি টাকা শুধু কৃষি উন্নয়নের জন্য রাখা হয়েছিল। এতে তখন থেকেই কৃষির প্রতি, কৃষি উন্নয়নের প্রতি তার আন্তরিকতা প্রকাশ পায়। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক সমাবেশে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের শপথ বাক্য পাঠ করানোর পর বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দেন তাতে কৃষকদের জন্য অনেক প্রতিশ্রুতি ছিল। সেদিন বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার দল ক্ষমতায় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করে দেব। আর ১০ বছর পর বাংলাদেশের কাউকেই জমির খাজনা দিতে হবে না। আইয়ুবি আমলে বাস্তুহারা হয়েছে বাংলার মানুষ। সরকারের খাসজমিগুলো বণ্টন করা হয়েছে ভুঁড়িওয়ালাদের কাছে। তদন্ত করে খাসজমি কেড়ে নিয়ে তা বণ্টন করা হবে বাস্তুহারাদের মধ্যে। ভবিষ্যতেও সব খাসজমি বাস্তুহারাদের মধ্যে বণ্টন করা হবে এবং চর এলাকায়ও বাস্তুহারাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। আমি কৃষক ও শ্রমিকদের কথা দিচ্ছি, আওয়ামী লীগ তাদের আদর্শের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না।’

স্বাধীনতার পরপরই কৃষির উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এবং নির্দেশনায় বেশ কিছু নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। ১৯৭২ সালে দেশে তুলার চাষ সম্প্রসারণ করার জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে তুলা উন্নয়ন বোর্ড গঠিত হয়। পুনর্গঠন করা হয় হর্টিকালচার বোর্ড, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি ও রাবার উন্নয়ন কার্যক্রম। সোনালি আঁশের সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করতে প্রতিষ্ঠা করা হয় পাট মন্ত্রণালয়। বঙ্গবন্ধু কৃষি সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন, বীজ ও সার সরবরাহের প্রতিষ্ঠান বিএডিসিকে পুনর্গঠন এবং সারা দেশের বীজ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন ১৯৭৫ সালে। এই বিএডিসি আধুনিক কৃষি সেচ ব্যবস্থার প্রচলন করে এ দেশে। কৃষিতে প্রয়োজনীয় অর্থায়নের জন্য তিনি কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন।

কৃষি গবেষণা ছাড়া যে কৃষির উন্নতি সম্ভব নয়, বঙ্গবন্ধু তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন। তাই ১৯৭৩ সালেই কৃষিতে গবেষণা সমন্বয়ের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল। ১৯৭৩ সালে ১০ নং অ্যাক্টের মাধ্যমে নতুন নামে পুনর্গঠন করেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট।

১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক সমাবেশে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের শপথ বাক্য পাঠ করানোর পর বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দেন তাতে কৃষকদের জন্য অনেক প্রতিশ্রুতি ছিল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার পর লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতিতে এক জনসভায় ভাষণের মাধ্যমে কৃষি বিপ্লবের ডাক দেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব দেশে কৃষি বিপ্লব সাধনের জন্য কৃষকদের প্রতি কাজ করে যাওয়ার আহ্বান জানান। কৃষি বিপ্লবের ডাক দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশের এক ইঞ্চি পরিমাণ জমিও অনাবাদি রাখা যাবে না।’ তিনি দেশের অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্য প্রত্যেককে স্বাবলম্বী হতে বলেন। বঙ্গবন্ধু কৃষি বিপ্লবের মাধ্যমে তার স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তোলার লক্ষ্যে সকলকে কাজ করে যাওয়ার আহ্বান জানান।

আজকে এটা প্রমাণিত, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল আসলে বাংলাদেশকে হত্যার জন্যই। বাংলাদেশের অস্তিত্ব মুছে ফেলে একে একটি ব্যর্থ ও পঙ্গু রাষ্ট্র বানানোই ছিল ১৫ আগস্টের ঘাতকদের মূল উদ্দেশ্য। বাংলাদেশ যেন বিশ্বে স্বাধীন দেশ হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, সেই লক্ষ্য অর্জনই ছিল ঘাতকদের উদ্দেশ্য। বঙ্গবন্ধু আজ বেঁচে থাকলে আমরা একটি সুখী সুন্দর সোনার বাংলা অনেক আগেই অর্জন করতে পারতাম। বিজয় অর্জনের পর সরকার গঠন করে তিনি একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে যেভাবে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেটাই তার প্রমাণ বহন করে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত ‘বঙ্গবন্ধু-সমতা-সাম্রাজ্যবাদ’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে ১৯৭৩-২০১১ সাল নাগাদ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মোট দেশজ উৎপাদনের বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়াত ৯ শতাংশ। এ হিসাব নিরূপণে বিভিন্ন যৌক্তিক অনুসিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ধরে নিয়েছি বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে ২০১১ সাল নাগাদ (তখন বঙ্গবন্ধুর বয়স হতো ৯০ বছর) তিনি মোট ৭টি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার পূর্ণ সময়সহ অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রথম ৩ বছর সময় পেতেন।’

ফরিদুন্নাহার লাইলী ।। কৃষি ও সমবায় সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং সাবেক সংসদ সদস্য