ছবি : সংগৃহীত

তৃণমূলে একাত্তরের গণহত্যার ইতিহাস জানতে কিছুদিন আগেই গিয়েছিলাম সিরাজগঞ্জে। সেখানে শিয়ালকোল এলাকায় ১৯৭১ সালে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয় সাতজন নিরীহ-নিরপরাধ মানুষ। শুধু হিন্দু হওয়ার অপরাধেই হত্যা করা হয় তাদের। লুঙ্গি খুলে হিন্দুত্ব নিশ্চিত হয়ে সবাইকে গুলি করে পাকিস্তানি সেনারা।

নিহতদের কেউ কেউ দুধ ও কলা দিয়ে তৃপ্তি নিয়ে ভাত খেয়েছিলেন খানিক আগেই। গুলির তোরে পেট ফেটে সেগুলোও বেরিয়ে আসে। ক্ষত-বিক্ষত সেই সব লাশের বর্ণনা দিচ্ছিলেন প্রত্যক্ষদর্শীরাই।

১৮ মে ১৯৭১। দুপুরের ঘটনা। কামারখন্দের পাইপোসা গ্রাম থেকে পাকিস্তান আর্মিদের একটি গ্রুপ শিয়ালকোল হয়ে সিরাজগঞ্জ শহরের দিকে যাচ্ছিল। ওরা শিয়ালকোল বাজারে এসে মোস্তফা খন্দকার নামে এক সাইকেল মিস্ত্রিকে পায়। তাকে জিজ্ঞেস করে, মালাউন কাহা হে?

আরও পড়ুন >>> সমস্যাটা মনে হয় আমার 

সে বলে, ‘এখানে তো মালাউন নাই।’ খানিক পরেই এক গরিব হিন্দু অন্ধ লোক আসে তাদের কাছে সাহায্য চাইতে। তার পরনে ছিল ধুতি। এক আর্মি বলে, এই তো মালাউন।’ বুঝে যায় এটা হিন্দু এলাকা। মোস্তফা কেন মিথ্যা বলল তাই তাকে ধরে মারতে থাকে। এরপর আর্মিরা পাশের হিন্দু পাড়ায় ঢুকে।

ওই পাড়া থেকে সিরাজগঞ্জ জ্ঞানদায়িনী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক যোগেন্দ্র নারায়ণ বসাক, তার বড় ভাই ননী গোপাল বসাক ও ভাতিজা প্রণব কুমার বসাককে ধরে নিয়ে যায়। পথেই পায় আরও তিনজন-শুকুচরণ রবিদাস, ফনীন্দ্রনাথ দাস ও প্রেমনাথ দাসকে। আর শিয়ালকোলে শিবচরণ রবিদাস ওই সময় তার বাড়িতে স্নান সেরে ধুতি নাড়ছিলেন। তাকেও ওরা ডেকে নেয়। এরপর পাকিস্তানি সেনারা তাদের গুলি করে হত্যা করে। ফনীন্দ্রনাথ দাস গুলিবিদ্ধ হয়েও বেঁচেছিলেন। কিন্তু প্রচণ্ড রক্তক্ষরণে ওই দিন রাতেই বিনা চিকিৎসায় তার মৃত্যু হয়।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু দুই হাজার টাকার সহযোগিতাসহ একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। এরপর আর কেউ খোঁজ নেননি। পরিবারও পায় না কোনো সরকারি সুবিধা।

আর্মিরা চলে যাওয়ার পর সেখানে ছুটে আসেন কয়েকজন। সাতজন তখনো যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন। সবার হাতের বাঁধন খুলে দেন আজম, জামাল উদ্দিনসহ আরও কয়েকজন। সেই স্মৃতি বলতে গিয়ে আজও তারা আপ্লুত হন।

শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের রাস্তার পাশেই একটি ডোবা। অন্যসব ডোবার মতোই কচুরিপানা আর বড় বড় ঘাসে পূর্ণ। একাত্তরের হত্যাযজ্ঞ সেখানেই ঘটেছে। নেই কোনো স্মৃতিস্তম্ভ বা ফলক।

খুব কাছেই ভাঙাচোরা একটি খুপরি ঘর। এটিই শহীদ শিবচরণ রবিদাসের বাড়ি। একাত্তরে জুতার কাজ করতেন তিনি। হত্যার পর পরিবার তার লাশ এনে সমাধিস্থ করেন ঘরের সামনেই। সমাধির ওপর এলোমেলোভাবে পড়ে আছে কয়েকটি লাল জবা। পিতার সমাধিতে সকাল-বিকেল এভাবেই ফুলেল শ্রদ্ধা জানান রবিদাসের ছেলে মংলা চন্দ্র রবিদাস।

আরও পড়ুন >>> জেনোসাইড : বাঙালিদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের অপরাধ 

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু দুই হাজার টাকার সহযোগিতাসহ একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। এরপর আর কেউ খোঁজ নেননি। পরিবারও পায় না কোনো সরকারি সুবিধা। পুত্রের ভাষায়, শেখ মুজিব মারা যাওয়ার পর আমাদের ভাগ্যেরও মৃত্যু ঘটছে।’

শিয়ালকোলের মতো সিলেটের ফেঞ্জুগঞ্জের কাইয়ারগুদাম, নরসিংদীর রায়পুরার গৌরীপুর নৌকাঘাটসহ সারাদেশে বহু গণহত্যার স্থান এখনো অবহেলা ও অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে।

গণহত্যায় শহীদদের তালিকা তৈরি, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান এবং তাদের আত্মত্যাগের ইতিহাস প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগও নেই তেমন। অথচ স্বাধীন এই দেশের মাটির সঙ্গে মিশে আছে শহীদদের রক্ত। তাদের কথা ভুলে গেলে, শহীদদের স্বীকৃতি প্রদান না করলে একাত্তরের রক্তঋণ শোধ হবে না। এই দায় নিতে হবে সবাইকেই।

একাত্তরের ৯ মাসের যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান, আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি এবং জাতির অসাধারণ ত্যাগের বিনিময়ে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশ মেনে নিতে পারেনি পাকিস্তান। ফলে ৫২ বছর পরও ১৯৭১ সালে তারা যে সীমাহীন গণহত্যা চালিয়েছে, তার জন্য বিন্দুমাত্র দুঃখ প্রকাশ বা ক্ষমা চায়নি পাকিস্তানের কোনো সরকার, বিচার করেনি তৎকালীন একজন জেনারেলেরও। বরং যখনই পেরেছে তখনই তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।

আরও পড়ুন >>> জেনোসাইড ৭১: স্বীকৃতির গোলকধাঁধা 

একাত্তরের ঘটনা তদন্তে পাকিস্তানের হামুদুর রহমান রিপোর্টের জন্য গণহত্যার প্রমাণ সরবরাহ করেছিল বাংলাদেশ। পাকিস্তানি সেনাদের নৃশংসতা ও নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার শাস্তির সুপারিশও করে ওই কমিশনে। কিন্তু পাকিস্তান তা আমলে নেয়নি। পাকিস্তানি সেনাদের বর্বর হত্যাযজ্ঞে নিহতদের স্মরণে ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের প্রস্তাব গৃহীত হয় ২০১৭ সালে, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে। এরপর থেকে এই বিষয়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জোর দাবি ওঠে।

২০২১ সালের ৭ জানুয়ারি। পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ইমরান আহমেদ সিদ্দিকী পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সঙ্গে দেখা করতে গেলে পাকিস্তানকে তিনি বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতে বলেন। কিন্তু পাকিস্তান সেই আহ্বানে সাড়া দেয়নি। এর আগে ২০০৯ সালে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনিও পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত আলী বাসারকে একই আহ্বান জানিয়েছিলেন।

২০২২ অক্টোবর মাসে ‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যার স্বীকৃতি’ শীর্ষক ৮ পৃষ্ঠার একটি প্রস্তাব তোলা হয় যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে। ডেমোক্র্যাট আইন প্রণেতা রোহিত খান্না এবং রিপাবলিকান আইন প্রণেতা স্টিভ শ্যাবট এই প্রস্তাবটি তোলেন। এতে একাত্তরের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার আহ্বানও জানানো হয়েছে।

একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যার বিষয়ে উল্লিখিত উদ্যোগ ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আনার বিষয়ে বিশেষভাবে কাজ করছেন বিদেশে বসবাসরত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কিছু মানুষ। অথচ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেই।

প্রস্তাবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যার নিন্দা জানানোর পাশাপাশি বেঁচে থাকা অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান ছাড়াও ১৯৭১ সালে নিহত ও অত্যাচারের শিকার ব্যক্তিদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করা হয়েছে।

পাশাপাশি পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী বাঙালি ও হিন্দুদের ওপর যে সহিংসতা চালিয়েছে তাকে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের প্রতিও আহ্বান জানানো হয়েছে ওই প্রস্তাবে।

আরও পড়ুন >>> প্যারী মোহন আদিত্য : অল্পশ্রুত মহান দেশপ্রেমিকের প্রতিকৃতি 

উল্লেখ্য, এর আগেই একাত্তরে বাংলাদেশের মানুষের ওপর চালানো পাকিস্তানিদের বর্বরতা গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘জেনোসাইড ওয়াচ’। সেসব অপরাধ ও গণহত্যার ঘটনা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকার করে নিতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রস্তাব পাসের আহ্বানও জানিয়েছে সংস্থা।

২০২২ প্রথম দিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান ‘লেমকিন ইন্সটিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশন’ একাত্তরে বাংলাদেশিদের ওপর পাকিস্তানিদের নির্মম হত্যাযজ্ঞকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। যা গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ে সহায়ক হবে বলে আমরা মনে করি।

একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যার বিষয়ে উল্লিখিত উদ্যোগ ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আনার বিষয়ে বিশেষভাবে কাজ করছেন বিদেশে বসবাসরত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কিছু মানুষ। অথচ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেই। অথচ এই বিষয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিশেষ উদ্যোগ প্রয়োজন। পাশাপাশি একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যার অপরাধ প্রমাণের তথ্য-উপাত্ত ও প্রামাণ্য সংগ্রহের উদ্যোগ গ্রহণ এবং তা উপস্থাপনের মাধ্যমে বিশ্ব জনমত গড়ার কার্যকরী দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচিও নিতে হবে সরকারকেই।

সালেক খোকন ।। মুক্তিযুদ্ধ গবেষক