ছবি : সংগৃহীত

জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে বর্তমান সরকার কর্তৃক গৃহীত উদ্যোগের প্রেক্ষিতে অর্জিত সাফল্য একটি বৈশ্বিক রোল মডেল। কিন্তু বিভিন্ন অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা (৬৭ শতাংশ) এই সাফল্য অনেকাংশেই খাটো করছে [এমিনেন্স অ্যাসোসিয়েটস ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট এবং ওয়ার্ল্ড হার্ট ফেডারেশন- ১৬ জানুয়ারি-১৩ মার্চ]। তামাক ও তামাকাজাত দ্রব্যের ব্যবহার সব অসংক্রামক রোগের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত।

বাংলাদেশ সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে এই মৃত্যুর হার এক-তৃতীয়াংশ হ্রাস করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের পূর্বেই তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।

এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য তামাকজাত দ্রব্যের উপর উচ্চহারে করারোপের মাধ্যমে ক্রয়মূল্য ভোক্তার ক্রয় সক্ষমতার ঊর্ধ্বে নিয়ে যাওয়া জরুরি। কিন্তু বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ভিন্ন মূল্যস্তরভিত্তিক তামাকজাত দ্রব্য বাজারজাত করার মাধ্যমে কর বৃদ্ধি প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করে।

আরও পড়ুন >>> আইন মানুষের জন্য নাকি আইনের জন্য মানুষ?

এছাড়া কোম্পানির কাছে খুচরা তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার সব থেকে মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে প্রমাণিত। খুচরা তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় এবং মোড়কে উল্লেখিত মূল্যের থেকে অধিক মূল্যে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ের ফলেই সরকার প্রতিদিন প্রায় ২০ কোটি টাকা রাজস্ব হারায় [প্যাকেটে মুদ্রিত দামে সিগারেট বিক্রি নিশ্চিত করা জরুরি, নিজস্ব প্রতিবেদক, শেয়ার বিজ নিউজ, ১৩ মার্চ ২০২৩]।

উল্লেখ্য, তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে ‘সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য’ উল্লেখিত না থাকায় বিক্রেতারা সরকার নির্ধারিত মূল্যের থেকে অধিক মূল্যে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় করছে। ফলে সরকার প্রতিদিন প্রায় ২০ কোটি টাকা অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে।

২০১৯ সালের ১৩ জুন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক জারিকৃত এসআরও অনুযায়ী সিগারেটের মোড়কে স্ট্যাম্প ও ব্যান্ডরোল ব্যবহার পদ্ধতি বিধিমালা, ২০১৯ এর ৫(১)-এ সিগারেটের “সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য’ নির্ধারণের বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

এই বিধিমালা অনুযায়ী ‘কোনো উৎপাদক বা বিক্রেতা উপ-বিধি (১)-এর অধীনে নির্ধারিত মূল্যস্তরের অতিরিক্ত কোনো সিগারেটের মূল্য নির্ধারণ করিতে পারিবেন না। এছাড়া, ভোক্তা অধিদপ্তরের আইন অনুযায়ী, বিএসটিআই’র পণ্য মোড়কজাতকরণ বিধিমালা, ২০২১-এর বিধি-৫-এর উপবিধি (৬) অনুযায়ী মোড়কজাত পণ্যের মোড়কের গায়ে ‘সর্বোচ্চ খুচরা বিক্রয়মূল্য মুদ্রিত থাকতে হবে এবং সেটিই হবে ভোক্তা মূল্য।”

আরও পড়ুন >>> ধূমপায়ী নারী ও আধুনিকতা

সিগারেট কোম্পানিগুলো মূসক আইন ও বিধিতে প্রভাব খাটিয়ে এসআরওতে ‘সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য’র পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘খুচরা মূল্য’ লিখিয়ে নিয়েছে। ডিসেম্বর ২০২২ থেকে জানুয়ারি ২০২৩ এর মধ্যকার সময়ে ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট (Work for a Better Bangladesh Trust) এবং বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট কর্তৃক ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় খুচরা দোকানে বিক্রিত বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিগারেটের মূল্য পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে যে, ক্রেতাদের কাছ থেকে স্থানভেদে তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে মুদ্রিত মূল্যের থেকে ১০-৩৫ টাকা অধিক মূল্য আদায় করা হচ্ছে। প্যাকেটের গায়ে শুধুমাত্র ‘খুচরা মূল্য’ লেখা থাকার সুযোগ নিয়েই এই অতিরিক্ত মূল্য আদায় করছে তামাক কোম্পানি।

অথচ, তামাক কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, প্যাকেটের গায়ে মুদ্রিত মূল্য হলো খুচরা বিক্রেতার ক্রয় মূল্য। অথচ, অন্যান্য সব ক্ষেত্রে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা পণ্যের মোড়কে মুদ্রিত মূল্যের থেকে কম মূল্যে পণ্য ক্রয় করেন এবং লাভসহ মোড়কে উল্লিখিত মূল্যে বিক্রয় করেন।

বাংলাদেশে বর্তমানে ১০ পয়সা, ২৫ পয়সা, ৫০ পয়সার প্রচলন না থাকার কারণে খুচরা সিগারেট শলাকা বিক্রয়ের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত মূল্য আদায়ের সুযোগ পায় বিক্রেতারা। এই অতিরিক্ত মূল্যের উপর কোনো প্রকার কর ধার্য না হওয়ায় কারণে প্রতিবছর প্রায় ৫০০০ কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।

এছাড়া সরকার নির্ধারিত ৪টি মূল্যস্তরের বিষয় অমান্য করে এর মাঝামাঝি মূল্যে ‘রয়েল’ ও ‘লাকি স্ট্রাইক’ নামক আরও দুটি ভিন্ন মূল্যস্তরের সিগারেট বাজারজাত করা শুরু করেছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ।

এই দুই ব্র্যান্ডের প্যাকেট মূল্য যথাক্রমে ১০৪ টাকা ও ১৬৪ টাকা এবং বিক্রয়মূল্য যথাক্রমে ১২০ টাকা ও ২০০ টাকা। যা সম্পূর্ণভাবেই প্রচলিত আইনের পরিপন্থী।

আরও পড়ুন >>> তামাক কেন ক্ষতিকারক? 

নিম্নে শলাকা এবং প্যাকেট প্রতি কত টাকা অতিরিক্ত মূল্য আদায় করা হয় তার একটি চিত্র তুলে ধরা হলো—

সিগারেটের ধরন

প্যাকেটে উল্লেখিত মূল্য অনুযায়ী শলাকা প্রতি খুচরা মূল্য

শলাকা প্রতি খুচরা বিক্রয়মূল্য

উল্লেখিত মূল্য অনুযায়ী সিগারেট প্যাকেটের মূল্য

সিগারেট প্যাকেটের বিক্রয়মূল্য

নিম্ন মূল্যস্তর

৪ টাকা

৫ টাকা

৮০ টাকা

৯৫-১০০ টাকা

মধ্যম মূল্যস্তর

৬.৫০ টাকা

৭ টাকা

১৩০ টাকা

১৩৮-১৪০ টাকা

উচ্চ মূল্যস্তর

১১.১০ টাকা

১২ টাকা

২২২ টাকা

২৩৫-২৪০ টাকা

অতি-উচ্চ মূল্যস্তর

১৪.২০ টাকা

১৬ টাকা

২৮৪ টাকা

৩১০-৩২০ টাকা

বাংলাদেশের অতি প্রচলিত একটি মিথ হলো, তামাক কোম্পানিগুলো বিশেষ করে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি সরকারকে সর্বোচ্চ পরিমাণ ট্যাক্স দেয়।

অথচ বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তামাক খাত থেকে অর্জিত রাজস্বের সিংহভাগ (২২ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা) আসে এই কোম্পানি থেকে। কিন্তু এই বিশাল অঙ্কের রাজস্বের ৯৪ শতাংশেরও অধিক আসে জনগণের প্রদেয় ভ্যাট থেকে। [তামাকের রাজস্ব মিথ ও কোম্পানির কূটকৌশল, সুশান্ত সিনহা, ২৮ মার্চ ২০২২]

আরও পড়ুন >>> স্বাস্থ্যের অব্যবস্থাপনা, দায়দায়িত্ব কার?

ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি দেয় মাত্র ৮১৬ কোটি টাকা। সুতরাং বহুদিন ধরে ভোক্তাদের প্রদত্ত ভ্যাটকেও তামাক কোম্পানি তাদের প্রদত্ত রাজস্ব বলে চালিয়ে আসছে।

এছাড়া ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর তামাক খাত থেকে সরকারের উপার্জিত রাজস্বের বিপরীতে তামাকজনিত রোগের চিকিৎসা বাবদ সরকারের ব্যয় হয় ৭.৫ হাজার কোটি টাকার অধিক।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বর্তমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে খুচরা সিগারেট বিক্রয় নিষিদ্ধ করা অত্যন্ত জরুরি। কারণ তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেটমূল্য যতই বৃদ্ধি করা হোক না কোনো তরুণ প্রজন্মের কাছে খুচরা শলাকার মূল্য ক্রয় সক্ষমতার মধ্যেই থাকবে।

আগামীতে স্বাস্থ্য, অর্থনীতিসহ সব ক্ষেত্রে উন্নত বাংলাদেশ গঠনে তরুণ প্রজন্মের সুস্থতা নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। এছাড়া, সরকারের রাজস্ব ক্ষতি রোধেও এটি বড় ভূমিকা রাখবে।

মিঠুন বৈদ্য ।। উন্নয়নকর্মী