ছবি : সংগৃহীত

১০ মার্চ ২০২৩। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ভিত্তিক সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক এবং এর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অর্থাৎ ১২ মার্চ ২০২৩ নিউইয়র্ক ভিত্তিক সিগনেচার ব্যাংকের পতন ঘটে। দুটি দুর্ঘটনা ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের মধ্যে ওয়াশিংটন মিউচুয়াল ব্যাংক ব্যর্থতার পর মার্কিন ব্যাংকের সবচেয়ে বড় ব্যাংক বিপর্যয়।

১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম বৃহত্তম ব্যাংক ছিল। ২০২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত এর মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল প্রায় ২০৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যদিকে ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত সিগনেচার ব্যাংকের ২০২২ সালের শেষে সম্পদের পরিমাণ ছিল ১১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি।

বৈশ্বিক আর্থিক মন্দার সময় বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থাৎ মার্কিন অর্থনীতিতে মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে দুটি ব্যাংকের পতন বিশ্বের অন্যান্য অর্থনীতির জন্যও অশনি সংকেত এবং দুশ্চিন্তার বিষয়।

আরও পড়ুন >>> আইএমএফের ঋণ : স্বস্তির না শঙ্কার?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে দুটি ব্যাংক বিপর্যয়ের পর এর কারণ, করণীয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য অর্থনীতিতে এর প্রভাব নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিশ্লেষণ ও মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে।

সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক বিশেষভাবে স্টার্টআপ এবং উদ্যোগ সমর্থিত সংস্থাগুলোর পরিষেবা দেওয়ার জন্য সুপরিচিত ছিল। ২০১৯ এবং ২০২২ সালের মধ্যে করোনা মহামারি চলাকালীন এবং পরে সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের বড় প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। তখন এটি আকারে বৃদ্ধি পেয়েছিল প্রায় তিনগুণ। ফলে, এতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আমানত এবং সম্পদ বৃদ্ধি ঘটে।

সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের পতনের গুজব ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে সিগনেচার ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংকের গ্রাহকদের মাঝেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আতঙ্কিত গ্রাহকরা সিগনেচার ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ উত্তোলন করে নেয়।

যদিও সেই আমানতের অল্প পরিমাণ নগদ অর্থে জমা রাখা হয়েছিল। বেশিরভাগ অতিরিক্ত আমানত ট্রেজারি বন্ড এবং অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি ঋণ কিনতে ব্যবহৃত হয়েছে। সম্পদগুলোয় কম ঝুঁকি থাকে বিধায় তুলনামূলকভাবে রিটার্নের হারও কম ছিল।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব নিয়ন্ত্রণে ২০২২ সালে ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার বেড়েছে কয়েক বার। ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক হার দাঁড়ায় ৪.৫০ - ৪.৭৫ শতাংশে। ফলে, উচ্চ সুদের হার সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের দীর্ঘমেয়াদি বন্ডকে ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগে পরিণত করে। কারণ, উচ্চ সুদের হারের সময় সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের নিম্ন সুদের হারে বিনিয়োগকৃত বন্ডের মূল্য হ্রাস পায়।

আরও পড়ুন >>> ঋণ খেলাপি সংস্কৃতি 

সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের ২১ বিলিয়ন ডলার বন্ড পোর্টফলিও গড়ে মাত্র ১.৭৯ শতাংশ। অন্যদিকে, বর্তমান ১০ বছরের ট্রেজারি বন্ডের ফলন প্রায় ৩.৯ শতাংশ।

ব্যাংকটির সমস্যা আরও ঘনীভূত হয় যখন এর ট্রেজারি বন্ড ও অন্য দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বিনিয়োগের বাজার মূল্য হ্রাসকলীন সময়ের মধ্যেই কিছু গ্রাহক যাদের অনেকেই প্রযুক্তি শিল্পে মন্দার কারণে আর্থিক সমস্যায় পড়েছে তারা তাদের ব্যাংক হিসাব থেকে তহবিল উত্তোলন শুরু করে।

এই বৃহৎ টাকা উত্তোলনের ধাক্কা সামাল দিতে সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক তার কিছু বিনিয়োগ হ্রাসকৃত মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হয় এবং ১.৮ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতির সম্মুখে পড়ে। ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা দুর্বল হতে থাকে। দুর্বল ব্যালেন্স শিট শক্তিশালী করার জন্য ব্যাংক নতুন ২.২৫ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ সাধারণ এবং পছন্দের উভয় স্টক বিক্রি করার ঘোষণা দেয়। 

এই ঘোষণার পর মুডি'স সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের দীর্ঘমেয়াদি আমানত এবং ইস্যুকারীর রেটিং কমিয়ে দেয়। ব্যাংকের দুর্বলতার গুজব অতি তাড়াতাড়ি বিদ্যুৎ গতিতে ছড়িয়ে পড়ে। প্রধান বিনিয়োগ কোম্পানিগুলোর মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়। সিলিকন ভ্যালি ফাইন্যান্সিয়াল গ্রুপের শেয়ারের দাম পড়ে যায় ৬০ শতাংশ। তাছাড়া হাজার হাজার আতঙ্কিত গ্রাহক মাত্র কয়েক ঘণ্টায় ব্যাংক থেকে প্রায় ৪২ বিলিয়ন ডলার তুলে নিলে ব্যাংক চরম অর্থ সংকটে পড়ে যায়।

বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে ১০ মার্চ ২০২৩ সকালে ক্যালিফোর্নিয়া ডিপার্টমেন্ট অব ফাইন্যান্সিয়াল প্রটেকশন অ্যান্ড ইনোভেশন ব্যাংকের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় এবং ফেডারেল ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স কর্পোরেশনের অধীনে রিসিভারশিপে রাখে।

সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক পতনের দুই দিন পর অর্থাৎ ১২ মার্চ ২০২৩ নিয়ন্ত্রকেরা নিউইয়র্কের সিগনেচার ব্যাংক বন্ধ করে দেয়। নিউইয়র্ক স্টেটের আর্থিক নিয়ন্ত্রকদের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সিগনেচার ব্যাংকের পতনের প্রধান কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের পতনের একটি বড় ফলাফল।

আরও পড়ুন >>> জনগণের টাকায় আনন্দ উল্লাস!

সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের পতনের গুজব ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে সিগনেচার ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংকের গ্রাহকদের মাঝেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আতঙ্কিত গ্রাহকরা সিগনেচার ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ উত্তোলন করে নেয়। একই সাথে ব্যাংক বন্ধ হওয়ার আগে পাবলিক ট্রেডিংয়ের শেষ দিনে সিগনেচার ব্যাংকের স্টকের বাজার মূল্যও তলানিতে ডুবে যায়। সিগনেচার ব্যাংকের মৃত্যু ঘটে। হঠাৎ করে এই ব্যাংকের কার্যক্রম বন্ধের ঘোষণায় বিপাকে পড়ে যান আমানতকারীরা। এর মৃত্যু মার্কিন ইতিহাসে তৃতীয় বৃহত্তম ব্যাংক ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত হয়।

সিগনেচার ব্যাংকের অনেক গ্রাহকই ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই ব্যাংকের আমানতের প্রায় এক চতুর্থাংশ এসেছে এই খাত থেকে। কিন্তু ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকটি ক্রিপ্টোর ৮ বিলিয়ন ডলারের আমানত কমানোর ঘোষণা দেয় যা ব্যাংক পতনের একটি কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

সিগনেচার ব্যাংকের পতনের পর ফেডারেল ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স কর্পোরেশন ব্যাংকের রিসিভার হিসেবে নিযুক্ত হয়। ফেডারেল ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স কর্পোরেশন সিগনেচার ব্রিজ ব্যাংক, এনএ নামে একটি নতুন ব্যাংক চালু করে। সিগনেচার ব্রিজ ব্যাংক একটি পূর্ণ পরিষেবা ব্যাংক হিসেবে কাজ করবে।

সিগনেচার ব্যাংকের একীভূত হওয়ার পর ১৩ মার্চ ২০২৩ থেকে নতুন চালু হওয়া সিগনেচার ব্রিজ ব্যাংক অনলাইন ব্যাংকিংসহ সমস্ত ব্যাংকিং কার্যক্রম আবার শুরু করে।

নিয়ন্ত্রকরা যদিও সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের জন্য কোনো ক্রেতা এখনো খুঁজে পায়নি, তথাপি যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধ হয়ে যাওয়া সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের যুক্তরাজ্য শাখা মাত্র ১ পাউন্ডে কিনে নেয় এইচএসবিসি ব্যাংক। পুনরুদ্ধার চুক্তির আওতায় নামমাত্র মূল্যে ব্যাংকটি বিক্রি করা হয়। এই চুক্তি নিশ্চিত করে যে গ্রাহকের আমানত সুরক্ষিত থাকবে এবং তারা স্বাভাবিক লেনদেন করতে পারবে।

সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক পতনের পর ফেডারেল নিয়ন্ত্রকরা সমস্ত আমানতকারীদের সম্পূর্ণ অর্থ ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এমনকি, সেই তহবিলের জন্যও যেগুলো ফেডারেল ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স কর্পোরেশন দ্বারা সুরক্ষিত ছিল না।

ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম ব্যাংক পতনের পর ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আস্থা উন্নত করতে এবং ব্যাংক টার্ম ফান্ডিং প্রোগ্রামসহ ভবিষ্যতে ব্যাংক ব্যর্থতা রোধ করতে পদক্ষেপ নিয়েছে।

আরও পড়ুন >>> আইএমএফের ঋণ : ইতিহাস যা বলে 

দুই দিনের ব্যবধানে যুক্তরাষ্ট্রের দুই ব্যাংকের কার্যক্রম বন্ধের পর বিশ্বজুড়ে বেশকিছু ব্যাংকের শেয়ারের ব্যাপকভাবে দরপতন হয়েছে। কারণ, বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকিং খাতের আর্থিক নিরাপত্তা নিয়ে এখন উদ্বিগ্ন। বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতিতে উন্নত বিশ্বের ব্যাংক পতনের আঘাত আমাদের দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার জন্যও একটি অশনি সংকেত।

আমাদের অর্থনীতি ব্যাংকিং ব্যবস্থাসহ এমনিতেই নাজুক অবস্থায় রয়েছে। মূল্যস্ফীতির আগ্রাসনের সময় ব্যাংক ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ হ্রাস, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিসহ বিবিধ সমস্যায় আমাদের অর্থনীতি জর্জরিত।

আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থা যে মজবুত অবস্থায় নেই তার একটি উদাহরণ হচ্ছে আইএমএফের কাছে ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণ সাহায্য চাওয়া। আইএমএফ কিছু শর্তসাপেক্ষে ২০২৬ এর মধ্যে ৭ কিস্তিতে ঋণ দিচ্ছে। আইএমএফের শর্ত পূরণ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকের ভোক্তা ঋণের সর্বোচ্চ সুদে হার নির্ধারণ করেছে ১২ শতাংশে যা এতদিন ছিল ৯ শতাংশে। অন্যদিকে, আমানতের ক্ষেত্রে প্রদেয় ন্যূনতম সুদের হারও প্রত্যাহার করেছে।

বর্তমানে আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে খেলাপি ঋণ। দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১০ বছরে ৩ গুণেরও বেশি বেড়েছে।

তবে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের অভিজ্ঞতা বলছে যে, সুদের হার বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতির উপর তেমন একটি প্রভাব ফেলতে পারেনি। অধিকন্তু, ব্যাংকিং ব্যবস্থা বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সিলিকন ভ্যালি ও সিগনেচার ব্যাংকের পতন তার একটি বড় উদাহরণ। তাছাড়া সুদের হার বৃদ্ধি হওয়ার কারণে ঋণের উপর নির্ভরশীল আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।

বর্তমানে আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে খেলাপি ঋণ। দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১০ বছরে ৩ গুণেরও বেশি বেড়েছে। ২০১২ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪২৭.২৫ বিলিয়ন টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ৩ মাসে এই খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩৪৩.৯৬ বিলিয়ন টাকা।

আরও পড়ুন >>> সন্নিকটে সংকট, শঙ্কিত কি অর্থনীতি! 

খেলাপি ঋণ কমানো ও চলমান ব্যাংকিং আইনের সংস্কার আইএমএফের ঋণের শর্তেরই অংশ। আইএমএফ মতে, পরিচালনা পর্ষদে একচেটিয়া মালিকানা হ্রাস, কর্পোরেট সুশাসন আরও বলিষ্ঠ করা, বর্তমান ব্যাংকিং অবকাঠামোর উপর তদারকি আরও কঠোর ও এর প্রয়োগ নিশ্চিত করা জরুরি।

তাছাড়া, ঋণদাতাদের অধিকার প্রয়োগের জন্য আরও বলিষ্ঠ সহযোগিতা ও ঋণগ্রহীতাদের ঋণ পরিশোধের জন্য প্রণোদনা নিশ্চিতের জন্য আইনি ব্যবস্থার যথোপযুক্ত সংস্কার প্রয়োজন।

ইতিমধ্যে সরকারি নীতিনির্ধারকেরা আশ্বস্ত করেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক ধসে বাংলাদেশের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ নেই। আপাতত হয়তো কোনো দুশ্চিন্তার কারণ নেই। তবে, প্রয়োজনীয় সংস্কার, তদারকি, ঋণ প্রদান ও ফেরতে সুশাসন ও আগাম সুরক্ষা ব্যবস্থা না নিলে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক পতনের অভিজ্ঞতা হয়তো আমাদেরও নিতে হতে পারে।

নীলাঞ্জন কুমার সাহা ।। ডিন, ফ্যাকাল্টি অব বিজনেস স্টাডিজ ও অধ্যাপক, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়