ছবি : সংগৃহীত

একটা সময় ছিল বাংলাদেশে নারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা আইন পড়তে আসতো তাদের প্রতি দশজনের মধ্যে অন্তত সাতজনই বলতো যে তাদের আইন পড়ার জন্যে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে ‘উত্তর ফাল্গুনী (১৯৬৩)’ নামে কলকাতার একটা সিনেমায় সুচিত্রা সেনের অভিনীত সুপর্ণা চরিত্রটি।

শুধু উত্তর ফাল্গুনীতে ব্যারিস্টার সুপর্ণার চরিত্রেই নয়—যুগ যুগ ধরে মানুষের মনে জাগ্রত হয়ে থাকবে এরকম আরও বেশকিছু চরিত্র। সুচিত্রা সেনের সেইসব চরিত্র অবিস্মরণীয় হওয়ার পেছনে সিনেমার কাহিনি ও নির্মাণ অনেকখানি কৃতিত্ব দাবি করলেও মূল কৃতিত্ব অভিনয়শিল্পীরই।

হিন্দি ভাষায় নির্মিত ‘আঁধি (১৯৭৫)’ এবং ‘দেবদাস (১৯৫৫)’-এর কথায় ধরুন। ‘আঁধি (১৯৭৫)’ সিনেমা এমনিতেই বিতর্কিত হয়েছিল কারণ গল্পের সাথে অনেকেই সেই সময়ের ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর জীবনের মিল খুঁজে পাচ্ছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই সিনেমা মুক্তি দেওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন >>> রুচির দুর্ভিক্ষের দায় কার? 

মুক্তির পর সিনেমাটি খুবই প্রশংসিত হয় মূলত পুরো সিনেমা জুড়ে নায়িকার চরিত্রে সুচিত্রা সেনের অভিনয়ের গুণে। প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন তরুণীর নেতৃত্বের উচ্চতায় আরোহণ এবং সেই পথে নারীর জন্যে পিতৃতন্ত্রের বেঁধে দেওয়া নিয়ম আর সেই সাথে নারীর সব প্রতিবন্ধকতা জয় করা- সিনেমার গল্পে যতটুকু বলা আছে তার চেয়েও বিস্তারিত যেন সুচিত্রা সেনের অভিনয় ও অভিপ্রকাশে বিব্রত হয়।

আর দেবদাসে পার্বতীর চরিত্র! হিন্দি সিনেমার সেই সময়ের জাঁদরেল অভিনেতা দিলীপ কুমার আর বৈজয়ন্তীমালার সাথে আপনি যখন সুচিত্রা সেনকে দেখবেন, স্পষ্টই তখন দেখা যায় অভিনয় দক্ষতায় সুচিত্রা সেন যেন ছাড়িয়ে যান ওদের দুইজনকেই। 

১৯৪৭ সালে কিশোরী রমা যখন পিতামাতার সাথে পাবনা ছেড়ে কলকাতা পাড়ি দেন তখন কারও মাথায় আসেনি যে এই মেয়েটি একদিন বাংলা সিনেমার মহানায়িকা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবেন।

যেসব সিনেমার নাম উল্লেখ করলাম, এগুলো যখন নির্মিত হয় ততদিনে সুচিত্রা সেন খ্যাতির শীর্ষে। কিন্তু সূচনা তার খুব মসৃণ ছিল না। ১৯৪৭ সালে কিশোরী রমা যখন পিতামাতার সাথে পাবনা ছেড়ে কলকাতা পাড়ি দেন তখন কারও মাথায় আসেনি যে এই মেয়েটি একদিন বাংলা সিনেমার মহানায়িকা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবেন।

কলকাতায় যাওয়ার কিছুদিন পরেই পারিবারিকভাবে রমার বিয়ে হয় একজন শিল্পপতির সন্তানের সাথে। রমার স্বামীই প্রথম আবিষ্কার করে তার স্ত্রীর রয়েছে চমৎকার অভিনয় প্রতিভা। তার উৎসাহে ও সহযোগিতায় রমার সিনেমায় নামা আর সেখানেই তার সুচিত্রা নাম গ্রহণ। সেটা ১৯৫০ সালের কথা।

আরও পড়ুন >>> গল্প বলার স্বাধীনতা চাই 

প্রথম দুইটা সিনেমা বাণিজ্যিকভাবে অসফল। কলকাতার সিনেমা পাড়ার লোকেরা সুচিত্রার ‘বাঙাল’ উচ্চারণ নিয়ে হাসাহাসি করে। সেইরকম অবস্থার মধ্যেই ‘সাড়ে চুয়াত্তর (১৯৫৩)’ ছবিতে উত্তম কুমার নামের একজন নবাগত নায়কের বিপরীতে অভিনয়ের সুযোগ পান সুচিত্রা সেন। সেই ছবিতে একটা উল্লেখযোগ্য চরিত্রে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ও ছিলেন। হাস্যরসাত্মক ছবি ‘সাড়ে চুয়াত্তর (১৯৫৩)’ হিট হয়, আর সেই সাথে হিট হয় উত্তম-সুচিত্রা জুটি।

এরপর ‘অগ্নিপরীক্ষা (১৯৫৪)’ সিনেমায় জুটি বাঁধেন উত্তম-সুচিত্রা। এরপর তো আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাদের। অসংখ্য ছবি নির্মিত হয় এরপরের বছরগুলোয়। কেবল উত্তম-সুচিত্রা জুটির কারণেই কি সুচিত্রা সেন বাংলা সিনেমার মহানায়িকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন? মোটেই না।

কলকাতা থেকে নিয়মিত বাংলা ভাষায় নির্মিত নারী প্রধান কিছু সিনেমায় অভিনয় করেন সুচিত্রা সেন—যেগুলো সিনেমার গল্প আবর্তিত হয় একজন নারীকে কেন্দ্র করে।

নারী প্রধান এইরকম সিনেমা সাধারণত কখনোই খুব একটা বাণিজ্যিক সাফল্য পায় না। কিন্তু সুচিত্রা সেন এই ধারণা ভুল প্রমাণ করে সিনেমাকে জনপ্রিয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

‘উত্তর ফাল্গুনী (১৯৬৩)’-এর কথা তো আগেই বলেছি। ‘আঁধি (১৯৭৫)’ ছবিতে উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাজনৈতিক নেতার চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। ছবির নির্মাতা গুলজার সুচিত্রার কথা স্মরণ করতে গিয়ে বলেন, এই ছবিতে কান্নার দৃশ্যে অভিনয়ের জন্যে সুচিত্রা কখনো গ্লিসারিন ব্যবহার করেননি। কান্নার দৃশের আগে তিনি কেবল ‘তের বিনা জিন্দেগিসে কোই’ গানটার দুইটা লাইন শুনতে চাইতেন। কয়েক লাইন শুনেই তার চোখে জল আসতো, সুচিত্রা সেন তৈরি কান্নার দৃশ্যের জন্যে।

আরও পড়ুন >>> সিনেমা হোক দখিনা হাওয়ায় দুরন্ত পালতোলা নাও

‘হারানো সুর (১৯৫৭)’ সিনেমায় মানসিক চিকিৎসা হাসপাতালের একজন নার্সের চরিত্র, ‘সবার উপরে (১৯৫৫)’ সিনেমায় রিতা চরিত্র, তারাশঙ্করের গল্প নিয়ে নির্মিত ‘সপ্তপদী (১৯৬১)’ ছবিতে তার পরিচিত ইমেজ ভেঙে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান একটি মেয়ের চরিত্র—এইরকম অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যায় যেগুলোর কেন্দ্রীয় চরিত্রে সুচিত্রা সেনের অভিনয় সিনেমা দর্শকের মনে চিরদিন গেঁথে থাকবে।

সত্যজিৎ রায় পরিকল্পনা করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘দেবী চৌধুরানী (১৮৮৪)’ নিয়ে সিনেমা করবেন। সুচিত্রা সেনকে তিনি প্রস্তাব করেছিলেন দেবী চৌধুরানী চরিত্রের জন্যে। সত্যজিতের শর্ত ছিল দেবী চৌধুরানীর জন্যে সময় দিতে হবে সুচিত্রাকে। এটা ১৯৬০ সালের কথা, সুচিত্রা তখন চূড়ান্ত ব্যস্ত এবং অনেকগুলো সিনেমার জন্যে সময় বরাদ্দ দিয়ে রেখেছেন, সুচিত্রার পক্ষে আর সত্যজিতের ছবিতে অভিনয় করা হয়নি। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে সত্যজিতও আর দেবী চৌধুরানী নিয়ে সিনেমাটা করেননি। 

নারী প্রধান এইরকম সিনেমা সাধারণত কখনোই খুব একটা বাণিজ্যিক সাফল্য পায় না। কিন্তু সুচিত্রা সেন এই ধারণা ভুল প্রমাণ করে সিনেমাকে জনপ্রিয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

সবকিছুর পরেও, সুচিত্রা সেন মহানায়িকা হয়েছেন শুদ্ধ অভিনয় প্রতিভার গুণে। অসাধারণ রূপবতী ছিলেন, সেকথা তো আর বিশেষ করে বলার কিছু নেই। ভারতীয় চলচ্চিত্রে সুচিত্রা সেনের মতো রূপবতী আর কোনো নায়িকা কি ছিল?

শারীরিক সৌন্দর্যের চেয়েও বড় একটা কিছু ছিল তার চরিত্রে যেটা সবাইকে আকর্ষণ করেছে। আমরা জানি যে বিবাহিতা অভিনেত্রীরা সাধারণত বাণিজ্যিক নায়িকা হিসেবে খুব একটা সুবিধা করতে পারে না—সুচিত্রা সেন অভিনয় ক্যারিয়ারই শুধু করেছেন বিয়ের পর।

আরও পড়ুন >>> শনিবার বিকেল : খুলে যাক রুদ্ধ দ্বার 

অভিনয় প্রতিভার গুণেই তিনি মানুষকে আকৃষ্ট করেছেন—মানুষকে প্রভাবিত করেছেন। আকৃষ্ট করেছেন কেবল পুরুষ ভক্তদেরই নয়, নারীদেরকেও সমানভাবে।

২০১৪ সালে তার মৃত্যু হয়, তার অনেক আগে ১৯৭৮ সালে তিনি সিনেমা ছেড়ে স্বেচ্ছা নির্বাসনে যান। এত বছর পরও এখনো বেশিরভাগ বাঙালি নারীই ‘তোমাকে দেখতে খানিকটা সুচিত্রা সেনের মতো লাগে’ কথাটি রূপের প্রশংসার চূড়ান্ত রূপ হিসেবে দেখে।

সুচিত্রা সেনকে মহানায়িকা করেছে তার অভিনয় ক্ষমতা আর অভিনয় দিয়ে মানুষকে স্পর্শ করতে পারার এই অসীম ক্ষমতা। এই ক্ষমতাই তাকে সিনেমার সাধারণ একজন নায়িকার আসন থেকে উপরে স্থাপন করেছে—মহানায়িকার আসনে।

ইমতিয়াজ মাহমুদ ।। আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট