ছবি : সংগৃহীত

অল্প বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় ঢাকা শহর। বৃষ্টি থামলেই আবার অসহ্য গরম। শীতকালে ঢাকার আরেক নাম ধুলার শহর। বায়ুদূষণ সবচেয়ে বেশি থাকে তখন। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেস্কের (একিউআই) পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকার বাতাস তখন গড়ে প্রতি তিনদিনে একদিন বিশ্বের সেরা দূষিত বাতাস হয়। তার মানে দুর্ভোগ লেগে থাকে সবসময়।

ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টের বায়ুর গবেষণা চালিয়ে বাতাসে নতুন ক্ষতিকর উপাদান পেয়েছেন মাইক্রোবায়োলজি গবেষকরা। ধুলায় ৮ ধরনের ব্যাকটেরিয়া পেয়েছেন তারা, যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক। এর কারণে এই শহরের মানুষের পেটের পীড়া, ফুসফুসে আক্রান্ত হওয়াসহ শ্বাসকষ্টজনিত নানা অসুখ দেখা দিতে পারে।

ইদানীং দেখা যাচ্ছে বৃষ্টি হলেও গরম কমছে না। ঢাকায় এত গরম কেন? এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, এই শহরের প্রকৃতি হারিয়ে গেছে। অপরিকল্পিতভাবে ভবন নির্মাণের প্রতিযোগিতা চলছে। জলাশয় ভরাট হচ্ছে।

আরও পড়ুন >>> বঙ্গবাজারে আগুন : দোকান নয়, পুড়েছে লাখো মানুষের স্বপ্ন

এখন আর পাখির ডাক শোনা যায় না। গাছ কাটা হচ্ছে নির্বিচারে। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা জানান, একটি দেশের পরিবেশ স্বাভাবিক রাখতে মোট ভূমির ২৫ শতাংশ বনাঞ্চল থাকা দরকার। বাংলাদেশে আছে মাত্র ১০–১২ শতাংশ।

ঢাকায় তার পরিমাণ অর্ধেকেরও কম। বৃষ্টি হচ্ছে কিন্তু শহরের গরম কমছে না। এর কারণ এই শহরের পরিবেশ ও প্রকৃতি ধ্বংসের শেষ পর্যায়ে। একদিনে হয়নি এটি। বছরের পর বছর ধরে চলছে দূষণের এই কাণ্ড।

ঢাকার চুড়িহাট্টা, নিমতলীর ভয়াবহ আগুনে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। তখনো আগুন নেভাতে পানির ব্যবস্থা করতে হিমশিম খেতে হয়েছিল ফায়ার সার্ভিসকে। আগুন নেভানোর জন্য এখন আধুনিক অনেক বিকল্পব্যবস্থা এলেও পুকুরগুলো নেই।

৪ এপ্রিল ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে গেল ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অধীন বঙ্গবাজারে। আগুনের ঘটনায় প্রায় ২২ হাজার বর্গফুট আয়তনের বঙ্গবাজারের প্রায় পাঁচ হাজার দোকানের সবগুলোই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ঠিক রাস্তার উল্টো দিকেই ফায়ার সার্ভিসের প্রধান ঘাঁটি। সেখানে আগুন নিয়ন্ত্রণের সব আধুনিক ব্যবস্থা মজুত করা। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হলো কোথায়।

ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক মো. মাইন উদ্দিন বলেছেন, তিনটি কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বিলম্ব হয়েছে। এগুলো হলো—পানির স্বল্পতা, উৎসুক জনতার ভিড় আর অতিরিক্ত বাতাস।

আশপাশে শহীদুল্লাহ হলের পুকুর ছাড়া আর পানির উৎস নেই। ফলে দ্রুত আগুন নেভানোর জন্য হেলিকপ্টার দিয়ে হাতিরঝিল থেকে পানি নেওয়ার ঘটনাও আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এর আগেও ঢাকার বড় আগুনের ঘটনাগুলোয় পানির স্বল্পতায় ভুগতে হয়েছে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের।

আরও পড়ুন >>> শহর যেন মৃত্যুফাঁদ 

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বর্তমানে এই শহরের নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কয়েকদিন পরপরই এখানে–সেখানে আগুন লেগে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বছর কয়েক আগের নিমতলী থেকে আজকের বঙ্গবাজারের কথা মনে করুন। সবই তো আগুনে পোড়ার ঘটনা।

ঢাকার চুড়িহাট্টা, নিমতলীর ভয়াবহ আগুনে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। তখনো আগুন নেভাতে পানির ব্যবস্থা করতে হিমশিম খেতে হয়েছিল ফায়ার সার্ভিসকে। আগুন নেভানোর জন্য এখন আধুনিক অনেক বিকল্পব্যবস্থা এলেও পুকুরগুলো নেই। যার দরুন অগ্নিনির্বাপণের সময় আমরা হাতের কাছে পাচ্ছি না পানির পর্যাপ্ত উৎস।

নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, ‘শহরের মোড়ে কিংবা গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো বা পরিকল্পনা অনুযায়ী কিছুদূর পরপর ফায়ার হাইড্রেন্ট বসানো উচিত। এটা বিস্ময়কর যে এই শহরে ফায়ার হাইড্রেন্ট একদমই নেই। ফলে আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিসকে দৌড়াতে হয় পুকুর জলাশয়ের খোঁজে। কিন্তু সেগুলোও তো দখল কিংবা ভরাট করে ফেলা হয়েছে। এই কারণেই পানি পেতে এমন বেগ পেতে হয়।’

আবার অনেক জায়গায় রাস্তা ঘাট এত সরু থাকে যে পানির গাড়ি সেখানে প্রবেশ করতে পারে না। আবার ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী ভবনগুলোয় ওয়াটার রিজার্ভার থাকার কথা থাকলেও ঢাকার হাজার হাজার ভবনে তার অস্তিত্ব নেই।

আরও পড়ুন >>> এই মৃত্যু উপত্যকাই আমার দেশ!

ঢাকাসহ দেশে ছোট-বড় শহরের চারপাশের জলাভূমি ও নিম্নাঞ্চল চোখের নিমিষেই ভরাট হয়ে যাচ্ছে। পিছিয়ে নেই গ্রামও। বছরে ৪৬ হাজার একর জলাভূমি ভরাট হচ্ছে তিন দশকে জলাভূমি কমেছে প্রায় ৮৬ লাখ হেক্টর। ইতিমধ্যে ঢাকা ও এর আশপাশে জলাভূমি, নিম্নাঞ্চল ও কৃষি জমি ভরাট হয়েছে ৯০ শতাংশ।

শাহবাগের যেখানে আজিজ সুপার মার্কেট, একসময় সেখানে ছিল বিরাট পুকুর। সেই পুকুর ভরাট করে গড়ে তোলা হলো সুরম্য ভবন। জলাধার সংরক্ষণে আইন থাকলেও নানা প্রতিষ্ঠান ও প্রভাবশালীরা অনেক জলাশয় দখল করেছেন।

পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৯০ সালেও ঢাকায় পুকুর ছিল দুই হাজারের মতো। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, দখলদারি ও আবাসন চাহিদার কারণে এই পর্যন্ত ৩৩ বছরে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে ঢাকার ১ হাজার ৯০০ সরকারি-বেসরকারি পুকুর ও জলাধার। এসব পুকুরের মোট জমির পরিমাণ ছিল ৭০ হাজার হেক্টর।

পুকুর একসময় ছিল পানি ধরে রাখার অন্যতম মাধ্যম। ফলে জলাবদ্ধতা নিরসনে এগুলোর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। মৎস্য বিভাগের পরিসংখ্যান মতে, ১৯৯০ সালের দিকে ঢাকায় হাজার দুয়েক পুকুর থাকলেও এই বছর পর্যন্ত তা এসে ঠেকেছে টেনেটুনে ১০০–তে।

১৯৯০ সালেও ঢাকায় পুকুর ছিল দুই হাজারের মতো। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, দখলদারি ও আবাসন চাহিদার কারণে এই পর্যন্ত ৩৩ বছরে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে ঢাকার ১ হাজার ৯০০ সরকারি-বেসরকারি পুকুর ও জলাধার।

ঢাকা শহরের ইতিহাস যদি দেখি, ১৯২৪ সালের দিকে ব্রিটিশ মানচিত্রে ১২০টির মতো পুকুরের উপস্থিতি দেখা যায় (বর্তমান পুরান ঢাকা)। ১৯২৪ সাল থেকে ২০২৩ প্রায় ৯৯ বছরে প্রায় ১০০টির মতো পুকুর হারিয়ে গেছে। আর যে কয়টা পুকুর বা খাল আছে এখনো, তাদেরও শরীর যেন ক্রমশ ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন >>> যেটা দিতে পারব না, সেটা কেড়ে নেওয়ারও অধিকার নেই 

স্বাধীনতার পূর্বে ঢাকায় ৪৭টি খাল ছিল, যার বেশিরভাগের প্রস্থ ছিল ১৫০ ফুটেরও বেশি। এগুলো দিয়ে একসময় শহরের পানি নিষ্কাশন হতো অথচ এখন অল্প বৃষ্টিতেই থমকে যায় পুরো শহর। খাল সংখ্যা কমতে কমতে এখন ২২টির মতো টিকে আছে, তাও খুব সংকুচিত আকারে।

পৃথিবীতে খুব কম শহর আছে, যার চারপাশে চারটি নদী রয়েছে। ঢাকা সেদিক থেকে অত্যন্ত সৌভাগ্যবান। কিন্তু অব্যাহত অবহেলা ও উদাসীনতার কারণে সেই সৌভাগ্য আজ দুর্ভাগ্যে রূপ নিয়েছে।

নদীর পানি এতটাই নষ্ট ও দুর্গন্ধযুক্ত যে সেখানে ভ্রমণ তো দূরের কথা, নদীর পাড় দিয়ে হাঁটাও কষ্টসাধ্য। ক্রমাগত দখল, দূষণ ও ভরাটের কারণে সব নদী মৃতপ্রায়। শুষ্ক মৌসুমে পানি থাকে না বললেই চলে।

তুরাগ নদ ও এর সঙ্গে সংযুক্ত খাল-বিলে শত শত কারখানার অশোধিত তরল বর্জ্য নিয়মিতভাবে পড়ছে। কুচকুচে কালো পানি ব্যবহারের অনুপযোগী। টঙ্গী ও গাজীপুরের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলের চিত্র একই। অনেক কারখানায় ইটিপি থাকলেও খরচ বাঁচাতে সেগুলো বন্ধ রাখা হয়।

আরও পড়ুন >>> মরণ ফাঁদের নির্মাণকাজ 

শুধু তরল বর্জ্য নয়, গৃহস্থালি বর্জ্যসহ কঠিন বর্জ্যও ব্যাপক হারে ফেলা হচ্ছে নদীতে। ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই তুরাগ ও বালু নদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। রাজধানী ঢাকা মহানগরীর অস্তিত্ব অনেকাংশেই নির্ভর করে চারপাশের নদীগুলোর অস্তিত্বের ওপর।

তাই এখনো ঢাকা শহরে যেসব পুকুর, খাল টিকে আছে, সেগুলো বাঁচাতে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। তবেই রাজধানী হবে সবুজ শ্যামলীমাপূর্ণ, জলাভূমি সমৃদ্ধ এক আধুনিক নগর। আশা করি প্রকৃতি, নদী আর শহরের প্রতি আমাদেরও ভালোবাসা জাগ্রত হবে একদিন।

ড. মো. আনোয়ার খসরু পারভেজ ।। অধ্যাপক ও গবেষক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়