২১ মার্চ ১৯৭১, রবিবার

১২টার সময় মেজভাইসহ কুমিল্লা রওনা হই। কুমিল্লা থেকে ভাই চলে গেছেন। আমি আজকে কুমিল্লা ছিলাম। সন্ধ্যার সময় কুমিল্লা টাউন হল ময়দানে কুমিল্লা শহর আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কুচকাওয়াজের অনুষ্ঠান দেখি। পরে স্টুডিও প্যারাডাইজে ফটো তুলি।

একাত্তরে আমি দশম শ্রেণিতে পড়তাম। অজপাড়া গাঁয়ের স্কুলে। তারপরও ওই বয়সেই ডায়েরি লিখতাম। একটু অস্বাভাবিকই মনে হতে পারে আজও। কিন্তু ডায়েরি লেখার শখ কিংবা ইচ্ছার পেছনে আমার পারিবারিক ঐতিহ্য কিছুটা কাজ করেছে। আমাদের বাড়ির কাচের আলমারিতে আব্বা তার বাবার প্রায় ২৫/২৬ বছরের ডায়েরি সংরক্ষণ করেছিলেন। সেগুলো মাঝে মধ্যে নাড়াচাড়া করতাম আমি। সেই থেকেই ইচ্ছা জাগে আমিও ডায়েরি লিখব। শুধু তাই নয়, দাদা ডায়েরির ভাষা হিসেবে ইংরেজি ও বাংলা ব্যবহার করতেন। আমিও তাই অনুসরণ করি। (দাদার ডায়েরিগুলো নিয়ে সম্প্রতি এশিয়াটিক সোসাইটি গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশ করেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমানের মাধ্যমে।) গ্রামের স্কুলের ছাত্র ইংরেজিতে দুর্বল থাকার পরও লিখেছি, ভুল-ভ্রান্তি আছে লেখাতে তাই।

নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় সাদা কাগজ (কেপিএম) কিনে সেলাই করে খাতা বানিয়ে কিছুদিন ডায়েরি লিখেছিলাম। সেটা কোথায় আছে পাওয়া যায়নি। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় কুমিল্লা রেলস্টেশন থেকে একটা পকেট ডায়েরি কিনি লেখার জন্য। এই পকেট ডায়েরিটি যুদ্ধকালে আমার নিত্যসঙ্গী ছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর তাড়া খেয়ে যখন এই গাঁ থেকে ওই গাঁ করে বেড়িয়েছি, তখনও এটা সঙ্গে ছিল। আবার আগরতলা কংগ্রেস ভবন থেকে যখন বিশালগড়ে বন্ধু রাধামাধবের খোঁজে যাই, তখনও সঙ্গে ছিল। এমনও হয়েছে নৌকায় করে পালাচ্ছি, খেয়াল হলো গতরাতে কিংবা দুই-তিন দিন ডায়েরি লেখা হয়নি, তখন নিরাপদ জায়গায় যাওয়ার পর নৌকায় বসেই দিনগুলোর কার্যবিবরণী কিংবা অভিজ্ঞতার বিষয় লেখা হয়েছে।

একাত্তরে আমি দশম শ্রেণিতে পড়তাম। অজপাড়া গাঁয়ের স্কুলে। তারপরও ওই বয়সেই ডায়েরি লিখতাম। একটু অস্বাভাবিকই মনে হতে পারে আজও। কিন্তু ডায়েরি লেখার শখ কিংবা ইচ্ছার পেছনে আমার পারিবারিক ঐতিহ্য কিছুটা কাজ করেছে।

প্রতি পৃষ্ঠায় দুই দিনের ভুক্তি লেখার জায়গা ওই ডায়েরিতে। তারিখ লেখা ইংরেজি আর চন্দ্র মাসের। ডায়েরিটি তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরের কোহিনূর প্রিন্টিং প্রেস’র পণ্য হওয়ায় বাংলা ভাষার লেশমাত্র ছিল না। সাধারণ একটি পকেট ডায়েরির বাজারও ওরা কব্জা করে রেখেছিল এই দেশে। আকারে ছোট হওয়ায় সঙ্গত কারণেই অনেক ভুক্তিই অসম্পূর্ণ মনে হতে পারে। এক সময় মনে হয়, আলাদা কাগজ লাগিয়ে নিতে হবে, সেটাও করা হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে বেড়ানোর সময় কাগজ পাওয়া কঠিন ছিল বিধায় অনেক ঘটনাই সংক্ষেপে লিখতে হয়েছে। ইংরেজি বাক্য শব্দ এমনকি বাংলায়ও ভুল চোখে পড়ে। কিন্তু অর্থ বুঝতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

ডায়েরি লেখার বিষয়ে শেষাংশে একটি নোটও লেখা হয়েছিল। যেহেতু মার্চ মাস থেকে ভুক্তিগুলো উপস্থাপন হচ্ছে, তাই আগের কিছু বক্তব্য যুক্ত করতে হচ্ছে প্রাসঙ্গিক বিষয় হিসেবে। আমি ছিলাম কুমিল্লা জেলাধীন তৎকালীন বুড়িচং থানার অন্তর্গত চান্দলা কে বি হাই স্কুলের ছাত্র। ১৯৬৯ সাল থেকে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে ছিলাম। তখন স্কুলেও ছাত্রলীগের শাখা কমিটি গঠিত হয়েছিল। আমি চান্দলা কে বি হাই স্কুল ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলাম। তখন স্কুলে ছাত্র সংসদও ছিল। স্কুল ছাত্র সংসদের যথাক্রমে সাধারণ সম্পাদক ও ভিপিও ছিলাম।

১৯৭১ সালে উত্তাল দিনগুলোতে গ্রাম পর্যায়ের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাই কিশোর-তরুণদের প্রতিনিধি হিসেবে কাজের সুযোগ হয়েছিল। ২১ মার্চের আগে চান্দলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত ছিল ২৩ মার্চ চান্দলা (পুরনো) স্কুল মাঠে জনসভা হবে। সেখানে স্থানীয় এমপিএ অ্যাডভোকেট আমির হোসেন ও থানা পর্যায়ের আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ বক্তৃতা করবেন। আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় কুমিল্লা থেকে তাদের নিয়ে আসার জন্য। সেই সুবাদেই আমার কুমিল্লা যাওয়া। এখানে উল্লেখ্য, চান্দলা গ্রাম থেকে কুমিল্লার দূরত্ব ওই সময় ছিল প্রায় ৪০ কিলোমিটার। যোগাযোগের মাধ্যম ছিল ট্রেন। স্টেশন সালদা নদী। লোকাল ট্রেনে করে আসা-যাওয়া করতে হতো। সালদা নদী থেকে চান্দলায় আসতে হতো ১০ কিলোমিটার পথ হেঁটে।

অন্যদিকে আমাদের গ্রামে সৈয়দ আবদুল কাফি ছিলেন বুড়িচং থানা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে কায়কোবাদ ভূঁইয়া থাকলেও মূলত নেতৃত্ব ছিল সৈয়দ আবদুল কাফির হাতে। এক সময় মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া (শ্যামল ভূঁইয়া) বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন চান্দলার আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডে। সৈয়দ আবদুল কাফির নির্দেশেই আমাকে কুমিল্লা যেতে হয়, মূলত এমপিএ-কে সঙ্গ দিতে।

আমি ছিলাম কুমিল্লা জেলাধীন তৎকালীন বুড়িচং থানার অন্তর্গত চান্দলা কে বি হাই স্কুলের ছাত্র। ১৯৬৯ সাল থেকে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে ছিলাম। তখন স্কুলেও ছাত্রলীগের শাখা কমিটি গঠিত হয়েছিল। আমি চান্দলা কে বি হাই স্কুল ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলাম। তখন স্কুলে ছাত্র সংসদও ছিল।

৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পর স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী নির্ভর হয়ে পড়েছিল। কারণ সবাই জেনে গিয়েছিল লড়াই অবশ্যম্ভাবী। তার জন্য প্রস্তুতিও নিতে হবে। আর সেই প্রস্তুতির কাজটি পরিচালিত হচ্ছিল স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর মাধ্যমে। পরবর্তী সময়ে এই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীই আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ হিসেবে পরিচিতি পায়।

২১ মার্চে কুমিল্লায় যে কুচকাওয়াজের তথ্য ভুক্তিতে পাওয়া যায়, সেটি সেই প্রস্তুতিরই অংশবিশেষ। আমার যতদূর মনে পড়ে তখন কুমিল্লা জেলা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান ছিলেন অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ। আরেকটা বিষয় উল্লেখ করতে হবে, প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতির কাজ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর মাধ্যমে পরিচালিত হলেও সেখানে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগসহ আওয়ামী লীগের সমর্থকরাও যুক্ত ছিলেন। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীই ৭ মার্চের পর থেকে নিয়ামক ভূমিকা পালন করতে থাকে।

মোস্তফা হোসেইন ।। সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক