২২ মার্চ সোমবার, ১৯৭১

২১ মার্চের লেখায় অ্যাডভোকেট আমির হোসেন এমপিএ প্রসঙ্গে বলা হয়েছিল। ২২ মার্চ অনুষ্ঠেয় জনসভার অতিথি অ্যাডভোকেট আমির হোসেন ও তার সঙ্গীদের নিয়ে কুমিল্লা থেকে ট্রেনযোগে রওনা হই বাড়ির উদ্দেশে।

আরও পড়ুন: ডায়েরিতে আমার একাত্তর (প্রথম পর্ব)

মুলফত আলী ভূঁইয়া ছিলেন তৎকালীন বুড়িচং থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সামসুদ্দিন আহমেদ ছিলেন সাংগঠনিক সম্পাদক। মুলফত আলী ভূঁইয়া সৈয়দ আবদুল কাফির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন। আসলে ওই সময় আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী আওয়ামী লীগের হয়ে গুরুদায়িত্ব পালন করছিল। বিশেষ করে এলাকার তরুণদের সংগঠিত করা এবং তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব ছিল স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর ওপর। প্রদেশের দায়িত্বে ছিলেন আবদুর রাজ্জাক।

তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে থানা পর্যন্ত তার সংগঠনকে সুসংগঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আমাদের পক্ষে তখনো জানা সম্ভব হয়নি যে যুদ্ধ হতে পারে। তবে বুঝতাম দেশে বড় ধরনের কিছু একটা হতে যাচ্ছে। কিছুটা বুঝে কিছুটা না বুঝে আমাদের প্রশিক্ষণে অংশ নিতে হয়েছে। তাও বাঁশের লাঠি হাতে নিয়ে প্রশিক্ষণ। মুলফত আলী ভূঁইয়া সাহেব মূলত সেসব বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছিলেন। হয়তো তাদের জানা ছিল, এই তরুণদের নিয়ে মুক্তিবাহিনী গঠন করতে হবে। অনুমান করি এটা। না হলে বিষয়টিকে এত গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছিল কেন।

তিনি জানতে চেয়েছিলেন, ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগের সঙ্গে সৈয়দ আবদুল কাফির সম্পর্ক কেমন। যতদূর মনে আসে আমি ইতিবাচক মন্তব্যই করেছিলাম সৈয়দ আবদুল কাফি সম্পর্কে। এমপিএ সাহেব জনসভার প্রস্তুতি সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছিলেন। এখানে বলে নেওয়া দরকার, তিনি ছিলেন আব্বার বন্ধু।

সেই পঞ্চাশের দশকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তিনি আমাদের গ্রামে এনেছিলেন, তাও আমাদের বাড়িতে ছিল বঙ্গবন্ধুর থাকার জায়গা। তখন আমাদের এলাকায় কেউ বাইরে থেকে এলে তাকে গ্রামে অন্তত এক রাত অবস্থান করতে হতো।

কারণ রেলস্টেশন থেকে আমাদের বাড়ির দূরত্ব অনেক। দিনে দিনে আসা-যাওয়া সম্ভব ছিল না। এমপিএ সাহেবের বাড়ি আমাদের পাশের গ্রামে হওয়ায় তিনি আমাদের গ্রামে মিটিং করতে হলে আগেই নিজ বাড়িতে চলে আসতেন। সেখান থেকে আড়াই মাইল হেঁটে সভা করতেন।

২২ মার্চ কিছুটা গরম পড়েছিল। প্রায় ১০ কিলোমিটার পথ হেঁটে আসার সময় নেতৃবৃন্দ ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলছিলেন। দুয়েকটা কথায় আমিও যোগ দিয়েছিলাম। তাদের কথায় বুঝতে পারতাম, ভবিষ্যতে কী হতে পারে সেই সম্পর্কে তারাও সুস্পষ্ট জানতেন না।

বঙ্গবন্ধু গ্রামে গ্রামে তরুণদের প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেই কাজটিই তারা করে যাচ্ছিলেন। তবে এটাও বুঝতে পারছিলেন, দেশে সংঘাত অনিবার্য। 

যে কারণে তাদের বলতে শুনেছি, মানুষ যাতে বিপদগ্রস্তদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয় সেই মানসিকতা তৈরির জন্য সাংগঠনিকভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। মুলফত আলী সাহেব বলেছিলেন, পার্টির তহবিল গঠন জরুরি। যাতে করে কর্মীদের সহযোগিতা করা যায়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে- তহবিল গঠনের মতো পরিবেশ কিংবা সঙ্গতি ছিল না। যে কারণে এই কথা ওই কথাতেই পুরো রাস্তা চলে যায়। এমপিএ সাহেবের বাড়ির রাস্তা গিয়েছে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে। যে কারণে দুপুরে তাদের আমাদের বাড়িতে আপ্যায়ন করি। দুপুরের রোদে গাছের ডাবের পানি পান করেন তারা। যতটা মনে আসে সামসুদ্দিন সাহেব সৈয়দ আবদুল কাফির বাড়িতে থাকবেন বলে পথে আমাদের থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন।

বিকেলে আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ আবদুল কাফির বাড়িতে দলের নেতাকর্মীদের বৈঠক। শুরু হতে হতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। কায়কোবাদ ভূঁইয়া সাহেব আসেন অনেক পরে। মূলত পরের দিনের সভা সম্পর্কেই আলোচনা হয়। তার আগেই নকুল বাজাইন্যা (বাদ্যকর) ঢোল নিয়ে বেরিয়ে গেছে ঢোল পিটিয়ে মানুষকে সভার কথা জানাতে। টিনের চোঙ্গা নিয়ে ছাত্রলীগের কর্মীরা গিয়েছে বড়ধুশিয়া থেকে ষাইটশালা পর্যন্ত প্রচারের কাজে। সবচেয়ে উল্লেখ করার বিষয় হচ্ছে, এই কর্মীদের চা-নাস্তা পর্যন্ত দেওয়ার কোনো রেওয়াজ ছিল না। তারা নির্বাচনের সময় নাবিস্কো বিস্কুট পেয়েছিল, তাও কয়েক মাস আগে। তখন সঙ্গে চা পেয়েছিল। এরপর কম সময়ই চা-বিস্কুট পেয়েছে।

মোস্তফা হোসেইন ।। সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক