ছবি : সংগৃহীত

বাঙালির সংস্কৃতি একটি মিশ্র সংস্কৃতি। বাঙালি নামক মহাসমুদ্রে যুগে যুগে বহু সংস্কৃতির আগমন ঘটেছে। বহিরাগত সংস্কৃতি কখনো হয়েছে মিলনাত্মক অথবা কখনো হয়েছে বিয়োগাত্মক। এই সংস্কৃতিতে বিবিধ সংস্কৃতির মিলন বা আত্তীকরণের আধিক্য প্রচুর।

বিভিন্ন স্থানে জন্ম নেওয়া বিবিধ বর্ণের এবং স্রোতের অসংখ্য নদীর মিলন ঘটেছে বাঙালি নামক মহাসমুদ্রের জলে। তাই বর্তমান বাঙালি সংস্কৃতিতে হিন্দু, মুসলিম, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসহ এই ভূমির সব সম্প্রদায়ের অবদান বা প্রভাব রয়েছে।

রাজশক্তি বা ক্ষমতার কারণে বিভিন্ন সময় সমাজের উঁচুতলায় হয়তো মেরুকরণ বা অসহিষ্ণুতা ছিল বা আছে। কিন্তু তার বিপরীতে সমাজের তৃণমূল পর্যায়ে সর্বত্রই একটি সম্প্রতির বাতাবরণ বহমান এবং আজও সেই বাতাবরণ পদ্মা প্রবাহের ন্যায় নিত্য বহমান। তাই দেশে উৎসব বা ধর্মীয় উৎসব হয়তো কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের হলেও সব উৎসবের আনন্দ অন্যসব সম্প্রদায়ের মানুষ একসাথে উদযাপন করে। এমনিই কয়েকটি উৎসব হলো মুসলিম সম্প্রদায়ের ঈদ, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শারদীয় দুর্গোৎসব, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বুদ্ধপূর্ণিমা এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বড়দিন। এই ধর্মীয় উৎসবগুলো বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

আরও পড়ুন >>> ঈদ ও উৎসবকেন্দ্রিক অর্থনীতিতে অনলাইন ব্যবসার প্রসার 

এখন ঈদ উদযাপিত হচ্ছে। আরবি ভাষায় ঈদ শব্দটির শাব্দিক অর্থ হলো উৎসব। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। ঈদ প্রধানত দুটি—ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহা। ইসলাম ধর্মানুসারে পবিত্র রমজান মাসে একমাস রোজা বা সিয়াম সাধনার পরে শাওয়াল মাসের ১ তারিখে আনন্দ উৎসব উদযাপনকে ঈদ বলা হয়।

উৎসব যে ধর্মেরই হোক, এর আনন্দ কিন্তু সবার। দেশ স্বাধীনের পূর্ব থেকে ঐক্যবদ্ধ সম্প্রীতির ভাব বহমান ছিল। সেই ভাব অবলম্বন করে একটি শ্লোগান জনপ্রিয় হয় দুই দশকে। সেই শ্লোগানটি হলো—‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।’ অবশ্য অনেকেই বুঝে বা না-বুঝে হলেও এর বিরোধিতা করে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তৈরি করতে চায়। তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, বঙ্গবাজারে যখন আগুনের লেলিহান শিখা দাউদাউ করে ব্যবসায়ীর সব সম্বল চোখের সামনে ভস্মীভূত করে দেয়, তখন রাম রহিম উভয়েই একজন অন্যজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। কোনো ভেদাভেদ থাকে না তখন। কিন্তু আমরা ভেদাভেদ করি সুখের সময় বা ভোগের সময়।

রাজশক্তি বা ক্ষমতার কারণে বিভিন্ন সময় সমাজের উঁচুতলায় হয়তো মেরুকরণ বা অসহিষ্ণুতা ছিল বা আছে। কিন্তু তার বিপরীতে সমাজের তৃণমূল পর্যায়ে সর্বত্রই একটি সম্প্রতির বাতাবরণ বহমান...

বিদ্বেষের আগুনে অন্ধ হয়ে আমরা অনেকেই আমাদের আপনপর চিনি না। কাছের কাউকে পর করে দিয়ে সুদূরের কাউকে আপন ভাবি। পরিণামে যা হওয়ার তাই হয়। শুধু মরীচিকার পেছনেই অন্তহীন গন্তব্য হয়। এই প্রসঙ্গে স্মর্তব্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'কণিকা' কাব্যগ্রন্থের 'যথার্থ আপন' কবিতাটি।

কবিতায় কবি বলেছেন—বাঁশের মাচাকে পুষ্পক বিমান বানিয়ে কুমড়ার মনে আজ বড় অহংকার। এই অহংকারে সে তার আপনপর ভুলে গিয়েছে। তাই ভুলেও সে আজ মাটির পানে তাকায় না। দূরের চন্দ্র, সূর্য এবং তারকাকে সে আপন ভাই বলে মনে করতে থাকে। শূন্যপানে চেয়ে থেকে তার মনে হতে থাকে, চন্দ্র, সূর্য এবং তারকাই তার প্রকৃত সহোদর।

আরও পড়ুন >>> ঈদ আনন্দ : আসুক সবার ঘরে 

শুধু বোঁটাটিই তাকে কুটুম্বিতা-ডোরে নিচে বেঁধে রেখেছে। যেদিন বোঁটাটি কাটা পড়বে, সেইদিন সে উড়ে তার জ্যোতির্ময় অভীষ্টলোকে যেতে পারবে। কুমড়ার এমন চিন্তার প্রেক্ষাপটে একদিন সত্যি সত্যি তার বোঁটা কাটা গেল। সেইদিন সে বুঝতে পারলো দূরের জ্যোতির্ময় সূর্য তার কেউ নয়, তার আপন একমাত্র মাটি। যে মাটিতে সে জন্মেছে এবং বেড়ে উঠেছে।

‘কুষ্মাণ্ডের মনে মনে বড়ো অভিমান
বাঁশের মাচাটি তার পুষ্পক বিমান।
ভুলেও মাটির পানে তাকায় না তাই,
চন্দ্রসূর্যতারকারে করে ভাই ভাই।
নভশ্চর ব'লে তার মনের বিশ্বাস,
শূণ্যপানে চেয়ে তাই ছাড়ে সে নিশ্বাস।
ভাবে শুধু মোটা এই বোঁটাখানা মোরে
বেঁধেছে ধরার সাথে কুটুম্বিতা-ডোরে।
বোঁটা যদি কাটা পড়ে তখনি পলকে
উড়ে যাব আপনার জ্যোতির্ময় লোকে।
বোঁটা যবে কাটা গেল, বুঝিল সে খাঁটি,
সূর্য তার কেহ নয়, সবই তার মাটি।'

বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে পৃথিবী মানুষের হাতের মুঠোয় চলে আসছে। কিন্তু পক্ষান্তরে মানুষের মনোজগতের দূরত্ব যোজন যোজন বেড়ে যাচ্ছে। এর থেকে আশু উত্তরণ প্রয়োজন। আমরা সকলেই যদি সকলের কুয়ায় বসে নিজের কুয়াকেই সর্বশ্রেষ্ঠ বলে মনে করি তবে আমাদের কুয়ার ব্যাঙ হওয়া ছাড়া গতি নেই।

আরও পড়ুন >>> মহররম থেকে দুর্গোৎসব : সম্মিলন ও শক্তি 

সংকীর্ণ মানসিকতার কুয়ার ব্যাঙ কখনোই কোনো জাতির জন্য কল্যাণকর নয়। এই বিষয়টি আমরা যত দ্রুতই উপলব্ধি করতে পারবো, ততই মঙ্গল। এই প্রসঙ্গে  স্মর্তব্য ১৮৯৩ সালে শিকাগো ধর্মসভায় ধর্মে ধর্মে বিভেদ না করা প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দের  একটি নীতিশিক্ষামূলক গল্প।

১৮৯৩ সালে ১৫ সেপ্টেম্বর, শুক্রবার, অপরাহ্ণে ধর্মসমিতির পঞ্চমদিবসীয় অধিবেশনের সময় সব ধর্মের প্রতিনিধিরা তাদের স্ব স্ব ধর্মের প্রাধান্য এবং শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদন শুরু করে। এতে সব প্রতিনিধিদের মধ্যে বাগবিতণ্ডায় এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। ঠিক সেই সময়ে সবাইকে সমন্বয়ের ভাব বোঝাতে স্বামী বিবেকানন্দ একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ গল্প বলেন। এতে উপস্থিত সব সদস্যদের মাঝে ধর্মে ধর্মে বিরোধের মনোভাব অনেকটাই প্রশমিত হয়ে যায়। তিনি বলেন—

“আমি আপনাদিগকে একটি ক্ষুদ্র গল্প বলিব। এইমাত্র একজন সুবক্তা তাহার ভাষণ শেষে বলিলেন, ‘এসো আমরা পরস্পরের নিন্দাবাদ হইতে বিরত হই'—আপনারা সকলেই ইহা শুনিয়াছেন। আমাদের ভিতর এইরূপ মতভেদ হইতেছে দেখিয়া বক্তা-মহাশয় বড়ই দুঃখিত। আমি একটি গল্প বলিব এবং আমার মনে হয় তদ্দ্বারা এই মতভেদের কারণ কি, তাহা স্পষ্ট বুঝা যাইবে:

একটি ব্যাঙ কোন একটি কূপে বাস করিত। সে বহুকাল সেখানে ছিল। সেই কূপেই তাহার জন্ম এবং সেখানেই সে বাড়িয়াছে, তথাপি তাহার আকার অতিশয় ক্ষুদ্র ছিল। অবশ্য সে-সময় বর্তমান কালের কোন ক্রমবিকাশবাদী ছিলেন না বলিয়া অন্ধকারময় কূপে চিরকাল বাস করায় ভেকটি দৃষ্টিশক্তি হারাইয়াছিল কি না, সে বিষয়ে আমাদিগকে বলিবার কেহ নাই।

আরও পড়ুন >>> উৎসবের সর্বজনীন অর্থনীতি 

আমরা কিন্তু গল্পের সুবিধার জন্য ব্যাঙটিকে চক্ষুষ্মান বলিয়াই ধরিয়া লইব। ব্যাঙটি প্রতিদিন এরূপ উৎসাহের সহিত কূপমধ্যস্থ যাবতীয় কীটগুলি খাইয়া ফেলিয়া উহার জল পরিষ্কৃত রাখিত যে, সেরূপ উৎসাহ বর্তমান কালে কীটাণুতত্ত্ববিদ্‌ পণ্ডিতগণেরও শ্লাঘার বিষয়। সে এইরূপে ক্রমে ক্রমে কিছু স্থূলদেহ হইয়া উঠিল। একদিন ঘটনাক্রমে সমুদ্রতীরবাসী কোন একটি ব্যাঙ আসিয়া সেই কূপে পতিত হইল।

কূপমণ্ডূক জিজ্ঞাসা করিল, 'তুমি কোথা হইতে আসিলে?' সে উত্তর করিল, 'আমি সমুদ্র হইতে আসিতেছি।'

'সমুদ্র? সে কত বড়? তাহা কি আমাদের কূপের মতো বড়?'

এই বলিয়া কূপমণ্ডূক কূপের এক প্রান্ত হইতে আর এক প্রান্তে লাফাইয়া পড়িল।

তাহাতে সাগরবাসী ব্যাঙটি কহিল, 'ওহে ভাই, তুমি এই ক্ষুদ্র কূপের সহিত সমুদ্রের কিরূপে তুলনা করিতেছ?'

ইহা শুনিয়া কূপমণ্ডূক আর একবার লাফ দিয়া জিজ্ঞাসা করিল, 'তোমার সমুদ্র কি এত বড়?'

'সমুদ্রের সহিত কূপের তুলনা করিয়া তুমি কি মূর্খের ন্যায় প্রলাপ বকিতেছ!'

ইহাতে কূপমণ্ডূক কহিল, 'আমার কূপের ন্যায় কিছুই বড় হইতে পারে না, ইহা অপেক্ষা কিছুই বড় থাকিতে পারে না; লোকটা নিশ্চয়ই মিথ্যাবাদী, অতএব ইহাকে তাড়াইয়া দাও।'

ধর্মে ধর্মে বিবাদ নয়, প্রয়োজন পরস্পরের সহায়তা; একে অন্যকে বিনাশ নয়, প্রয়োজন পরস্পরের ভাবগ্রহণ; অকারণ মতবিরোধ নয়, প্রয়োজন সমন্বয় ও শান্তি।

হে ভ্রাতৃগণ, এইরূপ সঙ্কীর্ণ ভাবই আমাদের মতভেদের কারণ। আমি একজন হিন্দু আমি আমার নিজের ক্ষুদ্র কূপে বসিয়া আছি ও ইহাকেই সমগ্র জগত বলিয়া মনে করিতেছি! খ্রিস্টধর্মাবলম্বী তাহার নিজের ক্ষুদ্র কূপে বসিয়া আছেন ও তাহাকেই সমগ্র জগত বোধ করিতেছেন! মুসলমানও আপনার ক্ষুদ্র কূপে উপবিষ্ট আছেন ও তাহাকেই সমগ্র জগত মনে করিতেছেন! হে আমেরিকাবাসীগণ, আপনারা যে আমাদের এই ক্ষুদ্র জগতগুলির অবরোধ ভাঙিবার জন্য বিশেষ যত্নশীল হইয়াছেন, তজ্জন্য আমি আপনাদের ধন্যবাদ দিই। আশা করি, ঈশ্বর ভবিষ্যতে আপনাদের এই মহৎ উদ্দেশ্য সম্পাদনে সহায়তা করিবেন।”
(স্বামী বিবেকানন্দ ২০১৪: ৬-৮)

আরও পড়ুন >>> পূজার বাজার ও পূজাকেন্দ্রিক অর্থনীতি 

শিকাগো বক্তৃতায় স্বামী বিবেকানন্দ ধর্মে ধর্মে হানাহানির তীব্র বিরোধিতা করে আরও যা বলেন, তা বর্তমান কালের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ধর্মে ধর্মে বিবাদ নয়, প্রয়োজন পরস্পরের সহায়তা; একে অন্যকে বিনাশ নয়, প্রয়োজন পরস্পরের ভাবগ্রহণ; অকারণ মতবিরোধ নয়, প্রয়োজন সমন্বয় ও শান্তি।

"যদি কেহ এরূপ স্বপ্ন দেখেন যে, অন্যান্য ধর্ম লোপ পাইবে এবং তাঁহার ধর্মই একমাত্র টিকিয়া থাকিবে, তবে তিনি বাস্তবিকই কৃপার পাত্র; তাঁহার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত, তাঁহাকে আমি স্পষ্টভাবে বলিয়া দিতেছি, তাঁহার ন্যায় লোকেদের বাধাপ্রদান সত্ত্বেও শ্রীঘ্রই প্রত্যেক ধর্মের পতাকার উপর লিখিত হইবে-বিবাদ নয়, সহায়তা ; বিনাশ নয়, পরস্পরের ভাবগ্রহণ; মতবিরোধ নয়, সমন্বয় ও শান্তি।"
(স্বামী বিবেকানন্দ ২০১৪: ৫১-৫২)

শিকাগো বক্তৃতায় দেওয়া স্বামী বিবেকানন্দের এই কথাগুলো যত দ্রুতই আমরা উপলব্ধি করতে পারব ততই আমাদের মঙ্গল। তা না হলে ধর্মীয় মেরুকরণের সমান্তরাল রেললাইন ট্রাফিক সিগনাল না মেনে যার যার ইচ্ছাখুশি মতো চলতে চলতে একসময় সংঘর্ষ অনিবার্য। যার পরিণতি বড় ভয়ংকর।

তথ্যঋণ: স্বামী বিবেকানন্দ, শিকাগো বক্তৃতা, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা: সেপ্টেম্বর ২০১৪

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী ।। সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়