ছবি : সংগৃহীত

আমরা বলি, বাঙালির ঐতিহ্য হাজার বছরের। এই বলায় কোনো ভুল নেই। বাঙালির হাজার বছরের পুরোনো সমৃদ্ধ সাহিত্য আছে। ‘চর্যাপদ’ আমাদের এখনো মুগ্ধ করে। তবে বাঙালির এই ঐতিহ্য একদিনের নয়, নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ের নয়। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, খাবার, পোশাক, আচরণ মিলেই একটি জাতির ঐতিহ্য সৃষ্টি ও বিকশিত হয়।

বাঙালির সব ঐতিহ্য যে হাজার বছরের পুরোনো হতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ এলেই একটি মহল এর সাথে ধর্মের বিরোধ খুঁজে পান। তারা বলেন, ছায়ানটের বর্ষবরণ তো শুরুই হয়েছে ১৯৬৪ সালে বা মঙ্গল শোভাযাত্রা তো শুরুই হয়েছে ১৯৮৯ সালে; তাহলে এগুলো বাঙালির ঐতিহ্য হলো কীভাবে?

ঐতিহ্য কোনো নির্দিষ্ট বিষয় নয়। গ্রহণ-বর্জনেই এগিয়ে চলে ইতিহাস-ঐতিহ্য। সামাজিক বাস্তবতায় ঐতিহ্য যুক্ত হয় অনেক নতুন বিষয়, আবার বাদও যায় অনেককিছু। বর্ষবরণে বাঙালির নিজস্ব কিছু ধরন আছে। গ্রাম-বাংলার মানুষ নিজের মতো করে আনন্দে-উচ্ছ্বাসে নতুন বছরকে বরণ করে নিত।

আরও পড়ুন >>> মিলিত প্রাণের কলরবে ‘সংক্রান্তি ও বৈশাখ’ 

ছায়ানটের বর্ষবরণ আর চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা সেই আয়োজনের শহুরে রূপ দিয়েছে। এই দুটি আয়োজনই আসলে প্রতিবাদের উপায় হিসেবে এসেছে, পরে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গেছে। ছায়ানটের বর্ষবরণ এসেছে বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে পাকিস্তানি শাসকদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে। আর মঙ্গল শোভাযাত্রা এসেছে স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে।

সেই মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন শুধু বাঙালি নয়, বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ; যা আমাদের গৌরবান্বিত করেছে। ভাষার জন্য রক্ত দেওয়ার গৌরব শুধু আমাদের। ভাষা শহীদদের স্মরণ করতে প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি খালিপায়ের প্রভাতফেরিও আমাদের ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গেছে। এভাবে যুগে যুগে অনেক সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক অনিয়মের বিরুদ্ধে নানা আয়োজন আমাদের ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছে। আমরা বলি বটে, বাঙালি সংস্কৃতি। কিন্তু বাংলাদেশের বর্ষবরণের ধরন আর পশ্চিমবঙ্গের ধরন এক নয়। এমনকি বাংলাদেশেরও সব অঞ্চলের বর্ষবরণের ধরন এক নয়। 

ছায়ানটের বর্ষবরণ এসেছে বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে পাকিস্তানি শাসকদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে। আর মঙ্গল শোভাযাত্রা এসেছে স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে।

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নির্ধারিত হয় মাটি ও মানুষের ধরন থেকে। বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলের সংস্কৃতি আর বরেন্দ্র অঞ্চলের সংস্কৃতি এক নয়। কিছু জাতিগত ঐতিহ্য যেমন আছে, ধর্মীয় রেওয়াজও আছে। তবে ধর্মের সাথে জাতীয়তার কোনো বিরোধ নেই।

ধরুন, বাংলাদেশের মুসলমান, সৌদি আরবের মুসলমান, আর রাশিয়ার মুসলমানের পোশাক আর খাবার এক হবে না। পোশাকটা নির্ধারিত হয় ঐ অঞ্চলের আবহাওয়া, সংস্কৃতির ওপর। সৌদি আরবের মানুষ যে পোশাক বাংলাদেশের মানুষ কিন্তু সেটা পরবে না, পরে থাকতে পারবে না।

আরও পড়ুন >>> সংক্রান্তি থেকে বৈশাখ 

আবার সৌদি আরবের অমুসলিমরাও কিন্তু তীব্র রোদ থেকে বাঁচতে সারা শরীর আবৃত করে রাখা পোশাক পরেন। আবার বাংলাদেশের মানুষ শাড়ি-লুঙ্গিতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। রাশিয়ার মানুষ, তিনি যে ধর্মেরই হোন, তীব্র শীত থেকে বাঁচতে তাকে লম্বা গাউন পরতে হবে।

রাশিয়ার কোনো মুসলমান সৌদি আরবের মুসলমানের দেখাদেখি তাদের মতো পোশাক পরলে শীতে তিনি বাঁচতেই পারবেন না। তাই ইতিহাস, ঐতিহ্য নির্ধারিত হয়, নির্দিষ্ট এলাকার আবহাওয়া, ধরন দিয়ে। ধর্মের সাথে জাতীয়তার কোনো বিরোধ নেই। বাংলাদেশের একজন মুসলমান ধর্মপ্রাণ হয়েও মনে প্রাণে বাঙালি হতে পারেন। যারা ধর্মের সাথে বাঙালিয়ানার বিরোধ খোঁজেন; তারা ধর্মটাও বোঝেন না, নিজের শেকড়টাও চেনেন না। তাদের উদ্দেশ্য ভালো নয়।

আগেই যেমন বলেছি, যুগে যুগে অনেক সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক অনিয়মের বিরুদ্ধে নানা আয়োজন আমাদের ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছে। তেমনই একটি ঐতিহ্য জব্বারের বলীখেলা। এটি চট্টগ্রাম এলাকার ঐতিহ্য। কিন্তু সেটা এখন আঞ্চলিকতা ছাড়িয়ে সারাদেশের মানুষের আগ্রহের বিষয় হয়েছে।

বলছিলাম প্রতিবাদের কথা। চট্টগ্রামে জব্বারের এই বলীখেলা শুরু হয়েছিল ১৯০৯ সালে। বলীখেলা আসলে কুস্তিরই একটা বিশেষ ধরন, চট্টগ্রামে যা বলীখেলা হিসেবে পরিচিত। চট্টগ্রামের বদরপাতি এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আব্দুল জব্বার সওদাগর ১৯০৯ সালে নিজের নামে এই বলীখেলা চালু করেন, যা এখন জব্বারের বলীখেলা হিসেবে পরিচিত।

করোনার কারণে মাঝে দুই বছর বন্ধ থাকলেও ২৫ এপ্রিল ২০২৩, চট্টগ্রামের লালদীঘির ময়দানে বসেছিল জব্বারের বলী খেলার ১১৪তম আসর। বাঙালি যুবসম্প্রদায়ের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলা এবং শারীরিক সক্ষমতা চর্চার মাধ্যমে মনোবল চাঙা রাখতেই ব্যবসায়ী জব্বার সওদাগর বলীখেলা চালু করেছিলেন।

আরও পড়ুন >>> বৈশাখী মেলা : পূর্বাপর 

চট্টগ্রাম অঞ্চলে আগে থেকেই কুস্তি বা বলীখেলার চল ছিল। জব্বার সওদাগর সেই খেলাকে আনুষ্ঠানিকতা দেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নানা ধরনের মধ্যে খেলাধুলাও একটি। যারা আমির খানের ব্লকবাস্টার হিন্দি সিনেমা ‘লাগান’ দেখেছেন, তারা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, খেলাধুলাও প্রতিবাদের বড় অস্ত্র হতে পারে। 

অভিনব এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য ব্রিটিশ সরকার আবদুল জব্বারকে ‘খান বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করলেও তিনি  প্রত্যাখ্যান করেন, কারণ তিনি এটা চালু করেছিলেন আসলে ব্রিটিশবিরোধী চেতনা থেকে।

অভিনব এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য ব্রিটিশ সরকার আবদুল জব্বারকে ‘খান বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করলেও তিনি  প্রত্যাখ্যান করেন, কারণ তিনি এটা চালু করেছিলেন আসলে ব্রিটিশবিরোধী চেতনা থেকে। দারুণ জনপ্রিয় ‘জব্বারের বলীখেলা’ এখন চট্টগ্রাম এলাকার ঐতিহ্যের অংশ।

ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়াও বার্মার আরাকান অঞ্চল থেকেও নামীদামি বলীরা এই খেলায় অংশ নিতেন। আস্তে আস্তে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এর নাম। এখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বলীরা অংশ নেন এই প্রতিযোগিতায়। একবার ফ্রান্স থেকে দুজন কুস্তিগীরও জব্বারের বলীখেলায় অংশ নিয়েছিলেন।

জব্বারের বলীখেলা নিছক একটি খেলা নয়। বলীখেলাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী লালদীঘি ময়দানের আশে পাশে প্রায় তিন কিলোমিটার জুড়ে তিনদিনের বৈশাখী মেলা বসে। কাগজে-কলমে তিনদিনের আয়োজন হলেও চট্টগ্রাম অঞ্চলের সবচেয়ে বড় এই বৈশাখী মেলার আয়োজনের রেশ থাকে অনেকদিন।

আরও পড়ুন >>> সম্প্রীতি ফিরে আসার প্রত্যাশায়

জব্বারের বলীখেলার মতো বাংলার বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে নিজ নিজ ঐতিহ্য আয়োজন। যাত্রা, বাউল গান, কবি গান, জারি-সারি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, গম্ভীরা, নৌকা বাইচ, কুম্ভমেলা—নানান আয়োজনে বাঙালি নিজেদের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখে নিজেদের মতো করে। কিন্তু একটি মহলের সংস্কৃতি বিরোধী নানা চক্রান্তের কারণে বাঙালি সংস্কৃতি কিছুটা কোণঠাসা।

গ্রামবাংলার অনেক ঐতিহ্য এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। মাটি থেকে উঠে এই সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। গ্রামবাংলার ধর্মপ্রাণ মানুষ কখনো ধর্মের সাথে জাতীয়তার বিরোধ খোঁজে না। অল্পকিছু সাম্প্রদায়িক অপশক্তির কাছে হারবে না বাঙালির ঐতিহ্য। অতীতে অনেক চেষ্টা করেও ব্রিটিশরা পারেনি, পাকিস্তানিরা পারেনি; স্বাধীন বাংলাদেশের অপশক্তিরাও পারবে না।

 প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ