ছবি : সংগৃহীত

ঈদ আসলে আমার মনে পড়ে দাদুর কথা। খুব ছোটবেলায় আমরা গ্রামে চলে যেতাম দাদা-দাদির সাথে ঈদ করার জন্য। ঈদের দুয়েকদিন আগে দাদু তার হাতের লাঠি নুরা চাচাকে নিয়ে বের হতেন। সাথে নিতেন আমাকে।

দাদুর হাতে থাকত বেশ বড় একটা থলে আর নুরা চাচার মাথায় একটি বড় ছালা। সেগুলো ভরা থাকত মাঝারি সাইজের ছোট ছোট প্যাকেটে। সেই প্যাকেটে থাকত চাল, তেল, সেমাইসহ বিভিন্ন ধরনের খাদ্য সামগ্রী।

খুব বেশি না, তবে চার-পাঁচজনের একদিনের ঈদের খাবার হয়ে যেত। দাদু জানতেন গ্রামে কোন কোন পরিবারের এসব খাবার দরকার। তাই তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেসব পৌঁছে দিতেন। যারা সাহায্য পেতেন তারা ছাড়া আর কেউ ব্যাপারটি জানত না।

আরও পড়ুন >>> সম্প্রীতি : মানবিক ও সামাজিক সংগঠনের ব্যর্থতা! 

আমরা রওনা দিতাম সূর্যোদয়ের আগেই। সেই সময় কোথায় যাচ্ছি তা জিজ্ঞেস করার মতো লোকজনও রাস্তাঘাটে খুব বেশি থাকত না। এভাবেই আমার মধ্যবিত্ত দাদু ঈদের আনন্দ অন্যদের সাথে সীমিত সামর্থ্যে ভাগ করে নিতেন।

আমার খুব ভালো লাগে যখন দেখি, এখন অনেক সংগঠন, এমনকি ব্যক্তি পর্যায়ে এই আনন্দ ভাগ করে নিচ্ছেন। শুধু ঈদ নয়, যেকোনো বিপদে অন্যদের সাহায্যে এগিয়ে আসছেন।

দাদু জানতেন গ্রামে কোন কোন পরিবারের এসব খাবার দরকার, তাই তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেসব পৌঁছে দিতেন। যারা সাহায্য পেতেন তারা ছাড়া আর কেউ ব্যাপারটি জানতো না।

এরমধ্যে কিছু যে ভুলভ্রান্তি হচ্ছে না বা কেউ কেউ প্রতারিত হচ্ছে না, তা নয়। কিন্তু মোটাদাগে তারুণ্য পরিচালিত এসব কাজ আন্তরিকভাবেই করা হচ্ছে বলে আমার বিশ্বাস। এসব নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমার এই বিশ্বাস জন্ম দিয়েছে।

তবে যারা কাজ করছেন, তাদের অনেকের একটি সমস্যা আমি উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি, তা হলো তারা প্রচণ্ড আবেগ নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। তাদের উদ্দেশ্যে কোনো ভ্রান্তি নেই, কোনো নিজস্ব এজেন্ডা নেই। কিন্তু ব্যাপারটি তারা হয়তো পেশাদারি মনোভাব নিয়ে করছেন না বা করতে পারছেন না।

প্রায় সবাই স্বেচ্ছাসেবক দিয়ে কাজ করাচ্ছেন। স্বেচ্ছাসেবক দিয়ে কাজ করানোটা খুবই স্বাভাবিক, তবে এর পাশাপাশি সবার অভিজ্ঞ পেশাদারি জনসংযোগ টিম এবং হিসাবরক্ষণ টিম রাখা প্রয়োজন।

আরও পড়ুন >>> বাংলাদেশের আসল আয়না 

একদল তারুণ্যদীপ্ত স্বেচ্ছাসেবক দল মাঠে কাজ করবেন, অন্যদিকে পেশাদাররা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ অন্যান্য সব মাধ্যমে নিজেদের কাজ ব্যাখ্যা করবেন, হিসাবরক্ষকেরা প্রত্যেক টাকার হিসাব রাখবেন এবং দাতাদের জানাবেন। এটা না করায় অনেক মহৎ কাজও ইদানীং প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। 

সম্প্রতি সবার আস্থার সংগঠন ‘বিদ্যানন্দ’কে নিয়ে কিছু আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। এটা যে উদ্দেশ্য প্রণোদিত তা বোঝা যায়। বিদ্যানন্দের বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত মতামত হলো, শুরু থেকেই তাদের কাজ আমার ভালো লেগেছে এবং এখনো লাগে। তাদের অর্থনৈতিক কোনো জটিলতা নেই। তাদের উদ্দেশ্য নিয়েও আমার কোনো সন্দেহ নেই—কিন্তু এত বড় একটি সংগঠনের প্রচার কাজও আনাড়ি স্বেচ্ছাসেবকরা চালান, এটি বড় ধরনের ভুল বলে আমি মনে করি।

আমার খুব ভালো লাগে যখন দেখি, এখন অনেক সংগঠন, এমনকি ব্যক্তি পর্যায়ে এই আনন্দ ভাগ করে নিচ্ছেন। শুধু ঈদ নয়, যেকোনো বিপদে অন্যদের সাহায্যে এগিয়ে আসছেন।

তারই ফলশ্রুতিতে তারা 'পিআর ডিজাস্টার'—এর শিকার হয়েছেন বলে আমার ধারণা। শুনেছি, পেশাদারদের দায়িত্ব দিলে অনেক খরচ বাড়বে, এই কারণে তারা নাকি কোনো পেশাদারদের দায়িত্ব না দিয়ে স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে প্রচার কাজ চালিয়েছেন। কারণ, এতে যে টাকা বাঁচবে তা দিয়ে আরও বেশি মানুষকে সাহায্য করা যাবে।

আরও পড়ুন >>> তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে কি তা বাংলাদেশ? 

আমি মনে করি এটা মারাত্মক ভুল। একটি সংগঠন বেঁচে থাকলে অনেক মানুষকে সাহায্য করা যায়, অন্যদিকে পিআর ডিজাস্টারের মতো শামুকে পা কাটলে সংগঠনকে অনেক ধরনের উটকো ঝামেলায় পড়তে হয়। তাতে সংগঠনের কাজের গতি বিঘ্নিত হয়। আর কাজের গতি বিঘ্নিত হওয়া মানে অসংখ্য সুবিধাবঞ্চিত মানুষ তাদের সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়।

বিদ্যানন্দের পরিচালকরা এটা বুঝতে পারেননি বা এতে গুরুত্ব দেননি বলে আমার ধারণা। দিলে আজকের সমস্যা তৈরি হতো না। আমি তাদের বর্তমান সমস্যাকে ‘টেক্সটবুক এক্সাম্পল’ হিসেবে নিচ্ছি, যা প্রমাণ করে প্রতিটি চ্যারিটি সংগঠনের অনেক বেশি পেশাদার হতে হবে—শুধু স্বেচ্ছাসেবক-নির্ভর নয়।

সবশেষে ধর্মমত নির্বিশেষে যারা ঘাম ঝরিয়ে মানুষের জন্য কাজ করছেন বা যেসব সংগঠন কাজ করে যাচ্ছে তাদের সবাইকে শুভেচ্ছা। মানুষ মানুষেরই জন্য।

বাদল সৈয়দ ।। সমাজকর্মী ও কথাসাহিত্যিক
badalsyed@yahoo.com