ছবি : সংগৃহীত

ভবিষ্যতের কথা ভেবেই সাধারণ মানুষ ব্যাংক কিংবা বেসরকারি সংস্থায় (এনজিও) কিছু টাকা সঞ্চয় করেন। আর্থিক অবস্থা খারাপ হলে বা কোনো বিপদে পড়লে তা থেকে রক্ষা পেতে ওই সঞ্চয়ের টাকাই প্রধান নিয়ামক হয়ে ওঠে।

বৈশ্বিক মহামারি করোনার অভিঘাতে দীর্ঘ সময় ধরে দেশে ও বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা চলমান রয়েছে। করোনার ক্ষয়ক্ষতি এখনো সাধারণ মানুষ পুষিয়ে উঠতে পারেনি। আর করোনার বহুমুখী কারণে একদিকে প্রান্তিক ও মধ্য আয়ের মানুষের আয়-উপার্জন কমে গেছে।

অন্যদিকে লাগামহীনভাবে বেড়েই চলেছে নিত্যখাদ্যপণ্য, জ্বালানি, শিক্ষা, চিকিৎসা, গণপরিবহনসহ সব ধরনের সেবার মূল্য। যার চূড়ান্ত পরিণতি সব শ্রেণির মানুষের জীবন জীবিকার ব্যয় বেড়েছে অনেকগুণ। একটা সময় মানুষ খরচ কমিয়ে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সঞ্চয় করতেন। আর এখন আয় কমে যাওয়া ও ব্যয় বৃদ্ধির কারণে বিশেষ করে প্রান্তিক ও মধ্য আয়ের মানুষের হাতে উদ্বৃত্ত অর্থ থাকছে না, অধিকন্তু ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষ ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয়ে মনোনিবেশ করতে পারছেন না।

আরও পড়ুন >>> দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি : সাধ্যের মধ্যে কোনটা? 

বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, দেশের মানুষের সঞ্চয় কমছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির অনুপাতে মোট জাতীয় সঞ্চয় দাঁড়িয়েছে ২৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ; আগের অর্থাৎ ২০২০-২১ অর্থবছরে যা ছিল ৩০ দশমিক ৭৯ শতাংশ। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে সঞ্চয় কমেছে ৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ।

একই সময়ে, অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপির অনুপাতে অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়ও কমেছে। সেই অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়ের পরিমাণ ছিল জিডিপির ২১ দশমিক ৫৬ শতাংশ, আগের অর্থবছরে যা ছিল ২৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ। অর্থাৎ এক অর্থবছরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হারে সঞ্চয় কমেছে। 

একটা সময় মানুষ খরচ কমিয়ে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সঞ্চয় করতেন। আর এখন আয় কমে যাওয়া ও ব্যয় বৃদ্ধির কারণে বিশেষ করে প্রান্তিক ও মধ্য আয়ের মানুষের হাতে উদ্বৃত্ত অর্থ থাকছে না, অধিকন্তু ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।

বাস্তবতা হলো, করোনার অভিঘাতে ২০২০ সালে অনেক মানুষের আয় কমে গিয়েছিল। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। বেড়ে যায় নিত্যখাদ্যপণ্য ও জ্বালানি তেলের দাম।

২০২২ সাল জুড়েই ছিল উচ্চ মূল্যস্ফীতি। কিন্তু তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে মানুষের আয় বাড়েনি; বরং মজুরি বৃদ্ধির হার বেশিরভাগ সময়ই ছিল মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম। এছাড়া ব্যাংক আমানতের সুদহারও মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম। মানুষের ভরসার জায়গা ছিল সঞ্চয়পত্র, কিন্তু তার সদুও দফায় দফায় কমানো হয়েছে। এতে আনুষ্ঠানিক খাতে সঞ্চয় কমছে।

এক সময় অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় বিনিয়োগের চেয়ে বেশি ছিল। কিন্তু এখন সেটা কমে গেছে। ২০২০-২১ সালে করোনা ও ২০২২ সালের শুরুতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ শুরু হওয়ায় মানুষ সঞ্চয় ভাঙতে বাধ্য হয়েছে। মানুষের জীবনযাপন কঠিন হচ্ছে। সামষ্টিক অর্থনীতিতেও এর প্রভাব পড়তে পারে।

আরও পড়ুন >>> ঋণ করে যেন ঘি না খাই 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে মোট ৩৪ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। অথচ একই সময়ে সঞ্চয়পত্র ভাঙানো হয়েছে ৩৬ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকার। এর মধ্যে শুধু নভেম্বর মাসে ৬ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা বিক্রির বিপরীতে ভাঙানো হয় ৭ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা।

মূলত, সেপ্টেম্বর মাস থেকে সঞ্চয়পত্র কেনার চেয়ে ভাঙানো বেড়েছে। সরকারের নানা ধরনের বিধিনিষেধের কারণেও সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে। সেই সঙ্গে নতুন প্রবণতা হিসেবে দেখা যাচ্ছে সঞ্চয়পত্র ভাঙার ধারা। অর্থাৎ মানুষের আয়ে টান পড়েছে।

পরিসংখ্যানে যেরকম দেখা যাচ্ছে, সব মিলে ব্যাংকে যেমন আমানত কমেছে, তেমনি অন্যান্য সঞ্চয়ী উপকরণে বিনিয়োগের প্রবণতাও হ্রাস পেয়েছে অনেকখানি। সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক মন্দায় মানুষের আয় কমার পুরো ধাক্কা পড়েছে সঞ্চয়ে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মোট সঞ্চয়ের প্রায় ৮২ শতাংশই হচ্ছে ব্যাংক খাতে। বাকি ১৮ শতাংশের মধ্যে জাতীয় সঞ্চয় প্রকল্পে ১৪ শতাংশ ও ৪ শতাংশ অন্যান্য খাতে। সঞ্চয়ের প্রধান দুটি উপকরণ ব্যাংক আমানত ও জাতীয় সঞ্চয় প্রকল্প খাতে বিনিয়োগ বেশ কমে গেছে। নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও প্রাইজবন্ডসহ অন্যান্য খাতেও সঞ্চয় কমেছে।

আরও পড়ুন >>> দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি : সংসার আর চলে না 

অর্থনীতিবিদদের মতে অর্থনৈতিক সংকট বড় হওয়ার কারণ হলো

১. দীর্ঘ সময় ধরে চলা অর্থনৈতিক মন্দা,

২. রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বাজারে সব ধরনের খাদ্য-পণ্য ও সেবার মূল্য বেড়ে যাওয়া,

৩. ডলারের বিপরীতে টাকার মান লাগামহীনভাবে কমে যাওয়া,

৪. মানুষের আয় উপার্জন হ্রাস পাওয়া,

এবং ৫. ব্যাপক হারে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়া।

জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক মন্দায় বাংলাদেশের কমপক্ষে ৩৭ শতাংশ মানুষের আয় কমে গেছে। কর্ম হারিয়ে ফেলে নতুন কর্মে যোগ দিতে না পারা, নিয়মিত বেতন-ভাতা না পাওয়া, বেতন-ভাতা কমে যাওয়া, পণ্যমূল্য বৃদ্ধি ও স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণে মানুষের আয় কমেছে।

২০২২ সাল জুড়েই ছিল উচ্চ মূল্যস্ফীতি। কিন্তু তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে মানুষের আয় বাড়েনি; বরং মজুরি বৃদ্ধির হার বেশিরভাগ সময়ই ছিল মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক মন্দায় বাংলাদেশে মাথাপিছু ঋণ গ্রহণ দ্বিগুণ বেড়েছে। ৩৭ শতাংশ পরিবার ঋণ গ্রহণ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, মানুষের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সঙ্গতি না থাকায় সঞ্চয় ক্রমাগত কমছে। মানুষের আয় বেশি ও খরচ কম হলে, বাড়তি অর্থ সঞ্চয় করেন।

আরও পড়ুন >>> আর কত চাপ সামলাবে? 

এখন মানুষের আয় কমেছে, আর ব্যয় বেড়েছে অনেকগুণ। ফলে সঞ্চয় করতে পারছে না। উল্টো ঋণ, ধার-দেনা করে সংসার চালাতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে। এতে একদিকে মানুষ ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

অন্যদিকে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সঞ্চয় কমে যাওয়ার কারণে। সঞ্চয় কমে যাওয়ায় বিনিয়োগ বাড়ছে না। আর এই কারণে কর্মসংস্থানও বাড়ছে না। ফলে একটি বিশাল শিক্ষিত বেকার নতুন শ্রম শক্তি না হয়ে অর্থনীতিতে বোঝা হিসেবে থেকে যাচ্ছে।

দীর্ঘ সময় ধরে অর্থনীতিতে এমন অবস্থা চলমান থাকলে অর্থনীতি মন্দার ফাঁদে পড়তে পারে। কারণ ২০২০ সালে করোনার সময় থেকে এই মন্দা চলছে। এখন পর্যন্ত সাড়ে তিন বছর হয়ে গেছে।

এখন অর্থনীতিকে দ্রুত পুনরুদ্ধার করে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। মূল্যস্ফীতি স্বাভাবিক রাখতে নিত্যখাদ্যপণ্য ও সেবার মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আর মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে না পারলে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার কঠিন হবে। তাই এখনই সময় মূল্যস্ফীতির রশি টেনে রাখা।

 এস এম নাজের হোসাইন ।। ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)