ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দক্ষিণ এশিয়ার একটি ঐতিহ্যবাহী শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের নাম। প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯৪৯ সালে, দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভক্তির পর সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের পূর্বাংশের রাজধানী ছিল ঢাকায়। প্রতিষ্ঠাকালে দলটির নাম রাখা হয়েছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ।

প্রতিষ্ঠাকালীন নেতৃবৃন্দ—মওলানা ভাসানী, শামসুল হক প্রমুখরা যদিও বুঝতে পেরেছিলেন, যে স্বপ্ন নিয়ে তারা পাকিস্তানের জন্য লড়াই সংগ্রাম করেছিলেন, তা পাকিস্তানের পশ্চিমাংশের করতলগত, সেখানে পূর্ববাংলার কোনো স্থান নেই। অথচ পূর্ববাংলাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রথম ও প্রধান নিয়ামক শক্তি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরেই পূর্বাংশের নেতৃবৃন্দের স্বপ্নভঙ্গ হয়, তারা বুঝতে পারলেন তাদের আন্দোলন সংগ্রামের ফসল পশ্চিমারা ছলে বলে কলে কৌশলে ছিনতাই করে নিয়েছে।

পাকিস্তান সৃষ্টির ঊষালগ্নে অর্থাৎ ১৪ আগস্ট করাচিতে যখন লর্ড মাউন্টব্যাটেন নতুন গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর কাছে লর্ডশিপ হস্তান্তর করলেন, জিন্নাহ সাহেব তখন কায়দে আজমের বিশেষ টুপিতে সাচ্চা মুসলমান। সেই আড়ম্বরপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর অনুষ্ঠানে ডাক পেলেন না পাকিস্তান তৈরির সিপাহসালার হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, যার কলকাতায় ডাকা ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন’ ভারতভাগ ত্বরান্বিত করেছিল, ডাক পাননি বাংলার প্রধান নেতা শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক। বরং ডাক পেলেন ঢাকার নবাব পরিবারের খাজা নাজিমুদ্দিন, যিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতির চেয়ে নেপথ্য রাজনীতিতে পারঙ্গম। পূর্ববাংলার নেতৃবৃন্দের কাছে অচিরেই স্পষ্ট হয়ে গেল ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’।

আরও পড়ুন >>> অর্জন অনেক, চ্যালেঞ্জও কম নয় 

‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’— ব্যাপারটা সবচেয়ে ভালো বুঝতে পেরেছিলেন বাংলার উদীয়মান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। কলকাতায় বেকার হোস্টেলে থেকে ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়নকালেই তিনি কলেজে মুসলিম ছাত্রসমাজের কাছে তার নেতৃত্ব নিরঙ্কুশ করেছেন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের একান্ত পার্শ্বচর হয়ে উঠেছেন।

শেখ মুজিব ১৪ আগস্ট সন্ধ্যায় সভা ডাকলেন, ছাত্রনেতাদের সঙ্গে ঘরোয়া বৈঠকে তার স্বপ্নভঙ্গের কথা জানালেন। বললেন, যে আশা নিয়ে তারা পাকিস্তানের জন্যে লড়াই করেছিলেন, পূর্ববঙ্গের চাষিদের মুখে হাসি ফোটাবার যে অঙ্গীকার তারা করেছিলেন, তা পশ্চিমাদের আধিপত্যে বরবাদ হয়ে যাবে।

...বাংলার চাষিদের প্রধান অর্থকরী ফসল হচ্ছে সোনালি আঁশ, পূর্ববঙ্গে আদমজী ছাড়া আর পাটকল নাই। বঙ্গবন্ধু টেবিলে ভারতবর্ষের মানচিত্র রেখে লালকালি দিয়ে দাগিয়ে দেখালেন পাকিস্তান একটা শুভঙ্করের ফাঁকি ছাড়া কিছুই নয়।

তিনি অচিরেই ঢাকা ফিরে যাবেন, সেখানে যে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা চলছে, সেখানে তার উপস্থিতি জরুরি। তার মন ব্যাকুল হলো ঢাকা ফেরার জন্য। কিছু একটা করতেই হবে। ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’! মিটিংয়ের পর ছুটলেন সোহরাওয়ার্দী সাহেবের বাসায়। গুরুর মত ছাড়া ঢাকা যাবেন কীভাবে!

সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কথামত ঢাকা ফিরলেন মুজিব। কলকাতায় তিনি নামকরা ছাত্রনেতা, সোহরাওয়ার্দী সাহেবের ডান হাত। ঢাকায় তিনি অপেক্ষাকৃত নতুন। মোহাম্মদ তোয়াহা-কামরুদ্দিন আহমদ প্রমুখ ঢাকাকেন্দ্রিক ছাত্রনেতারা তাকে স্বাগত জানালেন। সন্ধ্যায় ফজলুল হক মুসলিম হলে ডাকা হলো ছাত্রসভা। শেখ মুজিব প্রধান অতিথি।

তিনি কলকাতায় ছেচল্লিশের বীভৎস দাঙ্গার বর্ণনা দিলেন, সেই দাঙ্গার ছবি ও সংবাদের একটি কোলাজ গান্ধীজীর হাতে তুলে দিয়েছেন, সেকথা বললেন। তারপর বললেন, যে স্বাধীনতা পাওয়া গেল, তা নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর। কলকাতা পাওয়া যায় নাই, অথচ সব পাটকল সেখানে।

বাংলার চাষিদের প্রধান অর্থকরী ফসল হচ্ছে সোনালি আঁশ, পূর্ববঙ্গে আদমজী ছাড়া আর পাটকল নাই। বঙ্গবন্ধু টেবিলে ভারতবর্ষের মানচিত্র রেখে লালকালি দিয়ে দাগিয়ে দেখালেন পাকিস্তান একটা শুভঙ্করের ফাঁকি ছাড়া কিছুই নয়। মধ্যখানে বারোশো মাইলের ভারতের দুই প্রান্তে পাকিস্তান ও পূর্ববঙ্গ।

আরও পড়ুন >>> তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে কি তা বাংলাদেশ? 

শেখ মুজিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হলেন। ইতিমধ্যে বিয়ে করেছেন, কন্যাসন্তানের বাবা হয়েছেন। সারাক্ষণ রাজনীতি নিয়ে মেতে আছেন। বাড়ি থেকে বাবা এবং স্ত্রী তার পৈত্রিক সম্পত্তির ফসল বিক্রির টাকা পাঠান। নিরুপায় শেখ মুজিব সেই টাকা নিতে বাধ্য হন।

জিন্নাহ সাহেব ঢাকায় এসে ঘোষণা দিলেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। ছাত্রজনতা ‘না না’ বলে তার সামনেই প্রতিবাদে মুখর হলো। নতুন দল গঠিত হলো। আওয়ামী মুসলিম লীগ। মওলানা ভাসানী সভাপতি, শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক। কারান্তরীণ শেখ মুজিব যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।

বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি তার পরিকল্পনামাফিক ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভেঙে গণপরিষদ ঘেরাও করতে গিয়ে পুলিশের গুলির শিকার হলো। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর নির্দয় গুলিবর্ষণ করে বুঝিয়ে দিল, ওরা আলাদা। ওরা শাসক আর পূর্ববাংলার মানুষ শাসিত। কাজেই শাসকের সঙ্গে আর পথচলা যায় না।

আর নয় মুসলিম লীগ। তিনি মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে দলের নতুন নামকরণ করলেন ‘আওয়ামী লীগ’। মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ সভাপতি, শেখ মুজিব সাধারণ সম্পাদক। আওয়ামী লীগ মানে জনগণের দল। তিনি দলকে নিয়ে যেতে চান আমজনতার কাছে। দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি দেশের প্রতিটি জেলা-মহকুমা-থানা চষে বেড়াতে লাগলেন ট্রেনে-বাসে-লঞ্চে- স্টিমারে -নৌকায়।

দেশের আনাচে কানাচে ঘুরতে নৌকার মতো বাহনের জুড়ি নেই। গ্রামে সর্বসাধারণের প্রধান বাহন নৌকা। তাই নৌকাকে বেছে নিলেন দলের নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে। ছেষট্টি সালে বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা ঘোষণা করে প্রকারান্তরে স্বাধিকার ঘোষণা করলেন শেখ মুজিব।

আরও পড়ুন >>> বঙ্গবন্ধুকন্যার প্রত্যাবর্তন দিবসে 

শাসকগোষ্ঠী দেশদ্রোহিতার অভিযোগে তাকে একনম্বর আসামি করে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ দায়ের করল। সারাদেশে রব উঠল ‘দেশের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব’। জনতা উত্তাল হয়ে উঠল। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে শহীদ হলেন আসাদ। সত্তরের প্রলয়ঙ্করী ঝড়ে বিধ্বস্ত হলো দক্ষিণবঙ্গ। ত্রিশ হাজার মানুষ মারা গেল, প্রাণ গেল লক্ষাধিক গবাদিপশুর। ক্ষয়ক্ষতি বিপুল।

শেখ মুজিবুর রহমান দলবল নিয়ে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ালেন। পশ্চিম পাকিস্তান কিন্তু ফিরেও তাকাল না। এর ফল তিনি হাতেনাতে পেলেন। সত্তরের প্রাদেশিক নির্বাচনে তার দল আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক মাত্র ৩টি আসন ছাড়া সবক’টি আসনে জয়লাভ করে রেকর্ড সৃষ্টি করল। ইতিমধ্যে ছাত্ররা তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেছেন। তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলার নয়নের মণি।

তারপর স্বৈরাচারী আইয়ুব শাহীর পতনের পর আরেক সামরিক শাসক ইয়াহিয়া প্রেসিডেন্ট হলেন। তিনি নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করলেন। সহ্যের বাঁধ ভেঙে গেল বঙ্গবন্ধুর। ৭ মার্চ রমনার রেসকোর্স ময়দানে ১০ লক্ষাধিক জনতার সমাবেশে স্বাধীনতার ডাক দিলেন তিনি। তিনি জানতেন, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর প্রথম আঘাত তার ওপরেই আসবে।

....মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে দলের নতুন নামকরণ করলেন ‘আওয়ামী লীগ’। মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ সভাপতি, শেখ মুজিব সাধারণ সম্পাদক। আওয়ামী লীগ মানে জনগণের দল। তিনি দলকে নিয়ে যেতে চান আমজনতার কাছে।

তিনি কারারুদ্ধ হলেন। তাকে চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হলো। বাংলায় চলল জল্লাদ ইয়াহিয়ার ‘পোড়ামাটি নীতি’ আর এথনিক ক্লিনজিং। এক কোটি মানুষ আশ্রয় নিলো ভারতে। সিংহভাগই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। সেখানে রোগভোগ আর অপুষ্টিতে কত লোক যে মারা গেল, তার সঠিক পরিসংখ্যান কেউ রাখেনি।

ত্রিশ লক্ষ শহীদ, দু’লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম, কোটি মানুষের অশ্রুজলের বিনিময়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়, মুক্তিযোদ্ধাদের অপরিসীম বীরত্বে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার শেখ মুজিবুর রহমানের নামে দেশ স্বাধীন করে।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ হানাদার মুক্ত হয়। ৩ লাখ পাকিস্তানি সৈন্য কমান্ডিং অফিসারসহ রেসকোর্স ময়দানে (আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আত্মসমর্পণ করে।

আরও পড়ুন >>> বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সত্যিই বেদনাদায়ক 

একটি কথা দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলতে চাই, বাংলাদেশ সৃষ্টিতে একটি মানুষেরই অবদান—তিনি এক ও অদ্বিতীয় শেখ মুজিবুর রহমান। আর তার পাশে থেকে শক্তি জুগিয়েছেন বিজয়লক্ষ্মী শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব, আজ যাকে আমরা বঙ্গমাতা হিসেবে বিশেষভাবে সম্মানিত করছি। বঙ্গবন্ধুর বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে মহীয়সী এই নারীর ভূমিকা অপরিসীম।

আওয়ামী লীগের ইতিহাস মূলত বঙ্গবন্ধুরই জীবনের ইতিহাস। একটি দলকে একক নেতৃত্বে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের নেতৃত্বদানকারী দলে পরিণত করার কৃতিত্ব একমাত্র শেখ মুজিবুর রহমানের। তার দেখানো পথে দেশনেত্রী শেখ হাসিনা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশকে। আজ উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ। শেখ হাসিনার বাংলাদেশ আজ নতুন ইতিহাস রচনার পথে।

নান্টু রায় ।। রাজনীতিবিদ