ছবি : সংগৃহীত

বিদ্যুৎ খাত নিয়ে পরিকল্পনা ও বিদ্যুৎ পরিস্থিতি

বিদ্যুৎ পরিস্থিতি খারাপ হওয়া সরকারের পরিকল্পনাধীন নয়। কোনো সরকারই পরিকল্পনা করে দেশের জ্বালানি খাত খারাপ অবস্থায় ফেলে না। যেকোনো দেশের জ্বালানি পরিকল্পনায় নানা দৃশ্যপট কল্পনা করা হয় এবং তদনুযায়ী মডেল নির্মাণ করে গণনা করে দেখা হয়, কোন দৃশ্যপটে কী ধরনের ফলাফল ঘটে। এইসব সম্ভাব্য ফলাফলরাজির মধ্য থেকে সর্বোত্তম দৃশ্যপটই পরিকল্পনায় গ্রহণ করা হয়।

অন্তত আদর্শ চিন্তা তাই হওয়া উচিত। তবে সর্বোত্তম ফলাফল আবার বাস্তবতার নিরিখে বিচার করতে হয়, রাজনৈতিক ইশতেহার কিংবা ভূ-রাজনীতিও মাথায় রাখতে হয়।

আন্তঃরাষ্ট্রীয় বন্ধুবাৎসল্যও চিন্তা করতে হবে। সব মিলিয়ে একটা পরিকল্পনা আউটলাইন গ্রহণ করা হয়। বিগত দশকে আমরা দেখেছি বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম দেশ জাপান সরকারের আগ্রহে এবং অর্থানুকূল্যে বিদ্যুৎ পরিকল্পনা করা হয়েছে। সম্প্রতি সমন্বিত জ্বালানি পরিকল্পনাও করা হয়েছে।

আরও পড়ুন >>> বিদ্যুৎ সংকট : সমাধান হবে কবে? 

২০১৬ সালের বিদ্যুৎ পরিকল্পনায় কিছু প্রশ্ন ছিল, যেমন জিডিপি এবং প্রবৃদ্ধির উচ্চহার ব্যবহার। বাস্তবে দেখা গেল, শিল্পায়নের অগ্রগতি অত্যন্ত ধীর। ফলত অনেকগুলো উৎপাদনকেন্দ্র তৈরি হয়ে গেল, কিন্তু তদনুযায়ী লোড নেই। এই কথা মাথায় রেখে শতভাগ বিদ্যুতায়নের আয়োজন করা হলো, সবাই বিদ্যুতের লাইন পেল, কানেক্টিভিটি হলো, কিন্তু ততদিনে আবার উৎপাদন কমে গেল জ্বালানির অভাবে।

জ্বালানি কেন কমে গেল? কারণ বাজারে তার মূল্য অত্যধিক। এত ডলার দিয়ে তা কেনা ঠিক হবে কি না, কিংবা আদৌ ডলারের সঞ্চয় কতখানি আছে সেইসব নিয়ে সংশয় দেখা দিল। এর কারণ দুটো—করোনা মহামারির কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতি শ্লথ হয়ে যখন ঘুরে দাঁড়াল তখন সরবরাহ লাইনে একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। 

আমাদের নিজস্ব এনার্জি মডেলিং হাব নেই, নিজস্ব ও নির্ভরযোগ্য এনার্জি ডেটা সেন্টার নেই, উপযুক্ত তথ্যের অভাব রয়েছে। ব্যবসায়িক মনোভাব নিয়ে এই খাতে তাৎক্ষণিক সমাধান হয়তো মিলবে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সুফল থেকে আমরা দূরেই থাকব।

যে সরবরাহ লাইন দীর্ঘদিন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, সেই দানবাকৃতির যন্ত্রটি পূর্ণোদ্যমে চালু হতে কিছুটা সময় প্রয়োজন ছিল। যেমন বড় গ্যাস-পাইপলাইনগুলোয় চাহিদা না থাকায় অনেক কর্মী চাকরি হারিয়েছিল। দক্ষ কর্মী জোগাড় করে লাইন চালু করতে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছিল এবং সেটা কাটতে না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলো।

এইরকম বৈশ্বিক সব সমাপতনের আন্তর্জাতিক ধাক্কা আগে থেকে পরিকল্পনা করে সমাধান করা যায় না। তখন আপদকালীন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। 

বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি আমদানি

বিশ্বের খুব কম দেশই আছে যাদের জ্বালানি কিনতে হয় না। অধিকাংশ দেশই জ্বালানি আমদানি করে থাকে—জাপান, কোরিয়া, চীন–এদের মতো এনার্জি হাংরি দেশসহ প্রায় সবাই জ্বালানি আমদানি করে। তাই হরমুজ প্রণালি বা মালাক্কা প্রণালির এত জ্বালানি-নিরাপত্তা প্রয়োজন, দক্ষিণ চীন সাগর একই কারণে ভৌগলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

এসব অঞ্চল দিয়ে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ শতাংশ এলএনজি বা তরল তেল বা কয়লা চলাচল করে। শুধুমাত্র মালাক্কা প্রণালি দিয়েই সারা বিশ্বের অর্ধেক এলএনজি এবং এক-তৃতীয়াংশ তেল বহন করা হয়। এটা কোরিয়ার ৭৫ শতাংশ, জাপানের ৬০ শতাংশ এবং চীনের ৮০ শতাংশ জ্বালানি সরবরাহ করে। এই তথ্যটি কিছুটা পুরোনো, দশ বছর আগের, কিন্তু এর আপেক্ষিক আনুপাতিক গুরুত্ব আজও অমলিন।

আরও পড়ুন >>> লোডশেডিং : এত বিপর্যয় কেন? 

বাংলাদেশ এমন কোনো জ্বালানি ব্যতিক্রমী দেশ নয় যে তার আমদানি করতে হবে না। আমাদের নিজস্ব প্রাকৃতিক গ্যাস ছিল এবং আছে। তবে নিজস্ব প্রাকৃতিক গ্যাসের সঞ্চয় নিশ্চয় অসীম নয়। অনেকের ধারণা প্রাকৃতিক গ্যাসের হিউবার্ট পিক বা সর্বোচ্চ উৎপাদনের বিন্দুটি আমরা অতিক্রম করে গেছি। এটা অবশ্য নির্ভর করে বঙ্গোপসাগরে আমাদের গ্যাস-অনুসন্ধান কী প্রকৃতির হবে এবং সেইখানে আমরা কতখানি গ্যাস পাব অথবা পাব না।

আমাদের সাম্প্রতিক জ্বালানির মূল উৎস তেল, গ্যাস ও কয়লা—সবকটিই আমাদের আমদানি করতে হচ্ছে। নিজেদের কিছু গ্যাস আছে, সেইটা কমে আসছে। নিজেদের কয়লা উত্তোলন নিয়ে আমাদের দ্বিধা আছে। আমাদের নিজেদের কোনো তেলখনি নেই। এমনকি পরমাণু বিদ্যুতের জন্যও সমৃদ্ধ পারমাণবিক জ্বালানি আমাদের ক্রয় করে নিতে হবে।

একমাত্র জলবিদ্যুৎ, সূর্যালোক এবং বাতাস আমাদের প্রকৃতিপ্রদত্ত। তবে প্রযুক্তির বিশেষ উন্নয়ন না হলে এই উৎসগুলো থেকে গিগাওয়াট পর্যায়ের বিদ্যুৎ উৎপাদন আপাতত সুদূরপ্রসারী।

এটা বলা যেতে পারে যে, ‘আমদানি নির্ভরতা যে আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে সেটা আমরা ভাবিনি কেন’—এই প্রশ্ন যথাযথ। আমদানি-নির্ভর জ্বালানি নীতি আমাদের ভাগ্যে থাকলে আন্তর্জাতিক বাজারের ওঠানামা নিয়ন্ত্রণ করার মতো প্ল্যানও থাকতে হবে। যার পরিকল্পনা যত ফ্লেক্সিবল, তার উদ্বর্তন তত সহজ।

আমাদের দেখতে হবে—আন্তর্জাতিক বাজার আমরা কত ভালো বুঝি, তহবিলে ডলার কত আছে, মূল্যের ওঠানামা কোন গতিতে হচ্ছে, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি কোনদিকে যাচ্ছে, দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি কী, বাজারে জ্বালানি-মূল্যের ফোরকাস্ট কী বলে, আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সাথে আমাদের সম্পর্ক কেমন, জ্বালানির সরবরাহকারী দেশগুলো আমার কতখানি বন্ধুপ্রতিম বা কার সাথে আমার কী চুক্তি আছে, জ্বালানি মূল্যের ফাইন্যান্সিয়াল ও ইকোনোমিক মডেলিং তথা প্রাইস-মডেলিং, জ্বালানি উৎসের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে, তেল শোধনাগার এবং এলএনজি রিগ্যাসিফিকেশন (Regasification) ও স্টোরেজ-ক্ষমতা জাতীয় পর্যায়ে কেমন, কোন সরবরাহ পথের নিরাপত্তা কীরূপ, সামরিক তৎপরতা কোথায় কেমন, বিভিন্ন জ্বালানি-ডিলারের সাথে সম্পর্ক, তথ্য এবং সর্বোপরি ভূ-রাজনীতির জটিল গতিপ্রকৃতি ইত্যাদি।

জ্বালানি মন্ত্রণালয় এটা করে থাকেন। তারা এই বিষয়ে একটি জাতীয় টাস্কফোর্স করতে পারেন যাতে দেশীয় গবেষক, সামরিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পর্যবেক্ষক, আন্তর্জাতিক নেগোশিয়েটর, ব্যাংকার, জ্বালানি ব্যবসায় সংগঠনের প্রতিনিধি, ফাইনান্স ও ইকোনমিক বিশেষজ্ঞ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞ থাকতে পারেন। এগুলো সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে।

আরও পড়ুন >>> মেগা প্রকল্প, উচ্ছেদ ও কর্মসংস্থানের ভ্রান্ত প্রতিশ্রুতি

এই পর্যন্ত আমরা যেটা দেখেছি, তাতে সরকার এই বিষয়ে দেশীয় বিশেষজ্ঞদের সেইভাবে সম্পৃক্ত করেন না, তাদের কাঙ্ক্ষিত ক্যাপাসিটি ডেভেলপমেন্ট হয়নি, আমাদের নিজস্ব এনার্জি মডেলিং হাব নেই, নিজস্ব ও নির্ভরযোগ্য এনার্জি ডেটা সেন্টার নেই, উপযুক্ত তথ্যের অভাব রয়েছে। ব্যবসায়িক মনোভাব নিয়ে এই খাতে তাৎক্ষণিক সমাধান হয়তো মিলবে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সুফল থেকে আমরা দূরেই থাকব।

বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ ব্যয়

এই সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কথা বলতে গেলে যেটা দরকার সেটা হলো একটা নির্দিষ্ট অর্থবছরে অথবা গড়ে একটা প্ল্যান্ট বসাতে যে সময় লাগে (আদর্শ সময়), সেই সময়ে বাংলাদেশের একই প্রযুক্তির বিদ্যুতের মোট স্থাপিত ক্ষমতার সাথে ঐ সময়ের বৈশ্বিক গড়ের তুলনা হলে সেটা প্রকৃত দৃশ্যকে প্রতিফলিত করবে। এমন একটি মত প্রচলিত আছে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের মতে।

একজন পরিচিত গবেষক আমাকে জানিয়েছেন, আমাদের দুর্বল দরকষাকষি, নন-টেকনিক্যাল খরচ, প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতা কিংবা দক্ষ প্রার্থী নির্বাচন করতে না পারা ইত্যাদি বিষয়গুলো পরবর্তী প্রকল্পের জন্য বৈদেশিক বিশেষজ্ঞ নির্ভরশীলতা অনিবার্য করে তোলে। এর সুযোগ নেয় ভাড়াটে বিশেষজ্ঞরা।

আমাদের দুর্বল দরকষাকষি, নন-টেকনিক্যাল খরচ, প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতা কিংবা দক্ষ প্রার্থী নির্বাচন করতে না পারা ইত্যাদি বিষয়গুলো পরবর্তী প্রকল্পের জন্য বৈদেশিক বিশেষজ্ঞ নির্ভরশীলতা অনিবার্য করে তোলে।

বাংলাদেশে তো মহাসড়ক নির্মাণেও বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে বেশি খরচ হয় বলে কিছু কিছু সংবাদমাধ্যম রিপোর্ট করেছে। সেইগুলো খতিয়ে দেখবার জন্য সরকার গবেষকদের কাজে লাগাতে পারে। যদি সত্যিই যৌক্তিকতার চেয়ে খরচ বেশি হয়, তবে অবশ্যই সরকারের উচিত হবে খরচ কমানোর দিকনির্দেশনাগুলো বাস্তবায়ন করার জন্য সঠিক কর্মপন্থা প্রণয়ন করা।

নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভবিষ্যৎ

নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র অবশ্যই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী স্থাপন করা দরকার। ভালো মহাপরিকল্পনায় অবশ্যই দেশের মূল জ্বালানির সঞ্চয়, প্রকারভেদ, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক মূল্য যাচাই, মডেল নির্মাণ, সরবরাহ লাইনের নিরাপত্তা, ইত্যাদি খতিয়ে দেখা হয়ে থাকে। সেই সাথে দেশের পাঁচসালা পরিকল্পনাগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে উন্নয়নের পরিকল্পনা ও জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ইত্যাদি মাথায় এনে এনার্জি মডেলিং সিনারিও বিচার করে দেখতে হবে।

আরও পড়ুন >>> বিদ্যুৎ গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি : এভাবে আর কতদিন?

এইসব বিবেচনা করে যদি মাস্টার প্ল্যানে উৎপাদন কেন্দ্র সম্পর্কে যদি কোনো সুনির্দিষ্ট মতামত থাকে তবে সেটা বিবেচনা করতে ক্ষতি দেখি না। একই সাথে একথাও মনে রাখতে হবে, মাস্টার প্ল্যানের অনুমানের ভিত্তিগুলো কী ছিল, সেগুলো এখনো বলবৎ আছে কি না, বৈশ্বিক হালহকিকত কী ইত্যাদি। সাধারণ একটা মাস্টার প্ল্যান তৈরি করতে বিগত বছরগুলোর তথ্য বিশ্লেষণ করে পরবর্তী দশকের জন্য পূর্বাভাস প্রস্তুত করা হয়।

স্বভাবতই কোনো বৈশ্বিক মহামারি বা যুদ্ধ হলে যে আচানক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় সেটা যে সমস্যাগুলোর সৃষ্টি করে তার সমাধান অথবা পূর্বাভাস ঐ মাস্টার প্ল্যানে থাকার কথা নয়। তাছাড়া যেকোনো মাস্টার প্ল্যানের জন্য কিছু বাস্তবসম্মত পূর্বানুমান প্রয়োজন। সেই অনুমান কতখানি বলবৎ আছে সেটা বিবেচনা করে দশক-ওয়ারি রিকমেন্ডেশনগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে।

যেমন ধরা যাক, আমরা জাপানি অর্থায়নে ৪টি প্রকল্পের পরিকল্পনা করলাম। যেকোনো কারণে, সেই অর্থায়ন এলো না। কিন্তু প্ল্যান করার সময়ে যে বাস্তব সম্ভাবনা ছিল, তার ভিত্তিতেই দিকনির্দেশনা তৈরি হয়েছিল, এখন সেটি আর নেই। অতএব, বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়াই যুক্তিযুক্ত। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।

যদি গ্যাস সরবরাহ না থাকে, যদি ভবিষ্যতের পরিকল্পিত এলএনজি সরবরাহ না আসে, তবে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র না করাই ভালো। কিন্তু এইসব বিষয়ের একমাত্র বাস্তবভিত্তিক তথ্যের মালিক জ্বালানি মন্ত্রণালয়, অতএব তারাই বিবেচনা করে দেখুক নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি যুক্তিযুক্ত কি না।  

ড. ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী ।। পরিচালক, জ্বালানি ও টেকসই গবেষণা ইন্সটিটিউট; অধ্যাপক, তড়িৎকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়