আলী যাকেরের প্রয়াণ হয়েছে ২০২০ সালে। ‘কাছের মানুষ’ কিংবা ‘চিরসখা’ তার উদ্দেশ্যে যে সম্বোধনই করি না কেন, আমার ক্ষেত্রে এই মানুষটিকে প্রকাশের জন্য তা যথেষ্ট নয়। 

সম্ভবত সে কারণেই একটা সময়ে এসে আমার মনে হলো, ব্যক্তিজীবনের এই অসংখ্য স্মৃতির কিয়দংশ নিয়ে আমার এবং আলী যাকেরের বেড়ে ওঠা, বর্ণময় জীবন, মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান, নাট্যজীবন, কর্মজীবন, ভালবাসার কাজগুলো; সবকিছু নিয়ে যদি একটা স্থানে স্মৃতি সংগ্রহালয় তৈরি করা যায় তবে কেমন হয়?

এটি হবে এমন একটি স্থান, যেখানে এসে দর্শনার্থী এবং নতুন প্রজন্ম এই অনন্য প্রতিভাধর মানুষটি সম্পর্কে জানতে পারবেন! মনে হলো সেটা খুব প্রয়োজন। সেই ভাবনা থেকেই আলী যাকের স্মৃতি সংগ্রহালয় ‘বাতিঘর’ এর সৃষ্টি। নামটি দেন এশিয়াটিকের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর শংকর সাওজাল। এটি বনানীতে এশিয়াটিক সেন্টারে অবস্থিত। আলী যাকেরের মৃত্যুর পর তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে সংগ্রহালয়ের পরিসর আরও বড় হয়েছে।

আলী যাকেরের সকল চেতনার মূলে ছিল তার গভীর দেশপ্রেম। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন শব্দসৈনিক এবং যুদ্ধ প্রতিবেদক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেন।

কত শত স্মৃতি মনে পড়ে আলী যাকেরকে নিয়ে! থিয়েটার জীবনের স্মৃতি, এশিয়াটিকে একসাথে কাজ করার স্মৃতি, সংসার ঘিরে স্মৃতি! আমাদের জীবন অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে এসবের কোনটারই গুরুত্ব কম ছিল না।

যুদ্ধ পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে থিয়েটার চর্চাকে প্রতিষ্ঠিত করে বেগবান করতে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। এদেশের বিজ্ঞাপন শিল্পে উৎকর্ষতা এবং পেশাদারিত্ব তৈরিতে তার অবদানের কথা নতুন করে বলার কিছু নেই।

প্রকৃতিপ্রেমী আলী যাকের বাংলাদেশের নিসর্গের প্রতি ভীষণ আকৃষ্ট ছিলেন। ক্যামেরা হাতে এদেশের অপরূপ সৌন্দর্য তিনি ধারণ করে রেখে গেছেন তার তোলা বিভিন্ন ছবিতে।

ভালোবাসতো লেখালেখি করতে। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমসাময়িক নানা প্রসঙ্গে দীর্ঘদিন দেশের প্রধান পত্রিকাগুলোতে কলাম লিখেছেন। অন্যদিকে, পরিবারের প্রতি ছিল তার নিখাদ ভালবাসা। আগাগোড়া পরিবার অন্তঃপ্রাণ একজন মানুষ ছিলেন আলী যাকের।

বিশাল হৃদয়ের এই মানুষটি সমস্ত জীবন জুড়ে তার আশেপাশের মানুষ, বন্ধু, স্বজন, সহকর্মী, শুভার্থী, অনুসারী, সহযাত্রী এবং পরিবারের সদস্যদের বাতিঘরের মতোই সঠিক পথ দেখিয়ে গেছেন। সত্যি কথা বলতে, ‘বাতিঘর’ শব্দটি আক্ষরিক অর্থেই আলী যাকেরের সার্থক প্রতিফলন।

‘বাতিঘর’ সাজানো হয়েছে আলী যাকেরের ব্যবহার্য বিভিন্ন জিনিসপত্র, নানা সময়ে প্রাপ্ত বিভিন্ন সম্মাননা স্মারক—স্বীকৃতিপত্র, মুক্তিযুদ্ধকালীন কিছু স্মৃতিস্মারক, মঞ্চনাটকে তার কালজয়ী তিনটি চরিত্রের পোশাক, তাকে উৎসর্গ করা নানা শুভেচ্ছাপত্রের সমন্বয়ে। এখানে আরও রয়েছে তার শৈশব—তার বেড়ে ওঠার সময়ের দুর্লভ কিছু ছবি। আরও আছে তার ব্যক্তিজীবন, কর্মজীবন, নাট্যজীবনের ক্যামেরাবন্দী মূল্যবান বিভিন্ন মুহূর্তের ছবি এবং তার তোলা অসাধারণ কিছু ফটোগ্রাফি।

আলী যাকেরের সকল চেতনার মূলে ছিল তার গভীর দেশপ্রেম। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন শব্দসৈনিক এবং যুদ্ধ প্রতিবেদক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেন।

এখানে এসে দর্শনার্থীরা সহজেই উপলব্ধি করতে পারবেন আলী যাকেরকে এবং তার ভাবনাকে। জানতে পারবেন তার বর্ণাঢ্য জীবন সম্পর্কে, তার সৃষ্টি, কাজ এবং আবেগ-অনুভূতি সম্পর্কে। এর পাশাপাশি শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি আলী যাকেরের তীব্র অনুরাগ মাথায় রেখে এখানে ছোট পরিসরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান তথা পাঠাভিনয় / কবিতা / গানের অনুষ্ঠান আয়োজনের সুব্যবস্থা করা হয়েছে।

আমি সন্তুষ্টি অনুভব করি, যখন দেখি আমাদের সন্তানেরা, ইরেশ এবং শ্রিয়া কমবেশি তাদের বাবার গুণের চর্চার যথার্থ উত্তরাধিকারী হতে পেরেছে। ভীষণ ভালো লাগছে যখন দেখছি মঞ্চনাটক এবং বিজ্ঞাপন শিল্পে আলী যাকেরের অবদানকে ধরে রাখতে এবং নতুন প্রজন্মের মেধাবী তরুণদের আলী যাকেরের অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত করতে ওরা ‘আলী যাকের অনুদান (Aly Zaker Grant)’ এর প্রবর্তনে উদ্যোগী হয়েছে।

প্রতি বছর মেধাবী তরুণ, বিজ্ঞাপন নির্মাতা এবং মঞ্চনাটক নির্দেশকদের তাদের স্বীয় কাজে উৎকর্ষতা লাভের জন্য উৎসাহিত করতে এই অনুদান প্রদান করা হবে। সত্যিই, নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে ওরা।

‘বাতিঘর’কে আলী যাকের সংগ্রহালয়ে পরিণত করার প্রধান উদ্দেশ্য হলো দর্শনার্থী / তরুণ প্রজন্মের মাঝে আলী যাকেরের ভাবনা, কর্ম, সৃষ্টি ও দেশপ্রেমকে ছড়িয়ে দেওয়া। এই কাজে যদি আমি / আমরা এতটুকুও সফল হই; যদি একজন তরুণও আদর্শিকভাবে এতে অনুপ্রাণিত হয়ে ওঠে তবে সেটিই হবে আমাদের সার্থকতা এবং আত্মতৃপ্তি। সবার প্রতি রইল, ‘বাতিঘর’ আসবার আমন্ত্রণ!

সারা যাকের ।। নাট্যজন ও অভিনেত্রী