ছবি : সংগৃহীত

১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ থেকেই ফেসবুকে ঘুরছে ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকার একটা সংবাদ। এশিয়া কাপে বাংলাদেশের কাছে হারের পর তাদের মন্তব্য, ‘পচা শামুকে পা কাটলো রোহিত শর্মাদের।’ বাংলাদেশের অনেকেই এই ধরনের উক্তিতে আহত হয়েছেন। কেউ কেউ তো এই প্রশ্নও তুলেছেন, পচা শামুক আসলে কে?

শেষ চার ম্যাচে তিনবার যারা বাংলাদেশের কাছে হেরেছেন, পচা যদি কাউকে বলতে হয় তবে তো তা ভারতকেই বলতে হয়। অথবা তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া হয় বাংলাদেশ দলই আসলে পচা শামুক, তাহলে তো তাদের কাছে ঘন ঘন হারের পর ভারতীয় দলের এত দিনে গ্যাংগ্রিন হয়ে যাওয়ার কথা।

গ্যাংগ্রিন আসলেই হয়েছে কি না তা যদিও বোঝা যাবে আজই। এশিয়া কাপ ফাইনালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বেশ শক্ত চ্যালেঞ্জের মুখেই তারা পড়তে যাচ্ছে ধারণা করা যায়। তবে আমাদের এই আলোচনা আসলে ভারতীয় দলের সমস্যা নিয়ে নয়। বাংলাদেশের ক্রিকেট ভক্তরা চাইলে আনন্দবাজারের এইসব অবজ্ঞা সহজেই উপেক্ষা করতে পারেন।

আরও পড়ুন >>> ক্রিকেট এখন খাদের কিনারে 

ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের ইদানীং পাওয়া নিয়মিত জয়গুলো তো আছেই, চাইলে আইসিসির সাম্প্রতিক ওডিআই চ্যাম্পিয়নশিপের পয়েন্ট টেবিলটাও, যেখানে বাংলাদেশ ভারতের ওপরেই শেষ করেছে, তারা ভারতীয় প্রতিবেদকদের দেখিয়ে দিতে পারেন।

পয়েন্ট টেবিলটা আলোচনায় প্রাসঙ্গিক এই কারণেই যে, এটা ওয়ানডেতে বাংলাদেশের কিছুকাল আগেও ভালো খেলার প্রমাণ দেয়। যদিও ঘরের মাঠে আয়ারল্যান্ড বাদে বাকি দুইটি সিরিজ এই বছর বাংলাদেশের ভালো যায়নি।

আনন্দবাজার অনলাইনের প্রতিবেদন; ছবি : সংগৃহীত

ইংল্যান্ড ও আফগানিস্তানের বিপক্ষে একটা করে ম্যাচ তারা জিতেছে বটে। কিন্তু ততক্ষণে সিরিজ হাতছাড়া হয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও এবারের এশিয়া কাপটা বাংলাদেশ একটা প্রত্যাশা নিয়েই খেলতে গেছে। প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির যে মিল ঘটেনি তা এতক্ষণে সবাই জেনেই গেছেন। আপাতত চলছে হিসাব-নিকাশ। কেন এবার এশিয়া কাপে ব্যর্থ বাংলাদেশ? মোটা দাগে ব্যাটিং ব্যর্থতা সবাই বড় করে দেখছেন, যদিও ইনজুরি এবং দল নিয়ে ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের বেলায়।

এশিয়া কাপটা বাংলাদেশ একটা প্রত্যাশা নিয়েই খেলতে গেছে। প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির যে মিল ঘটেনি তা এতক্ষণে সবাই জেনেই গেছেন। আপাতত চলছে হিসাব-নিকাশ। কেন এবার এশিয়া কাপে ব্যর্থ বাংলাদেশ?

এবারের এশিয়া কাপে বাংলাদেশ দল নিয়ে দল ঘোষণার আগে যত আলোচনা হয়েছে তা সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের আর কোনো দল নিয়ে এতটা হয়েছে বলে মনে পড়ে না। তামিম ইকবালের অবসরজনিত নাটক, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদকে নিয়ে নির্বাচকদের অস্পষ্ট চিন্তাভাবনা বাংলাদেশ দল দেশ ছাড়ার আগেই পরিস্থিতি ঘোলাটে করে রেখেছিল।

প্রথম ম্যাচে শ্রীলঙ্কার কাছে হারার পর তো এই দুইজনের ভক্তরা রীতিমতো রে রে করে উঠেছিল। কেউ কেউ তো এমন দাবিও করেছেন, তামিম-মাহমুদুল্লাহ থাকলে বাংলাদেশ মোটেও শ্রীলঙ্কার কাছে এতটা বাজে ভাবে হারতো না।

যদিও পরিসংখ্যান অন্যরকম কথাই বলেছে, তামিম-মাহমুদুল্লাহ দুইজন একসাথে ১৯৩ ম্যাচ খেলেছেন, তাতে জয়ের চেয়ে পরাজয়ই বেশি। দুইজনের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ জিতেছে ৯১ ম্যাচ। হেরেছে ৯৮ ম্যাচ। আলাদাভাবে তাদের ক্যারিয়ারে চোখ রাখলেও দেখা যায় হারের সংখ্যাই বেশি। তামিম তার ক্যারিয়ারে ১০৯ ম্যাচ জিতেছেন আর ১২৬ ম্যাচ হেরেছেন, মাহমুদুল্লাহ ১০৪ ম্যাচ জিতে হেরেছেন ১০৯ ম্যাচ।

আরও পড়ুন >>> ক্রিকেটে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে না কেন? 

কাজেই তারা থাকলেই বাংলাদেশ এশিয়া কাপ জিতে যেত এই চিন্তা অবান্তর। তবে হ্যাঁ, অভিজ্ঞতা কখনো কখনো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে বটে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেই ম্যাচের কথাই ধরা যাক। তানজিদ হাসান তামিম আর নাইম শেখ ইনিংস ওপেন করেছেন, এদের একজনের এটা ছিল অভিষেক ম্যাচ, আরেকজনের মাত্র পঞ্চম ওয়ানডে। নাজমুল হাসান শান্তর একটা ইনিংসে সেইদিন লজ্জা এড়ানো গেলেও হার এড়ানো যায়নি।

অনেকেই সেই ম্যাচে সাকিব আল হাসানের অধিনায়কত্বের ও সমালোচনা করেছেন। দ্রুত দুটো উইকেট পড়ার পর এক প্রান্তে তখন বাঁ-হাতি শান্ত ব্যাট করছেন, তৌহিদ হৃদয়কে না পাঠিয়ে তিনি কেন ব্যাটিংয়ে এলেন সেই প্রশ্নের জবাব মেলেনি। পরের ম্যাচে মিরাজকে ওপেনিংয়ে পাঠিয়ে বাংলাদেশ ফটকা খেলল। তাতে কাজও হলো।

আফগানিস্তানের বিপক্ষে অনায়াসে এক জয় নিয়েই সুপার ফোরে উঠল বাংলাদেশ দল। কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো তখন, যখন একই ফটকা বাংলাদেশ বারবার খেলতে লাগল। একবার তা কাজে দিলেও পরে তা হিতে বিপরীত হয়েছে। পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই মিরাজ আর হৃদয়ের ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে বাংলাদেশ দল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে, যা আফগানিস্তান ম্যাচ বাদ দিলে আর কখনো ভালো ফল আনেনি।

তামিম-মাহমুদুল্লাহ দুইজন একসাথে ১৯৩ ম্যাচ খেলেছেন, তাতে জয়ের চেয়ে পরাজয়ই বেশি। দুইজনের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ জিতেছে ৯১ ম্যাচ। হেরেছে ৯৮ ম্যাচ। কাজেই তারা থাকলেই বাংলাদেশ এশিয়া কাপ জিতে যেত এই চিন্তা অবান্তর।

ইনজুরি, খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত সমস্যাও এই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশকে কিছুটা ভুগিয়েছে। তবে তা নিয়ে অভিযোগ করার কিছু নেই। এখন এত বেশি ক্রিকেট খেলা হচ্ছে যে প্রায় সব দলকেই এগুলো মেনে নিয়েই এগোতে হচ্ছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এসবের চেয়েও বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে চিন্তার অধারাবাহিকতা।

টুর্নামেন্টের মাঝপথে উড়িয়ে নেওয়া হলো এনামুল হক বিজয়কে। অথচ আসন্ন বিশ্বকাপ তো বটেই, এশিয়া কাপের কোনো পরিকল্পনাতেও ছিল না এনামুল। লিটন দাস আর সাইফ হাসানের অসুস্থ হয়ে পড়ায় তার কপাল খুলে গেছে। ধারণা করা যায় সাইফ এখন সুস্থ। কিন্তু এশিয়া কাপে নিজের একমাত্র ম্যাচে যাচ্ছে-তাই ব্যাটিংয়ের পরও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে এনামুলকে দলে রেখে দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন >>> বাংলাদেশিদের এত পাকিস্তান প্রেম কেন? 

যদিও বাংলাদেশের বিশ্বকাপ দলে তার সরাসরি সুযোগ পাওয়াটা প্রশান্ত মহাসাগরের সব পানি রাতারাতি শুকিয়ে যাওয়ার মতো অভাবনীয় ঘটনাই মনে হবে। কিন্তু বাংলাদেশ বলেই সেই সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

দলে তিনজন বাঁ-হাতি ওপেনার থাকা সত্ত্বেও কয়েক বছর প্রায় কোনো কিছু না করেও সৌম্য সরকার যদি আবার দলে ফিরতে পারেন, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে কোনো একটা ভেল্কি দেখিয়ে এনামুলও বাংলাদেশের বিশ্বকাপ দলে চলে আসতে পারেন।

আসলে সর্বসম্প্রতি বাংলাদেশের ক্রিকেটাই যেন এমন হয়ে গেছে। মাঠে, মাঠের বাইরে, প্রায় সবকিছুতেই চূড়ান্ত রকমের অপেশাদারি মনোভাব। আপাতত তাদের কিছুটা ধারাবাহিকতা দেখা যাচ্ছে কেবল ভারতের বিপক্ষেই। কিন্তু অন্যসব সমস্যা তাদের এত প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে যে ভারতের মতো বিশ্ব মানের দলের বিপক্ষে তাদের সাম্প্রতিক সাফল্যগুলো ভারতীয় তো বটেই, অনেক বাংলাদেশিরও এখন মনে থাকছে না।

আজাদ মজুমদার ।। যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, নিউ এইজ