ছবি : সংগৃহীত

আলোচনায় ২৯ সচিবের ৪৩ সন্তান বিদেশে থাকার খবর (ঢাকা পোস্ট, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩)। কয়েকদিন ধরে গণমাধ্যমের এই প্রতিবেদন নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে, চলছে সমালোচনাও। সরকারের একটি সংস্থা এই বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছে। অনুসন্ধানের ভিত্তিতে বিভিন্ন গণমাধ্যম প্রতিবেদন করেছে। বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি ঘোষণার পর এই তথ্য সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৮ জন সচিবের ২৫ সন্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আছেন আর ১৮ জন আছেন কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, পোল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ও ভারতে। তাদের কেউ পড়াশোনা করেন আবার কেউ পড়াশোনা শেষে স্থায়ী হয়েছেন।

প্রশ্ন তোলা যায়, সচিবদের সন্তানদের বিদেশে যাওয়া কিংবা বিদেশে পড়তে যাওয়া কি দোষের? সহজ উত্তর, না। আইনি দিক থেকে অপরাধও নয়। তবে বিবেকের প্রশ্ন থাকে। সচিবরা তাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে দেশের উচ্চশিক্ষার প্রশংসা করে বক্তব্য দেন। অথচ তাদের সন্তানদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়ান না। পড়ালেও তার হার খুবই কম। সচিবদের সন্তান যখন ইউরোপ-আমেরিকায় পড়াশোনা করেন তখন দেশের সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন আসে, দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় কি তাদের আস্থা নেই?

আরও পড়ুন >>> দেশে যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে না কেন? 

এমন খবর যখন দেশজুড়ে আলোচনার জন্ম দেয় তখন প্রশ্ন আসতে পারে কেবল সচিবদের সন্তানরাই কি বিদেশে পড়ে বা থাকে? যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য কিংবা উন্নত দেশগুলোতে অন্য কারও সন্তান কি পড়েন না, থাকেন না?

সচিবদের কম পদ মর্যাদার অনেক কর্মকর্তাও আছেন, যাদের সন্তান বিদেশে পড়েন। শুধু প্রশাসন ক্যাডার নয়; অন্য ক্যাডারের উচ্চ পর্যায়ের কর্তাদের সন্তানরাও উন্নত দেশগুলোয় পড়াশোনা করেছেন। স্থায়ী হয়েছেন। এদের কেউ কেউ সাধারণ পরিবারের সন্তানদের মতো স্কলারশিপ নিয়ে গেছেন এটাও সত্য। তবে জনশ্রুতি আছে, উল্লেখযোগ্য অংশ বিদেশে গেছেন বাবার টাকায়! এই বাবারা সামান্য সরকারি চাকরি করে এত টাকা কোথায় পান?

সচিবদের সন্তান যখন ইউরোপ-আমেরিকায় পড়াশোনা করেন তখন দেশের সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন আসে, দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় কি তাদের আস্থা নেই?

শুধু সরকারি কর্মকর্তাদের সন্তানরাই নন। রাজনীতিবিদদের সন্তানরাও কম যান না। রাজনীতিবিদদের সন্তানরা কে কোথায় আছেন তা নিয়ে ২০১০ সালের অক্টোবরে ‘সনস অ্যান্ড ডটারস অব পলিটিক্যাল প্যারেন্টস’ (Sons and Daughters of Political Parents) শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে ইংরেজি প্রোব ম্যাগাজিন। দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলসহ নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত ২৪টি রাজনৈতিক দলের নেতাদের ছেলে ও মেয়ের ওপর অনুসন্ধান করে প্রোব।

ওই সময়ের অনুসন্ধানি প্রতিবেদনে বলা হয়, নেতাদের সন্তানদের খোঁজখবর নিতে প্রোব রাজনৈতিক নেতাদের বা তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। এর মধ্যে আছেন আওয়ামী লীগের ৩৪ নেতা, বিএনপির ৩২ নেতা, জাতীয় পার্টির ৫ নেতা, জামায়াতে ইসলামীর ৬ নেতা, জেপির ২ নেতা, জেএসডি (ইনু)-র ৩ নেতা, ওয়ার্কার্স পার্টির ২ নেতা, সিপিবির ৩ নেতা, গণফোরামের ২ নেতা, এলডিপির ২ নেতা ও অন্যান্য দলের ১৪ নেতা।

আরও পড়ুন >>> তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে কি তা বাংলাদেশ?

সন্তানদের বিষয়ে রাজনৈতিক ১০৫ নেতাকে ফোন করা হয়। তাদের দেওয়া তথ্যমতে, আওয়ামী লীগের ৩৪ নেতার মধ্যে ২৪ জনের ছেলেমেয়ে বিদেশে পড়াশোনা করছেন। বিএনপিতে ৩২ জনের মধ্যে এই সংখ্যা ২৬। জামায়াতে ইসলামীর ছয় নেতার মধ্যে ৫ জনের সন্তান পড়াশোনা করছেন বিদেশে। জাতীয় পার্টির ক্ষেত্রে ৫ জনে এই সংখ্যা ৪। অন্যান্য দলের ২৭ নেতার মধ্যে ১৫ জনের সন্তানই বিদেশে পড়ছেন। এই জরিপ অনুযায়ী রাজনৈতিক নেতাদের শতকরা ৭৪ ভাগেরই সন্তান বিদেশে পড়াশোনা করছেন।

ওই সময়ের প্রতিবেদনের পর আর কোনো গণমাধ্যম কিংবা সংস্থা রাজনীতিবিদদের সন্তানদের বিদেশে পড়াশোনা নিয়ে প্রতিবেদন করেছেন বলে জানা যায়নি। তাই এটি সর্বশেষ প্রতিবেদন হিসেবে ধরা যায়।

নিজে রাজনীতি করলেও সন্তানদের রাজনীতিতে আনেন না বেশিরভাগ রাজনীতিবিদ। ফলে রাজনৈতিক বলি হওয়ার ঝুঁকি নেই তাদের সন্তানদের। অন্যের সন্তানদের মানে কর্মীদের নিয়েই ‘পলিটিক্স’ করেন নেতারা।

প্রতিবেদনটি এখনো প্রাসঙ্গিক কারণ ওই সময়ে করা প্রতিবেদনের বেশিরভাগ রাজনীতিবিদ এখনো বেঁচে আছেন। ওই সময়ে যেসব রাজনীতিবিদের সন্তান বিদেশে পড়াশোনা করেছেন বলা হয়েছে তাদের বেশিরভাগই ওইসব দেশে অর্থাৎ আমেরিকা, কানাডার মতো উন্নত দেশগুলোয় স্থায়ী হয়েছেন বলে জানা গেছে। নিজে রাজনীতি করলেও সন্তানদের রাজনীতিতে আনেন না বেশিরভাগ রাজনীতিবিদ। ফলে রাজনৈতিক বলি হওয়ার ঝুঁকি নেই তাদের সন্তানদের। অন্যের সন্তানদের মানে কর্মীদের নিয়েই ‘পলিটিক্স’ করেন নেতারা

জনশ্রুতি আছে, সাধারণ পরিবারের যেসব সন্তান বিদেশে পড়াশোনা করতে যান তারা সেইখানে কাজ করে টিউশন ফিসহ সব খরচের টাকা জোগাড় করেন। অন্যদিকে রাজনৈতিক পরিবারের সন্তানদের কাজ করতে হয় না। দেশ থেকেই যায় তাদের পড়ালেখাসহ থাকা খাওয়ার সব খরচ। এসব পরিবারের সন্তানদের সঙ্গে একসময় বেগমরাও চলে যান বিদেশে। গড়ে তোলা হয় বসতি। তাই উন্নত দেশের কোনো কোনো জায়গা বেগমপাড়া হিসেবেও ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে।

আরও পড়ুন >>> গেস্টরুম আতঙ্ক বন্ধ হবে কবে? 

কান টানলে যেমন মাথা আসে তেমনি একটি বিষয়ের সঙ্গে আরেকটি বিষয় প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। বছর দুয়েক আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, কানাডায় বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ এবং আমলাদের বাড়ি-ঘরের তথ্য তারা পেয়েছেন। একটি অনুষ্ঠানে হঠাৎ বিস্ফোরকের মতো এমন তথ্য তিনি জানিয়েছিলেন। মন্ত্রীর এমন কথায় তখন দুর্নীতি দমন কমিশনও নড়েচড়ে বসে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে জানতে চাওয়া হয়, বাংলাদেশিদের মধ্যে কাদের বাড়িঘর কানাডায় আছে। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে এই তথ্য আর আসেনি দুদকে। ব্যক্তিগতভাবে দুদকের তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজনের সঙ্গে কথা বলেছি তা নিয়ে। তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে জানতে চাইলে অফ দ্য রেকর্ডে ওই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ‘নিজের হাত পোড়াতে চাই না, তদন্তে আর আগাতে চাই না’।

আদিত্য আরাফাত ।। বিশেষ প্রতিনিধি, ডিবিসি নিউজ