বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের কী অবস্থা? প্রশ্নটা কিছুটা তাত্ত্বিক, কিছুটা টেকনিক্যালও বটে। একেবারে সাধারণ মানুষের পক্ষে এই প্রশ্নের উত্তর সঠিকভাবে দিতে পারার কথা নয়।

ব্যাংকিং এবং আর্থিক খাত বিষয়ে অভিজ্ঞ অর্থনীতির ছাত্র-শিক্ষকরাই বিষয়গুলো নানা তথ্য উপাত্ত এবং তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে এর সমাধান দিতে পারবেন। কিন্তু এসবের বাইরেও মানুষের ধারণাগত কিছু মন্তব্য থাকে। যাকে চলতি ভাষায় আমরা বলি পাবলিক পারসেপশন বা জনমত। তো, সেই পাবলিক পারসেপশন বা জনমত বলে ভালো নেই আমাদের ব্যাংকিং খাত।

আবার বাজারে গেলে পণ্যমূল্যের তাপে হাত পুড়ে যাওয়ার অবস্থা। তবুও কিন্তু বাজারে মানুষের উপস্থিতির কমতি নেই। তা বিলাসবহুল শপিংমল, মাঝারি মানের মার্কেট, ফুটপাত কিংবা নিত্যপণ্যের কাঁচাবাজার—সব জায়গায় ক্রেতার প্রবল সরব উপস্থিতি। অর্থাৎ পকেট ফাটলেও মানুষ ঠিকই কিনছেন অথবা কিনতে বাধ্য হচ্ছেন তার কাঙ্ক্ষিত পণ্য কিংবা সেবা।

আর এই করতে গিয়ে কয়েক বছরের দিকে চোখ রাখলে দেখা যায় কমে গেছে মানুষের সঞ্চয়ের সক্ষমতা। বরং অনেক মানুষ সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন। তবে এর বাইরেও আরেকটি ধারা আছে। কয়েক বছরে দেশে অতি ধনীর সংখ্যা বেড়েছে। বেড়েছে কোটিপতি লাখপতির সংখ্যাও।

অবশ্য লাখপতি এখন আর গোনার মধ্যে আনার মতো কোনো বিষয় নয়। অথচ একটা সময় ছিল—কারও লাখ টাকা হলে তিনি বাড়িতে লাখের বাতি জ্বালাতেন। পাইক বরকন্দাজ রেখে আলাদা পাহারার ব্যবস্থা করতেন। তা অবশ্য ভিন্ন আলোচনা। কিন্তু প্রশ্ন হলো—কয়েক বছরে আমাদের অর্থনীতির এমন বেড়াছেড়া অবস্থা হলো কেন? কেন কিছু মানুষের হাতে অনেক সম্পদ চলে গেল? কেন বেশিরভাগ মানুষের কাছে সম্পদের মালিকানা কমে গেল?

....চোখ রাখলে দেখা যায় কমে গেছে মানুষের সঞ্চয়ের সক্ষমতা। বরং অনেক মানুষ সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন। তবে এর বাইরেও আরেকটি ধারা আছে। কয়েক বছরে দেশে অতি ধনীর সংখ্যা বেড়েছে। বেড়েছে কোটিপতি লাখপতির সংখ্যাও।

গণমাধ্যম বলছে, ভালো নেই দেশের ব্যাংকগুলো। রিজার্ভ নেমেছে ২২ বিলিয়ন ডলারে। খেলাপি ঋণের ফাঁদে আটকা পড়ে শেয়ারধারীদের লভ্যাংশ দিতে পুজিঁবাজারে তালিকাভুক্ত রাষ্ট্রখাতের একমাত্র ব্যাংক রূপালি ব্যাংক। এর কারণ কী?

গণমাধ্যম বলছে, পর্যাপ্ত যাচাই বাছাই ছাড়া বড় ঋণ প্রদান এবং দুর্বল আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করার মাশুল দিচ্ছে ব্যাংকটি। এখন এসব ঋণ আদায় করতে না পেরে ধুঁকছে ব্যাংকটি। বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। ব্যাংকটির ঋণ দিয়ে যে সুদ আদায় হচ্ছে তারচেয়ে বেশি সুদ দিতে হচ্ছে আমানতকারীদের।

আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ছাড় সুবিধা নিয়ে ২০২২ সালে ২১ কোটি টাকা মুনাফা দেখিয়েছে ব্যাংকটি। এখন বোঝা গেল শুভঙ্করের ফাঁকিটি আসলে কোথায়? ভেতরে ভেতরে ধুঁকে ধুঁকে মরে যাচ্ছে একটি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু কাগজে কলমে তা আবার লাভজনক। এ কোন ধরনের মারপ্যাঁচ। এই জন্যই শুরুতে বলেছিলাম—এই হিসাব বোঝার সাধ্য সাধারণ মানুষের নেই।

এ তো গেল একটি প্রতিষ্ঠানের কথা। এই রকম আরও বহু প্রতিষ্ঠান আছে যাদের অবস্থা কমবেশি একই রকম। চার দশকে ইসলামী ব্যাংকিং ধারা অনুসরণ করে যারা অভূতপূর্ব সাফল্য পেয়েছে তাদের অন্যতম মালয়েশিয়া। দেশটির অর্থনীতির ভিত তৈরিতে শরিয়াহ ভিত্তিক ব্যাংকিং অবস্থার অবদান যুগান্তকারী।

বাংলাদেশেও ইসলামী ধারার ব্যাংকিং ব্যবস্থার সূচনা হয় ১৯৮৩ সালে। এবং তা দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়। কিন্তু অর্থনীতিতে কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখার আগেই আস্থার সংকটে পড়েছে এই ধারার ব্যাংকিং ব্যবস্থা। বাংলাদেশে বর্তমানে সব মিলিয়ে ইসলামী ধারার ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান দশের কাছাকাছি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তিন দশকে প্রচলিত ধারার ব্যাংকিং ব্যবস্থার চেয়ে ইসলামী ধারার ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় দ্বিগুণ। কিন্তু প্রথমবারের মতো এক বছরে এই ধারার ব্যাংকিং পিছিয়ে পড়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব কেন হচ্ছে? কীভাবে হচ্ছে?

সরকারের কিন্তু সদিচ্ছা কিংবা আন্তরিকতার অভাব নেই। তবুও কেন এই খাতের অনিয়ম কমানো যাচ্ছে না? আচ্ছা, এসবের মধ্যেও কয়েক বছরে কতগুলো নতুন ব্যাংকের অনুমোদন মিলেছে? আবার সবাই মিলে কতগুলো ব্যাংক খেয়ে ফেলেছে? হ্যাঁ, স্রেফ খেয়ে ফেলা হয়েছে বেশকিছু ব্যাংক।

...পর্যাপ্ত যাচাই বাছাই ছাড়া বড় ঋণ দিয়ে এখন আদায় করতে পারছে না রুপালি ব্যাংক। কিন্তু কথা হলো পর্যাপ্ত যাচাই বাছাই ছাড়া বড় বড় ঋণগুলো তারা ছাড় দেয় কীভাবে?

আবার আবদুল হাই বাচ্চু কিংবা পি কে হালদাররা হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে বিদেশে পালিয়ে গেছেন। এদের নাম হয়তো বারবার আলোচনায় আসে তাদের নিয়ে বিস্তর লেখালেখি এবং চর্চা হওয়ার কারণে। কিন্তু এমন কত লোক আছেন আমাদের সমাজে, যারা সবাই মিলে ফোকলা করে দিচ্ছে আমাদের সব। সেই হিসাব কে রাখে?

শুরুতে বলছিলাম—পর্যাপ্ত যাচাই বাছাই ছাড়া বড় ঋণ দিয়ে এখন আদায় করতে পারছে না রুপালি ব্যাংক। কিন্তু কথা হলো পর্যাপ্ত যাচাই বাছাই ছাড়া বড় বড় ঋণগুলো তারা ছাড় দেয় কীভাবে?

আপনি বা আমি এক লাখ কিংবা চার পাঁচ লাখ টাকা ঋণ নিতে কোনো একটা সরকারি অথবা বেসরকারি ব্যাংকে গেলে ঋণ দেওয়ার আগে একেবারে নাড়ি নক্ষত্র থেকে শুরু করে চৌদ্দগোষ্ঠীর ঠিকুজি বের করে তারপর ঋণ দেওয়া না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু বড় বড় অঙ্কের ঋণগুলো দেওয়ার সময় পর্যাপ্ত যাচাই বাছাই ছাড়া দেয় কীভাবে? কেন দেয়?

সুতরাং বলা যায় বাচ্চু কিংবা হালদার কিংবা অন্য যেকোনো ব্যাংকখেকো আপনাআপনি গড়ে ওঠে না। আকাশ থেকে পড়ে না, পাতাল ফুঁড়েও ওঠে না। তাদের কেউ যত্ন পরিচর্যায় বড় করে নিজেদের লাভের জন্য।

বাংলাদেশ আইএমএফ থেকে ঋণ নিয়েছে। তা নিয়ে অনেকেই সমালোচনায় মুখর। কিন্তু তা নিয়ে আমি সমালোচনার কিছু দেখি না। ঋণ নেওয়ার মধ্যে দোষের কিছু নেই। কিন্তু কথা অন্যখানে। আইএমএফ’র ঋণের শর্ত অনুযায়ী ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের রিজার্ভ ২৫ দশমিক ৩০ ডলারে উন্নীত করার কথা রয়েছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে রিজার্ভ নিতে হবে ২৬ দশমিক ৮০ মিলিয়ন ডলারে। বাংলাদেশের রিজার্ভ কিন্তু এখন ২২ মিলিয়ন ডলার। বাকিটা কোথা থেকে আসবে?

খান মুহাম্মদ রুমেল ।। অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর, সময় টিভি