ছবি : সংগৃহীত

দেবী দুর্গা কে? ‘দ’ অক্ষর দৈত্যনাশক, ‘উ’-কার বিঘ্ননাশক, ‘রেফ’ রোগনাশক, ‘গ’ অক্ষর পাপনাশক ও ‘অ’-কার ভয়-শত্রুনাশক। অর্থাৎ, দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয়-শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা।

অন্যদিকে শব্দকল্পদ্রুম অনুসারে, ‘দুর্গং নাশয়তি যা নিত্যং সা দুর্গা বা প্রকীর্তিতা’-অর্থাৎ, দুর্গ নামক অসুরকে যিনি বধ করেন তিনিই নিত্য দুর্গা নামে অভিহিতা। আবার শ্রীশ্রীচণ্ডী অনুসারে এই দেবীই ‘নিঃশেষদেবগণশক্তিসমূহমূর্ত্যাঃ’ বা সব দেবতার সম্মিলিত শক্তির প্রতিমূর্তি।

দেবী দুর্গার সৃষ্টি হলো কী করে? মহিষাসুর দেবতাদের একশ বর্ষব্যাপী একযুদ্ধে পরাস্ত করে স্বর্গের অধিকার কেড়ে নিলে বিতাড়িত দেবতাগণ প্রথমে প্রজাপতি ব্রহ্মা এবং পরে তাকে সাথে করে শিব ও নারায়ণের সকাশে গেলেন। তারা মহিষাসুরের বৃত্তান্ত শুনে ক্রোধে প্রজ্বলিত হয়ে উঠলেন।

সেই প্রজ্বলিত তেজ থেকে দেবী দুর্গার আবির্ভাব। শিব ও নারায়ণের তেজের সাথে মিলিত হলো অন্যান্য দেবতাদের দেহ থেকে নির্গত সুবিশাল তেজরশ্মি। হিমালয়ে ঋষি কাত্যায়নের আশ্রমে সেই তেজঃপুঞ্জ একত্রিত হয়ে নারীমূর্তি ধারণ করল। ফলে দেবী দুর্গার অন্য নাম হলো কাত্যায়নী।

প্রত্যেক দেবতা তাকে অস্ত্র দান করলেন এবং দেবী মহিষাসুর বধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। শ্রীশ্রীচণ্ডী অনুসারে দেবী দুর্গা মহিষাসুর বধ করেন এবং তিনি দশভূজা দেবীরূপে পূজিত হন।

শ্রীশ্রীচণ্ডী অনুসারে দেবী দুর্গা সংক্রান্ত তৃতীয় ও সর্বশেষ কাহিনি হলো শুম্ভ-নিশুম্ভ বধের কাহিনি। শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামে দুই অসুর স্বর্গ ও দেবতাদের যজ্ঞস্থান ধ্বংস করে দিলে দেবতারা হিমালয়ে গিয়ে বৈষ্ণবী শক্তি মহাদেবীকে স্তব করতে লাগলেন। যা দেবী সর্বভূতেষূ মাতৃরূপেণ সংহিতা... জাতীয় সব স্তবই এই স্তবসমূহের অন্তর্গত।

শুম্ভ-নিশুম্ভকে বধ করার জন্য দেবী ব্রহ্মাণী, মহেশ্বরী, কৌমারী, বৈষ্ণবী, বারাহী, নরসিংহী, ঐন্দ্রী প্রমুখ রূপ ধারণ করেন। এবং শেষপর্যন্ত কালিকারূপ ধারণ করে রক্তবীজরূপী অসুরদের বধ করেন। কিন্তু দেবী দুর্গার সৃষ্টির প্রেক্ষিত কী? স্বর্গ-দখল-করা অসুরদের জন্য দেবতারা বারবার বাছাই করা দেবীদের পাঠাচ্ছেন।

প্রত্যেক দেবতা তাকে অস্ত্র দান করলেন এবং দেবী মহিষাসুর বধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। শ্রীশ্রীচণ্ডী অনুসারে দেবী দুর্গা মহিষাসুর বধ করেন এবং তিনি দশভূজা দেবীরূপে পূজিত হন।

সুন্দর-উপসুন্দরের জন্য তিলোত্তমা নির্মাণ, ধূম্রলোচনের জন্য কৌশিকী, চণ্ড-মুণ্ড-রক্তবীজদের জন্য চামুণ্ডা, শুম্ভ-নিশুম্ভের জন্য চণ্ডিকা। রাজ্যপাট সামলাতে অক্ষম দেবতারা আর যজ্ঞস্থল আগলাতে হিমশিম ঋষিরা সবই করছেন এবং পাঠাচ্ছেন। কিন্তু তাতেও কিছু হচ্ছে না। তারা বিস্তর মার খাচ্ছেন। অতএব সৃষ্ট হলেন দেবী দুর্গা।

দেবী দুর্গা সৃষ্টির গল্পটা কী? যেভাবে বনলতা সেন বা মোনালিসা সৃষ্টি হয়েছিল, ঠিক সেইভাবেই সৃষ্টি হলেন দেবী দুর্গা। শ্রীশ্রীচণ্ডী দুর্গার বর্ণনা বলছে, বিষ্ণু-ব্রহ্মা-শিব-ইন্দ্র প্রমুখ দেবতার মুখ বা শরীর নিঃসৃত মহাতেজরাশি এক অনুপম নারীর মূর্তি নিচ্ছে। কিন্তু এই নারীর শরীরের অনুপুঙ্খ সব অঙ্গই কোনো না কোনো পুরুষের অবদান।

শুধু সন্ধ্যাদেবীদের তেজে তার ভ্রূযুগল এসেছে। দুর্গার অস্ত্র-শস্ত্র-বাহন সবকিছুই দিয়েছেন পুরুষ দেবতারাই। শূল, চক্র, বজ্র, শঙ্খ, ধনু-তূণীর, দণ্ড, পাশ, খড়্গ, কুঠার, ঢাল থেকে সিংহ। এমন কী মালা-কমণ্ডলুও। অঙ্গের সমস্ত বসন-আভূষণ দিয়েছেন তারাই। প্রশ্ন হলো, পুরুষরা এই নারী পূজার চলন কেন এনেছে? পৌরাণিক দেবীই আহূত হন মহালয়ায়, পূজিত হন সর্বজনীন পূজার মণ্ডপে। এই পূজা সর্বজনীন পূজা। বিজয়ের জন্য পূজা। দুর্গাপূজার সর্বজনীনতা আসলে এক নারীকে কেন্দ্র করে সব মানুষের সর্বজনীন ভ্রাতৃত্বের আরেক প্রকাশ, নারীর নিজের উপস্থিতি সেইখানে প্রতীকীমাত্র।

এই অবস্থা কি চিরকালীন? না। পৌরাণিক ভারতের দ্রাবিড় সভ্যতায় মাতৃতান্ত্রিক দ্রাবিড় জাতির মধ্যে মাতৃদেবীর পূজার প্রচলন ছিল। মাতৃরূপে দেবী সংস্কৃতির ধারণা অতি প্রাচীন। প্রায় ২২ হাজার বছর পূর্বে ভারতে প্যালিওলিথিক জনগোষ্ঠী থেকেই দেবী পূজার প্রচলন শুরু হয়েছিল।

হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতা তথা সিন্ধু সভ্যতায় এসে তা আরও গ্রহণযোগ্য, আধুনিক ও বিস্তৃত হয়। মাতৃপ্রধান পরিবারের মা-ই প্রধান শক্তি, তার নেতৃত্বে সংসার পরিচালিত হয়, তার নেতৃত্বে শত্রু নাশ হয়, আর তাই মাকে সামনে রেখে দেবী বিশ্বাসে গড়ে ওঠে, গড়ে ওঠে শাক্ত সম্প্রদায় মত। এই মত অনুসারে দেবী হলেন, শক্তির রূপ, তিনি পরব্রহ্ম। এই সভ্যতা অনেকাংশে হয়ে উঠল যুদ্ধ ও ধর্মকেন্দ্রিক সভ্যতা।

শাস্ত্রীয় বিশ্বাসের সূত্র ধরে যে সময়টা উত্তরায়ণ, অর্থাৎ দেবতারা জেগে থাকেন, সেই সময়ে দুর্গাপূজা করার বিধি। রাধারমণ রায়ের মতে, আগে এই দেশে বসন্তকালে হতো দুর্গাপূজা। অকালবোধনের কাহিনি বাল্মীকির রামায়ণে নেই। কৃত্তিবাস এটি পেয়েছিলেন দুটি গৌণ পুরাণ থেকে, যার উৎপত্তি বাংলা বা পূর্ব ভারতে।

আকবরের রাজত্বকালেই ১৫৮০ সাল নাগাদ তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ বাংলাদেশে শারদীয়া দুর্গাপূজার সূচনা করেন বলে জানা যায়। পুরাণ মতে, রাজা সুরথ করেন বাসন্তী পূজা এবং রাবণ বধের আগে রামচন্দ্র করেন শারদীয়া দুর্গাপূজা। সেনযুগে যে বাসন্তী দুর্গাপূজার সূচনা হয়েছিল, সেইখানে রামের জন্মতিথিকে এই পূজার নবমীর সঙ্গে যুক্ত করা হয়, যা রামনবমী নামে পরিচিত।

সেনযুগে পাল আমলের বৌদ্ধ আধিপত্যের স্থানে বাংলায় হিন্দু ব্রাহ্মণ্য ঐতিহ্যকে প্রতিষ্ঠিত করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তার ফলস্বরূপ উত্তর ভারতের বৈদিক সংস্কৃতির সঙ্গে মাতৃতান্ত্রিক আরাধনাকে সংযুক্ত করার প্রয়োজন দেখা দেয়। এরই ফলস্বরূপ বাসন্তী দুর্গার নবমীর সঙ্গে একাত্মতা তৈরি হয় রামের জন্মতিথির।

একই উদ্দেশ্যে রামের অকালবোধনের বিষয়টি যুক্ত হয় শারদীয়া দুর্গাপূজার ক্ষেত্রে। বাঙালি কবি কৃত্তিবাসের রামায়ণে রাম কর্তৃক দেবীকে আরাধনা করার প্রসঙ্গটি বর্ণিত হয়েছে, মূল বাল্মীকির রামায়ণে তা নেই।

তাহলে আগে কী হতো? সাহিত্যিক রাধারমণ রায় লিখেছেন, ‘সেনযুগে দুর্গাপূজা পরিণত হয় রাজ-রাজড়া আর দস্যু-তস্করের পূজায়। রাজ-রাজড়ারা এই পূজা করতেন বছরের শ্রেষ্ঠ ঋতু বসন্তকালে।’

তিনি আরও জানাচ্ছেন, সেনযুগে সূচিত এই বাসন্তী দুর্গাপূজা আকবরের আমলে প্রায় নয় লাখ টাকা ব্যয়ে সম্পন্ন করেন ভাদুরিয়া-রাজশাহীর সামন্তরাজা জগৎনারায়ণ। আশ্চর্য লাগে এই ভেবে যে, জগৎনারায়ণ এবং কংসনারায়ণ দুইজনেই অধুনা বাংলাদেশের সামন্তরাজা হওয়া সত্ত্বেও একজনের পূজা পরবর্তী সময়ে পরিণত হয়েছে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবে, অন্যজনের পৃষ্ঠপোষিত উৎসব বিস্মৃতির অতলে।

তবে শারদীয়া দুর্গাপূজার গুরুত্ব বৃদ্ধির পেছনে মোগল আমলে রাজস্ব প্রদানের যে নতুন নিয়ম বলবৎ হয়, তারও খানিকটা ভূমিকা ছিল। নতুন নিয়মে দিল্লিতে মোগল সম্রাটের কাছে প্রাদেশিক শাসনকর্তা, অর্থাৎ নবাবকে ভাদ্র মাসের নির্দিষ্ট দিনে রাজস্ব পাঠানোর নির্দেশ জারি হয়। অর্থাৎ স্থানীয় রাজা বা জমিদারদের তার আগেই নির্দিষ্ট পরিমাণ খাজনা জমা দিতে হতো।

শাস্ত্রীয় বিশ্বাসের সূত্র ধরে যে সময়টা উত্তরায়ণ, অর্থাৎ দেবতারা জেগে থাকেন, সেই সময়ে দুর্গাপূজা করার বিধি। রাধারমণ রায়ের মতে, আগে এই দেশে বসন্তকালে হতো দুর্গাপূজা।

এই নির্দিষ্ট খাজনা বাদ দিয়ে রাজস্বের বাকি অংশ ছিল স্থানীয় রাজা বা জমিদারদের প্রাপ্য। তাই সঞ্চিত রাজস্বের অনুষঙ্গে অর্থনৈতিক দিক থেকে শরতের এই সময়টি ছিল বসন্তের তুলনায় উৎসব উদযাপনের উপযুক্ত সময়। অতএব হিন্দু রাজা-জমিদারদের একটা বড় অংশ নিজেদের কৌলীন্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে শারদীয়া দুর্গাপূজার প্রতি সমর্থন দেওয়া শুরু করেন।

এই ক্ষেত্রে চূড়ান্ত আঘাতটি অবশ্যই পলাশীর যুদ্ধ এবং ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠা। ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে কলকাতাকে কেন্দ্র করে যে নতুন ক্ষমতাকেন্দ্র তৈরি হয়, তার ফলে বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনে শারদীয়া দুর্গাপূজার একমাত্রিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা লাভ করে। যে হেতু শরৎকালে অনুষ্ঠিত শারদীয়া দুর্গাপূজা রাম কর্তৃক অকালবোধন নামে পরিচিত, সেই রামের ভূমিকা এক্ষেত্রেও সমানভাবে উচ্চারিত হয়েছে। বৃহদ্ধর্মপুরাণ অনুসারে রাম রাবণ বধের জন্য দেবীর বোধন করেছিলেন আশ্বিনের কৃষ্ণা নবমীতে।

বৃহদ্ধর্মপুরাণের আখ্যানে রাবণের মধ্যম ভ্রাতা অতিকায় দৈত্য কুম্ভকর্ণ ত্রয়োদশীতে, অমাবস্যার রাত্রিতে ইন্দ্রজিৎ মেঘনাদ, প্রতিপদে মকরাক্ষ, দ্বিতীয়াতে দেবান্তক প্রমুখ শক্তিশালী বীর রাক্ষসেরা রামের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হলেন। এরপরে স্বয়ং রাবণের সঙ্গে অন্তিম যুদ্ধের কালে সপ্তমীতে দেবী রামের অস্ত্রে প্রবেশ করলেন। অষ্টমীতে রাম-রাবণের প্রবল যুদ্ধ হলো, অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে রাবণকে রাম বধ করলেন। বোঝাই যায় যে বৃহদ্ধর্মপুরাণের এই আখ্যান প্রচলিত কাহিনির থেকে পৃথক। প্রচলিত কাহিনি অনুসারে নবমী পূজার অন্তে দশমীর দিনে রাম রাবণকে বধ করেছিলেন।

শ্রীশ্রীচণ্ডীতে দেবীর নিজস্ব শক্তির গরিমার স্তুতি করা হয়েছে। অন্যান্য ধর্মে যখন নারীর ভূমিকার এত দৃঢ স্বীকারোক্তি তর্কসাপেক্ষ, ওই প্রাচীনকালেই হিন্দুধর্মে পূজিতা দেবীর এই প্রাধান্যের স্বীকৃতি বিস্ময় জাগায় বৈকি! তাই এটা খুবই দুঃখের যে, দেশ জুড়ে যখন আমরা দেবীপূজার মাধ্যমে এই নারীশক্তির বন্দনা করছি, তখন সেই দেশেই নারীর কত নির্যাতন করা চলছে। মৃন্ময়ী মূর্তি থাক, সংসারের সব চিন্ময়ী ‘দুর্গা’র শক্তি স্বীকার করাই হবে প্রকৃত মন্ত্রোচ্চারণ, সত্যিকারের পূজা।

অমিত গোস্বামী ।। কবি ও কথাসাহিত্যিক (ভারত)