আমার মধ্যে অনেক বোধ হয়তো কখনোই তৈরিই হতো না হিন্দু ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত এলাকায় বেড়ে না ওঠলে। যেখানে জন্মগ্রহণ করেছি, জীবনের সবচেয়ে আনন্দের সময় কাটিয়েছি কারণ পাশের পাড়া ছিল হিন্দুপাড়া।

কয়েকদিন আগে বাবা গ্রামে গিয়ে আমাকে ভিডিও কল দিয়ে বলে নাও তোমার দিদির সাথে কথা বলো। তুমি ছোটবেলা তার কাছে পড়তে। আমি ভিডিওতে প্রথমে তাকে চিনতে পারছিলাম না। নিজের কাছে খুব অস্বস্তি হচ্ছিলো কেন চিনতে পারছি না!

আহা মাঝে কতটা সময় পার হয়েছে! দিদি আমাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন তুমি আমার কাছে পড়তে। তখন তুমি ওয়ান টুতে পড়ো। তোমার বাবা মাঝেমাঝে তোমার হাতে বিস্কুটের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বলতো দিদিকে দাও, যাতে তুমি মানুষকে দেওয়া শেখো, মনে নেই?

দিদি একরাশ খুশি মুখে কী ভীষণ আন্তরিকভাবে সেই স্মৃতি গড়গড় করে বলে যাচ্ছিলেন যেন ঐ সময়টা তার চোখের সামনে উপস্থিত! এরপর আমার মনে পড়লো আরে তাই তো! পড়া শেষ করে পাশের বাড়ি থেকে গরম গরম গুড়ের জিলাপি কিংবা বাদাম কিনে খেতে খেতে বাড়ি ফিরতাম।

অসুখবিসুখ হলে তো কথাই নেই, আবার না হলেও সাদা হোমিও বড়ির লোভে জ্যোতিষ দাদার বাড়িতে গিয়ে বসে থাকতাম! আর জ্যোতিষ দাদার মেয়ে নারায়ণী পিসি একেবারে আমার নিজেরই পিসি ছিল। কত যে আবদার ছিল সেইখানে! এই সম্পর্কগুলো তৈরি হয়েছিল আমার পরিবারের কারণে। সবার সাথে আমাদের ছিল পারিবারিক সম্পর্ক। ঠিক একইরকম সম্পর্ক ছিল অন্যান্য মুসলিম পরিবারের সাথেও। তাদের কোনো একটা আয়োজনে আমরা নেই এটা কখনো হয়নি।

মানিক দাদার বিয়েতে গেছি, অপরূপ সুন্দর বউ। স্কুলে যাওয়ার পথে আমি বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করি বউ দেখার জন্য। একদিন টের পেয়ে মানিক দাদা আমাকে ডেকে নিয়ে গেল বাড়ির ভেতরে। বউয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো এই দ্যাখো এটা কিন্তু আমার পাত্রী। বাড়িতে আসলে ঠিকঠাক খাওয়াবা কিন্তু! স্কুলে যাওয়ার পথে, রাস্তায় দেখা হলে মানিক দাদা হাতের মধ্যে লজেন্স, চানাচুরের প্যাকেট ধরিয়ে দিতো।

আমার স্কুলে যাওয়ার পথ ছিল হিন্দুপাড়ার ওপর দিয়ে। প্রতিমা বানানো হচ্ছে। মাটি, বাঁশ, খড় ইত্যাদি দিয়ে তৈরি দশহাতের দুর্গা আমাদের চোখের সামনেই আস্তে আস্তে বিকশিত হতো...

একদিন হাত ধরে দোকানে নিয়ে গিয়ে লজেন্স কিনে দিচ্ছেন আমার সাথে থাকা বন্ধু ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো প্রীতি, উনি তোমার কে হয়? আমি বলেছিলাম আমার দাদা। একেবারে নিজের দাদা। পরে বলল—কিন্তু সে তো হিন্দু! বলেছিলাম তাতে কী, তাও সে আমার নিজের দাদা।

ছোট ছিলাম, বুঝতাম না কীভাবে ধর্মীয় হিসাবনিকাশ করতে হয়, কীভাবে সম্পর্ককে উপস্থাপন করতে হয়। ধর্ম কিংবা রক্তের সম্পর্ক ছাপিয়ে পারস্পরিক যূথবদ্ধতা যে নির্মল ও শক্তিশালী একটা সম্পর্ক তা প্রকাশ করার ক্ষমতা তখন ছিল না। আমার চোখে হিন্দুপাড়ার কেউই প্রতিবেশী ছিল না, ছিল আমার আত্মীয়স্বজন। এখন মনে পড়লে আমার ভীষণ ভালো লাগে। ভাগ্যিস এমন একটা পরিবেশ পেয়েছিলাম! 

ও হ্যাঁ পূজা এসেছে! আমরা ছোটরা আগেই তা টের পেয়ে যেতাম। আমার স্কুলে যাওয়ার পথ ছিল হিন্দুপাড়ার ওপর দিয়ে। প্রতিমা বানানো হচ্ছে। মাটি, বাঁশ, খড় ইত্যাদি দিয়ে তৈরি দশহাতের দুর্গা আমাদের চোখের সামনেই আস্তে আস্তে বিকশিত হতো। একদিন দেখতাম দেবীর পায়ের নিচে মহিষাসুর, যাকে বধ করা হয়েছে।

কী অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম! আরও আছে সরস্বতী, লক্ষ্মী, গণেশ, কার্তিক। কাঠামো দাঁড়িয়ে গেলে একদিন রঙ লাগানো হয়। এরপর একদিন শেষ হয়ে যায় প্রতিমা তৈরির কাজ। আকাশে বাতাসে নাড়ুর মৌ মৌ গন্ধ। ঢাকের শব্দ ও শঙ্খধ্বনিতে শুরু হয় পূজা। এরপর আসবে দেবীর বোধন। সেইদিন আমাদের স্কুল বন্ধ থাকবে।

পূজার সময় স্কুল থেকে বাড়ির ফেরার কোনো তাড়া ছিল না। এই বাড়ি ওই বাড়ি উঁকিঝুঁকি দেওয়া মানেই মুঠো ভর্তি নাড়ু। সাথে থাকতো মৌখিক নিমন্ত্রণপত্র; প্রীতি, তোমার মাকে নিয়ে এসো, শিপা ফুপুকে সন্ধ্যায় আসতে বলো। তাদের কেউ আমার সম্পর্কে দাদা, কেউ কাকা, কেউ পিসি, কেউ কাকী।

পূজার কর্মযজ্ঞ দেখে গায়ে নাড়ুবড়ির গন্ধ মেখে সন্ধ্যার আগে আগে বাড়িতে ঢুকতাম। আমার দাদি এলাকায় খুবই জনপ্রিয় মানুষ ছিল। তার আঁচল ধরে ঘোরার কারণে আমিও সবার অকারণ ভালোবাসা পেতাম।

পূজার সময় স্কুল থেকে বাড়ির ফেরার কোনো তাড়া ছিল না। এই বাড়ি ওই বাড়ি উঁকিঝুঁকি দেওয়া মানেই মুঠো ভর্তি নাড়ু। সাথে থাকতো মৌখিক নিমন্ত্রণপত্র...

দুর্গাপূজা কয়েকদিন ধরে হয়। আহা আনন্দ! পূজার পুরো সময়টা দাদির সাথে গ্রামের সব মণ্ডপে গিয়ে পূজা দেখতাম আর সবার সাথে আনন্দ উদযাপন করতাম। আমার কাছে পূজা মানেই ছিল খাওয়াদাওয়া। যে বাড়িতেই যাই মজার মজার খাবার মেলে।

সেই ছোটকাল থেকে এখন পর্যন্ত আমার প্রিয় লুচি লাবড়া আর মুগ ডালের ভুনা খিচুড়ি। তবে অবশ্যই তা পূজার বাড়ির হতে হবে। কারণ অন্য সময় কত জায়গায় খেয়েছি কিন্তু পূজার লুচি-লাবড়া আর ভুনা খিচুড়ির মতো স্বাদ কখনোই পাইনি। আর নাড়ু যে কত প্রকারের হতে পারে তাও আমি জানি পূজার কারণে।

একবার সন্ধ্যায় চৌগ্রামের তেলিপাড়ায় তরুণ দাদার বাড়ির মণ্ডপে গিয়েছি। রাত বেশি হওয়ায় কখন যে মণ্ডপেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম! পরেরদিন সকালে ঘুম ভাঙে নিজের বাড়িতেই। মাঝে রাতটা উবে গেল! আমি তো আর হিসাব, মেলাতে পারি না! ঐ যে বলেছিলাম না সবাই আমার আত্মীয়স্বজন! এতরাতে দাদি ঘুমন্ত আমাকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারবে না ভেবে কেউ একজন আমাকে কোলে করে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গেছে।

ছোট ছিলাম, কৌতূহল ছিল অপার। দাদির কাছে কিংবা পরিবারের কাছে পূজার এই অপরূপ দর্শন প্রতিমা নিয়ে জানতে চাইলে তারা যতটুকু জানে তারা জানিয়েছিল।

জানার পর থেকে আমাকে তুমুল আকর্ষণ করতো দেবীর শক্তি। বড় হয়ে বন্ধুদের দেখেছি। জেনেছি নবরাত্রির কথা। এই নবরাত্রিই নাকি দুর্গোৎসব নামে পরিচিত। এই সময়ে শৈলপুত্রী, ব্রহ্মচারিণী, চন্দ্রঘণ্টা, কুষ্মাণ্ডা, স্কন্দমাতা, কাত্যায়নী, কালরাত্রি, মহাগৌরী, সিদ্ধিদাত্রী দেবীর পূজা করা হয়। সেই ছোটবেলাতেই আমাদের গ্রামের বাড়িতে বাইবেল দেখেছি। আমার দাদি পড়তো। তখন বুঝিনি কিন্তু এখন ভাবি এইটাই তো স্বাভাবিক, এমনটাই তো হওয়া উচিত!

আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি প্রতিটা ধর্ম সুন্দর, প্রতিটা ধর্মের বাণী সুন্দর, প্রতিটা ধর্মের বার্তা সুন্দর তবে অবশ্যই ধর্মকে সুন্দর রাখে মানুষ। আবার ধর্মকে নানাভাবে অসুন্দরও করে মানুষই। এই যে অসুন্দর করা হয়, যে বা যিনি অসুন্দর করে তোলেন, আসলে এতে কার ধর্মটা অসুন্দর হয় বলুন তো?

ওয়ারেছা খানম প্রীতি ।। প্রেসিডেন্ট, হার ই-ট্রেড