ছবি : সংগৃহীত

সিরাজউদ্দৌলা নাটকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব সিরাজউদ্দৌলা অসহায় হয়ে বলেছিলেন—‘বাংলার আকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা। কে তাকে আশা দেবে, কে তাকে ভরসা দেবে।’

আমরাও মনেপ্রাণে চাই আমাদের অর্থনীতিতে দুর্যোগের কালো মেঘ যেন ছায়া ফেলতে না পারে। অদম্য বাংলাদেশ সক্ষমতা ও সমৃদ্ধির আলোকবর্তিকা নিয়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যেতে পারে বিরতিহীনভাবে।

তবে বাস্তবতা হচ্ছে, সবকিছু মিলে অর্থনীতিতে চরম অস্থিরতা বিদ্যমান। মূল্যস্ফীতির আস্ফালনে দিশেহারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। বৈদেশিক মুদ্রার উচ্চহার ও মজুদের পতন দৃশ্যমান। প্রয়োজনের তুলনায় বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানির সংকট চলমান।

বাণিজ্য ঘাটতি ও মুদ্রা পাচার তো রয়েই গেছে। তাছাড়া, সামনে জাতীয় নির্বাচন। আর নির্বাচন মানে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার আশঙ্কা। ইতিমধ্যে আন্দোলন ও সহিংসতার ডামাডোল শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক হরতাল অর্থনীতিকে পঙ্গু করছে। পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, সর্বাঙ্গে ব্যথা ওষুধ দেব কোথা?

২৯ জুলাই ২০২২ ‘ঢাকা পোস্ট’-এ প্রকাশিত হয়েছে আমার লেখা 'সন্নিকটে সংকট: শঙ্কিত কি অর্থনীতি!'। তখনকার জাতীয় ও বৈশ্বিক আর্থিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এই শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছিল। তখন ভেবেছিলাম, এই শঙ্কা হয়তো সাময়িক। করোনা মহামারি উত্তর পরিস্থিতির উন্নতিকল্পে ধীরে ধীরে তা হয়তো দূর হয়ে যাবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আর্থিক দুর্গতি অক্টোপাসের মতো আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে জাপটে ধরছে।

দুর্দিনের দুর্ভাবনা জেঁকে বসতে চাইছে যা স্ট্যাগফ্লেশনেরই ইঙ্গিত। সহসাই তা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না। আমরা এর ভয়ংকর পরিণতি আঁচ করতে পারছি। তবে, তা থেকে পরিত্রাণের সঠিক উপায় খুঁজে পাচ্ছি না। আর এর জন্য আমরা সবাই ভীত সন্ত্রস্ত।

একটি সবল ও কার্যকর অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ রসদ জোগায় বৈদেশিক মুদ্রা ভাণ্ডার। ক্রমাগত পতনের কারণে এই ভাণ্ডারে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ প্রায় তলানিতে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের অত্যাবশ্যকীয় জরুরি আমদানিসহ পূর্বের বকেয়া বিল ও বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধে বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ থেকে প্রয়োজনীয় ডলার ছাড় করতে বাধ্য হচ্ছে। প্রতি কর্মদিবসে বিক্রি করছে প্রায় ৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

পরিস্থিতি আঁচ করে সরকারের পক্ষ থেকে অপ্রয়োজনীয় আমদানি নিয়ন্ত্রণ ও আইএমএফ থেকে ৪.৭০ বিলিয়ন ডলারের ঋণ গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০২২ সালে। কিন্তু সব চেষ্টাই যেন ব্যর্থ হচ্ছে। কোনোভাবেই এর পতন ঠেকানো যাচ্ছে না‌।

কোনোক্রমেই ডলার খরচে হ্রাস টানা যাচ্ছে না। কেননা, বিদেশি কোম্পানিগুলো বকেয়াসহ চলতি আমদানি ব্যয় পরিশোধ না করলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

ঋণ প্যাকেজের জন্য, আইএমএফ বাংলাদেশর জন্য বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ, রাজস্ব সংগ্রহ এবং জ্বালানির স্বয়ংক্রিয় মূল্য সমন্বয়, বাজার ভিত্তিক সুদের হার, ব্যাংকিং খাতে সংস্কারসহ বেশকিছু লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল।

বাংলাদেশ ইতিমধ্যে ৪৭৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রথম কিস্তি ঋণ পেয়েও গেছে। অবশিষ্ট ঋণ প্রাথমিক অনুমোদনের পর থেকে ৪২ মাসের মধ্যে ৭০৪ মিলিয়ন ডলারের ছয়টি সমান কিস্তিতে পাবে। ঋণের গড় সুদের হার পড়বে প্রায় ২.২ শতাংশ।

আইএমএফ ঋণের শর্ত হিসেবে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ২৫.৩৪ বিলিয়ন ডলার এবং পরের বছরের জুনের মধ্যে ২৬.৮১ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিয়েছিল।

তবে, বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে গত সেপ্টেম্বরে বিপিএম ৬ অনুযায়ী মজুদের পরিমাণ ছিল ২১.০৫ বিলিয়ন ডলার যা আগস্টের চেয়ে ২.২০ বিলিয়ন ডলার কম। ইউএনবি রিপোর্টে নিট ভিত্তিতে এর পরিমাণ ১৮ বিলিয়ন ডলারের নিচে উল্লেখ করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এই পরিস্থিতিতে দ্বিতীয় কিস্তির ঋণ পেতে অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে বিধায়, বৈদেশিক মুদ্রা মজুদের লক্ষ্যমাত্রা শিথিল করতে আমাদের পক্ষ থেকে আইএমএফকে অনুরোধ করা হয়। অনুরোধ বিবেচনা করে আইএমএফ লক্ষ্যমাত্রা শিথিল করেছে।

আমাদের পক্ষ থেকে চলতি বছরের ডিসেম্বরের শেষে মজুদ ১৮.৪ বিলিয়ন ডলার এবং আগামী বছরের জুনের শেষে ২০ বিলিয়ন ডলারে রাখার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এটি একটি ভালো সংবাদ।

তবে, পুনরায় নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমাদের অবশ্যই সচেষ্ট হতে হবে। কিন্তু শঙ্কা হচ্ছে যে, কোনোক্রমেই ডলার খরচে হ্রাস টানা যাচ্ছে না। কেননা, বিদেশি কোম্পানিগুলো বকেয়াসহ চলতি আমদানি ব্যয় পরিশোধ না করলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

প্রয়োজনীয় আমদানির অভাবে পরিবহন ব্যবস্থায় অরাজগতা ও বিদ্যুৎ-ছাঁটাই আরও বেড়ে গেলে জনঅসন্তোষ দেখা দিতে পারে। অনেক শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলস্বরূপ, বেকারত্ব আরও বাড়বে। মুদ্রাস্ফীতির নাকালের মাঝে জনদুর্ভোগ ও আর্থিক অনিশ্চিত চরমে পৌঁছবে। যা কখনো কাম্য নয়।

কেন কমছে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ? এর কারণ খুঁজতে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার দীর্ঘদিন কৃত্রিমভাবে ডলারের বিনিময় হার ৮৪ থেকে ৮৬ টাকায় ধরে রেখেছিল। ডলারের বিনিময় হার ধরে রাখার নীতি আমাদের রপ্তানিকে বিশ্ব প্রতিযোগিতায় দুর্বল করেছে।

আমদানিকে উসকে দিয়েছে। বিশ্ববাজারে সুদহার এবং পণ্য মূল্য বাড়ায় আমদানিতে অধিক ডলার খরচ হয়েছে। এছাড়া ওভার বা আন্ডার ইনভয়েসিং, হুন্ডি ও অন্যান্য কালো মাধ্যমে মুদ্রা পাচার বৈদেশিক মুদ্রাভাণ্ডার ক্রমান্বয়ে নিঃশেষিত করছে।

বর্তমানে, ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে রপ্তানিতে ডলার প্রতি ৯৯ টাকা এবং রেমিট্যান্সে ১০৮ টাকা দর নির্ধারণ করেছিল। সেইখান থেকে প্রায় প্রতি মাসে দর বাড়িয়ে এখন রপ্তানি ও রেমিট্যান্স উভয় ক্ষেত্রেই ১১০ টাকা করা হয়েছে। যদিও হুন্ডির মাধ্যমে ডলার পাঠিয়ে প্রবাসীরা পাচ্ছেন ১১৭ থেকে ১২০ টাকা। তাই, ব্যাংকিং চ্যানেলের চেয়ে বৈদেশিক রেমিট্যান্স প্রেরণকারীদের কাছে হুন্ডি বেশি জনপ্রিয়।

গণমাধ্যমের তথ্যমতে, এই অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে রেমিট্যান্স ১৩.৩৪ শতাংশ কমে ৪৯২ কোটি ডলার দেশে এসেছে। ২০২২ সেপ্টেম্বরে মাত্র ১৩৪ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে, যা ৪২ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। ভবিষ্যতের ডলারের দর আরও বাড়বে এই আশায় অনেকে এখন খোলাবাজার থেকে ১১৮ থেকে ১১৯ টাকা দরে ডলার কিনে ঘরে মজুদ করছেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের বর্তমান নিট মজুদ দিয়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। তবে এর নিচে নেমে গেলে তা ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং ভিন্ন উৎস থেকে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ পেতে কঠিন হবে। আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী, একটি দেশের ছয় মাসের বেশি আমদানি দায় মেটানোর বৈদেশিক মুদ্রার মজুদকে একটি অর্থনীতির জন্য অধিক নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত হয়।

অনেকের মতে, হুন্ডির চাহিদা না কমিয়ে ডলারের দর নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হিতে বিপরীত হয়েছে। এতে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ধারাবাহিকভাবে কমছে। আবার একসময় সস্তায় নেওয়া স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপে পড়েছে বেসরকারি খাত। সরকারি খাতেও বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধের দায় রয়ে গেছে। সব মিলিয়ে প্রকৃত রিজার্ভ কমে এখন প্রান্তিক সীমায় নেমেছে।

মুদ্রাস্ফীতিকে কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। রপ্তানির তুলনায় আমদানি বেশি। রাজস্ব আহরণে ঘাটতি। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স একমাত্র ভরসা হলেও ব্যাংকিং মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রবণতা কমে যাচ্ছে।

দীর্ঘমেয়াদি করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাবের সাথে সম্প্রতি ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধের নেতিবাচক বৈশ্বিক প্রভাব অর্থনীতিতে যুক্ত হয়েছে। বিশ্ব পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হলে জ্বালানির দাম বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে, মূল্যস্ফীতি প্রভাব মারাত্মক হবে এবং রিজার্ভের ওপর চাপ আরও বাড়তে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

খারাপ খবর হচ্ছে, বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ হ্রাস ও ঋণ পরিশোধের বিলম্বের কারণে ইতিমধ্যে এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল এবং মুডিসের মতো প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং এর ঋণাত্মক অবনমন দেখিয়েছে। এতে করে জরুরি প্রয়োজনে আমাদের ভবিষ্যতে বৈদেশিক ঋণ পেতে বেশি খরচ বহন করতে হবে।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ব্যাংকিং মাধ্যমে রেমিট্যান্স বাড়াতে হুন্ডি প্রতিরোধসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বাজারে তারল্য বাড়াতে এক্সপোর্ট রিটেনশন কোটা (ইআরকিউ) হিসাবের ৫০ শতাংশ নগদায়নের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তুলনামূলক কম প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।

এসব উদ্যোগের ফলে ডলার বাজার দ্রুত ঠিক হয়ে যাবে এবং মূল্যস্ফীতিও কিছুটা কমবে বলে আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, আগস্টের মূল্যস্ফীতি ৯.৯৩ শতাংশের চেয়ে কিছুটা কমে সেপ্টেম্বরে ৯.৬৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

তবে, অনেকে এরই মধ্যে ভাবতে শুরু করেছে যে, বৈদেশিক মুদ্রা মজুদের পতন না ঠেকানো গেলে আমরাও কি শ্রীলঙ্কার মতো আর্থিক দুর্দশায় পড়তে যাচ্ছি! কেননা, খাদ্যের স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও আমাদের অর্থনীতি খুবই জনবহুল।

মুদ্রাস্ফীতিকে কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। রপ্তানির তুলনায় আমদানি বেশি। রাজস্ব আহরণে ঘাটতি। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স একমাত্র ভরসা হলেও ব্যাংকিং মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রবণতা কমে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ২০২২ সালের শ্রীলঙ্কার অবস্থা এখন আর নেই।

সরকারি ব্যয় কমানো ও রাজস্ব আয় বাড়ানোর পাশাপাশি সংস্কার কার্যক্রম জোরদার করার ফলে দ্রুত ঘুরতে শুরু করেছে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির চাকা। কাজেই, দুর্যোগ আসার আগেই আমাদের যথাযথ কর্তৃপক্ষের উচিত জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ও কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া। অন্যথায়, পরিস্থিতি হয়তো নাগালের বাইরে চলেও যেতে পারে।

নীলাঞ্জন কুমার সাহা ।। ডিন, ফ্যাকাল্টি অব বিজনেস স্টাডিজ ও অধ্যাপক, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়