ছবি : সংগৃহীত

ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা বাংলাদেশে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ডেঙ্গু রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা বিচারে ২০২৩ সালে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। একুশ কোটির (২১.৬৪ কোটি) অধিক জনসংখ্যার দেশ ব্রাজিলে ডেঙ্গু রোগী বেশুমার (২৫.৭০ লাখ)। অন্য সব ডেঙ্গুপ্রবণ দেশকে ঠেলে আমাদের অবস্থান দ্বিতীয়, আমাদের ভর্তি রোগীর সংখ্যা ২.৮২ লাখ। এর বাইরে ভর্তি নেই এবং শনাক্ত হয়নি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাও অঢেল।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মনে করছে, বেশিরভাগ ডেঙ্গু সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার বাইরে থেকে যায়। আমাদের পরে পেরুর রোগী ২.৩৫ লাখ এবং বলিভিয়ার সংখ্যা ১.৩৭ লাখ। এশিয়ার ডেঙ্গু প্রবণ দেশ ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম আমাদের ধারে কাছেও নেই।

পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া গোটা ভারতে সম্মিলিত ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা খুব বেশি নয়। ডেঙ্গু বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের দাপ্তরিক কোনো তথ্য নেই, তবে ফাঁকফোঁকর গলে আসা উপাত্তের সম্মিলনে তা এক লাখের নিচে।

বৈশ্বিক বা প্রতিবেশী দেশে কী হলো তাতে আমাদের যে খুব যায় আসে তা নয়, যদি না সেইখান থেকে আমাদের দেশে সংক্রমণ আমদানি না হয়। এখন মোক্ষম প্রশ্ন হলো, ডেঙ্গুতে দ্বিতীয় স্থান লাভের উপায় কী! সেই ২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গু যে আমাদের পেয়ে বসলো তার আর ছাড় নেই।

ধরতে গেলে চোখের সম্মুখেই ২৩ বছরে তা ডালপালা মেলে বিশাল মহিরুহতে রূপান্তরিত হলো। কেন অঙ্কুরোদগম কালে না হোক শিশুকালে এই ডেঙ্গু দৈত্যকে নিবৃত করা গেল না, এখন পূর্ণবয়স্ক এই দৈত্যকে রুধিবে কে?

জলবায়ু পরিবর্তন এবং অপরিকল্পিত নগরায়ন এডিস মশার বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। উষ্ণতা বৃদ্ধিতে শীতপ্রধান দেশগুলোয় যেমন ডেঙ্গুর ঝুঁকি বাড়ছে, তেমনি আমাদের দেশে দীর্ঘায়িত হচ্ছে ডেঙ্গু মৌসুম।

নির্মূল কর্মসূচি শুরু করে আঠারো বছরের (২০০৫ সাল থেকে ২০২৩ সাল) মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে কালাজ্বর নির্মূলের সনদ প্রাপ্তি হলো, প্রায় সমান সময়কালে পাহাড় পর্বত ডিঙিয়ে ম্যালেরিয়ার মতো ভয়াবহ রোগকে নিয়ন্ত্রণ করা গেল (২০২৩ সালে রোগী ১২ হাজারের মতো, মৃত্যু ৪ জন) তা হলে অনুরূপ বাহক বাহিত রোগ, ডেঙ্গু কেন নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না তা মেনে নেওয়া কঠিন।

বাংলাদেশের ডেঙ্গু চিত্র ২০২৩ (১ জানুয়ারি ২০২৩ থেকে ৬ নভেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত); সূত্র : স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

ডেঙ্গু কেন নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন তার কিছু কারণ আছে। ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে এখনো কার্যকরী ও ব্যাপকসংখ্যক জনগণকে সুরক্ষা দেওয়ার মতো টিকা নেই। দুইটা টিকা অনুমোদন পেয়েছে কিন্তু মাত্র একটি দেশ (ফিলিপাইন) তা কিছুটা ব্যাপক হারে প্রয়োগ করেও পিছিয়ে এসেছে জটিলতার আশঙ্কায়।

রোগটির চিকিৎসা করার জন্য কোনো অ্যান্টিভাইরালও নেই, যার মাধ্যমে রোগী থেকে রোগীতে সংক্রমণ কমানো যেতে পারে। ডেঙ্গুবাহক এডিস মশা আমেরিকা ও এশিয়ার ক্রান্তীয় দেশগুলোয় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশেও তা একসময়ে সীমাবদ্ধ মহানগরগুলো থেকে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং অপরিকল্পিত নগরায়ন এডিস মশার বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। উষ্ণতা বৃদ্ধিতে শীতপ্রধান দেশগুলোয় যেমন ডেঙ্গুর ঝুঁকি বাড়ছে, তেমনি আমাদের দেশে দীর্ঘায়িত হচ্ছে ডেঙ্গু মৌসুম।

ঋতু বহির্ভূত অকাল বৃষ্টিপাতও আমাদের দেশে ডেঙ্গু মৌসুমকে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রসারিত করেছে। বাহক নিয়ন্ত্রণ আমাদের অপর্যাপ্ত এবং যেটুকু আছে তা পুরোনো আমলের। কীটতাত্ত্বিক সক্ষমতাহীন মশকনিধন কর্মী নির্ভর এই কার্যক্রম তাই এডিস নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে।

ডেঙ্গু শনাক্তকরণ একটি বড় সমস্যা; এর নানা ধরন ও লক্ষণ নিয়ে চিকিৎসরাও বিভ্রান্তিতে রয়েছে, চিকিৎসা নিতে দেরি হওয়ায় অনেককে প্রাণ দিতে হচ্ছে। ল্যাবরেটরির পরীক্ষাগুলোও কখনো কখনো ডেঙ্গু শনাক্ত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রচলিত পরীক্ষায় ডেঙ্গু নেগেটিভ অনেকগুলো কেস পিসিআর পরীক্ষায় পজিটিভ হয়েছে।

ডেঙ্গু কোনো একক রোগ নয়, বরং চারটি সেরোটাইপের প্রত্যেকটি আলাদা আলাদা রোগ হিসেবে বিবেচনার দাবি রাখে। আবার কিছু সাদৃশ্যের ফলে পরবর্তী সেরোটাইপ দ্বারা সংক্রমণে মারাত্মক জটিলতার ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। জনগণের সচেতনতা এবং জনসম্পৃক্ততা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও তা সর্বাত্নকভাবে কাজে লাগানোয় ঘাটতি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

ডেঙ্গু এইবার যে মাত্রা ও ব্যাপকতায় ছড়িয়েছে সেই অনুপাতে তার নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতি অপ্রতুল। ঢাকার বাইরে তা নেই বললেই চলে।

স্বাস্থ্য বিভাগের সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে মৃত্যুর হার। সুবিস্তৃত মানসম্পন্ন স্বাস্থ্য সেবার অভাবে মৃত্যু হার ও মোট সংখ্যা বেড়ে যায়। ব্যাপক চলাচলের সাথে ডেঙ্গু বিস্তৃতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে।

আমাদের দেশে অভ্যন্তরে পর্যটন ও কার্যোপলক্ষ্যে ব্যাপক হারে যোগাযোগ বৃদ্ধি সারা দেশজুড়ে ডেঙ্গু ছড়ানোর জন্য দায়ী। ডেঙ্গু এইবার যে মাত্রা ও ব্যাপকতায় ছড়িয়েছে সেই অনুপাতে তার নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতি অপ্রতুল। ঢাকার বাইরে তা নেই বললেই চলে।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমরা কালাজ্বর নির্মূল এবং ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণের অভিজ্ঞতা ভালোমতোই কাজে লাগাতে পারি। প্রসঙ্গত এই দুটি রোগও বাহকবাহিত এবং গ্রামেগঞ্জে দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে বিস্তৃত।

প্রথমত ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ভালো নেতৃত্ব দরকার। স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে তা সম্ভব নয়। স্বাস্থ্য বিভাগের নেতৃত্ব প্রয়োজন। একটি জাতীয় ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কর্মকৌশল এবং কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন, জাতীয় কারিগরি কমিটি কার্যকরণ, দীর্ঘ মেয়াদে অর্থ বরাদ্দ, কীটতাত্ত্বিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, ব্যাপক প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে জনসম্পৃতকরণ প্রয়োজন।

অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ ।। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ; স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক