ছবি : সংগৃহীত

পিটার হাস বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত। কিন্তু তিনি নিছক দূতিয়ালিতেই নিজের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ রাখেননি। পিটার হাস এখন বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে আলোচিত চরিত্র। কূটনীতির সীমা ছাড়িয়ে তিনি প্রায়শই নাক গলান বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে। বলা ভালো কূটনীতির চেয়ে রাজনীতিতেই তার আগ্রহ বেশি।

যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে সবসময় বলেন, বাংলাদেশে কোনো দলের পক্ষে-বিপক্ষে তাদের অবস্থান নেই। তারা শুধু একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চান। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনী প্রক্রিয়া শান্তিপূর্ণ রাখতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন ভিসা নীতিও ঘোষণা করেছে। যারাই নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন সৃষ্টি করবে, তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাবেন না।

এই নীতি সরকারি দল, বিরোধী দল সবার জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের প্রতিটি পদক্ষেপই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে যায়। তার পদক্ষেপ উজ্জীবিত করে বিএনপি নেতাকর্মীদের।

রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলে যুক্তরাষ্ট্র এখানের রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে চায়। এমনকি মার্কিন রাষ্ট্রদূত সরকারের বিপক্ষে রাজনৈতিক ক্যাম্পেইন পরিকল্পনাতে অংশ নিয়েছিল বলে অভিযোগ করে রাশিয়া। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে, তবে বাস্তবতা হলো পিটার হাসের সব তৎপরতাই বিএনপির পক্ষে যায়।

বিএনপি নেতারা প্রকাশ্যে পিটার হাসকে অবতার বলে সম্বোধন করেন। তার এই অতি তৎপরতার কারণে মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়ারও নজর থাকে তার ওপর। কদিন আগে হঠাৎ চাউর হলো তিনি নয়াদিল্লি গেছেন। পরে দেখা গেল খবরটি ভুয়া।

এরপর জানা গেল, তিনি ওয়াশিংটন ফিরে যাচ্ছেন। ওয়াশিংটন না গেলেও ১৬ নভেম্বর শ্রীলঙ্কায় যান তিনি। আনুষ্ঠানিকভাবে জানা গেছে, তিনি ছুটি কাটাতে গেছেন। কিন্তু তার এই ছুটি নিয়েও বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুজব ডালপালা মেলে। তিনি কবে ফিরবেন, শ্রীলঙ্কা থেকে কোথায় যাবেন, সেইখানে কার কার সাথে বৈঠক করবেন ইত্যাদি নানান গুজব।

....এই নীতি সরকারি দল, বিরোধী দল সবার জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের প্রতিটি পদক্ষেপই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে যায়। তার পদক্ষেপ উজ্জীবিত করে বিএনপি নেতাকর্মীদের।

আসলে পিটার হাস শ্রীলঙ্কায় ছিলেন, না অন্য কোথাও গেছেন, সেইখানে তিনি কী করেছেন জানি না। ১২ দিন ছুটি কাটিয়ে ২৭ নভেম্বর বাংলাদেশে ফিরেছেন। মজার ব্যাপার হলো, ছুটি কাটিয়ে একজন রাষ্ট্রদূত ফিরেছেন, এটা বাংলাদেশের অধিকাংশ গণমাধ্যমের খবর ছিল।

গণমাধ্যমকেই-বা দোষ দিয়ে কী হবে। কারও যদি বাংলাদেশের রাজনীতি, এমনকি প্রভাবিত করার ক্ষমতা থাকে; তাকে পাত্তা না দিয়ে উপায় আছে। পিটার হাস দেশে ফেরার পর দুইদিন টানা বড় দরপতন হয়েছে শেয়ারবাজারে। খোঁজ নিয়ে জানলাম, পিটার হাস নতুন কোনো নিষেধাজ্ঞা নিয়ে ফিরছেন, এমন শঙ্কায় শেয়ারবাজারে দরপতন ঘটেছে। ভাবা যায়!

তারচেয়ে বড় বিস্ময়কর হলো, যে কদিন তিনি ছিলেন না, সেই কদিন বিএনপিকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পিটার হাস ফিরতেই আবার চাঙা হয়েছে বিএনপির নেতাকর্মীরা। গ্রেপ্তারের ভয়ে পালিয়ে থাকা নেতারাও প্রকাশ্যে এসেছেন। একবার ভাবুন, বাংলাদেশের বড় একটি দলের তৎপরতা নির্ভর করে একজন রাষ্ট্রদূতের থাকা না থাকার ওপর।

এমনিতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে একজন রাষ্ট্রদূত বারবার নাক গলাচ্ছেন, এটা বাংলাদেশের কারওই পছন্দ হওয়ার কথা নয়, পছন্দ হওয়া উচিত নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের বড় একটা অংশ পিটার হাসের কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করছেন। তারা আশায় বসে থাকেন, পিটার হাস কখন, কী করছেন; তার অপেক্ষায়।

....দায় আছে আমাদের রাজনীতিবিদদেরও। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন দুটি কোনো মানদণ্ডেই ভালো হয়নি, গ্রহণযোগ্য হওয়া তো অনেক পরের ব্যাপার।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে পিটার হাস তথা যুক্তরাষ্ট্রের এই নাক গলানো আমার খুবই অপছন্দ। কিন্তু যতই অপছন্দ হোক, পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের খবরদারি আমাদের মেনে নিতে হচ্ছে। এর দায় আমাদেরই। বাংলাদেশের গণমাধ্যম, মার্কিন রাষ্ট্রদূতদের বরাবরই আমরা মাথায় তুলে রেখেছি। যতটা প্রাপ্য, যতটা ন্যায্য; তারচেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। এখন আর তাদের নামাতে পারছি না।

দায় আছে আমাদের রাজনীতিবিদদেরও। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন দুটি কোনো মানদণ্ডেই ভালো হয়নি, গ্রহণযোগ্য হওয়া তো অনেক পরের ব্যাপার। সেই দুটি খারাপ নির্বাচনের ফাঁক গলে এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন আমাদের ওপর খবরদারি করতে আসছে। আমরা এখন নাও করতে পারছি না, হ্যাঁও করতে পারছি না।

বিদেশি পর্যবেক্ষকরা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে আসবে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু তারা যদি আমাদের স্বৈরাচারী আচরণ করে তখন আপত্তি। বিদেশিদের এই খবরদারিটা ভালো লাগেনি প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালেরও।

দুইদিন আগে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের বাইরে থেকেও থাবা পড়েছে—এটি দুর্ভাগ্যজনক। তারা (বিদেশি শক্তি) থাবা বিস্তার করে রেখেছে। তবে আমাদের অর্থনীতি, ভবিষ্যৎসহ অনেক কিছুই রক্ষা করতে হলে এই নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য করতে হবে।’

সিইসি ঠিক কথায় বলেছেন। ইচ্ছা না থাকলেও এই অশুভ থাবা আমাদের মেনে নিতে হচ্ছে। নির্বাচন ভালো না হলে পরবর্তীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নানামুখী হুমকি ঝুঁকিতে ফেলতে পারে আমাদের অর্থনীতিকেও। তাই আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করা ছাড়া আমাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই। এটা আমাদের রাজনীতির স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে, অর্থনীতির স্বার্থে, দেশের স্বার্থে জরুরি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করতে চেয়েছে। এই চাওয়াটা দোষের কিছু নয়। নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে আমরা নষ্ট করেছি বলেই, তারা আসার সুযোগ পেয়েছে। বিদেশি শক্তির খবরদারি যেহেতু আমরা উপেক্ষা করতে পারবো না। তাই আমার চাওয়া হলো, এর থেকে ভালো কিছু আদায় করে নেওয়া।

যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ’র চাপে যদি বাংলাদেশে একটা অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়; যদি নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা ফেরে মন্দ কী? একটা বিজ্ঞাপন ছিল, আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে—দাগ থেকে যদি দারুণ কিছু হয়, তাহলে তো দাগই ভালো।

প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ