ছবি : সংগৃহীত

বাহারি ও শৌখিন পরিবহন হিসেবে ঢাকায় রিকশার আগমন ঘটে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকে, যা পঞ্চাশ ও ষাট দশক থেকে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শহুরে জীবনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে রিকশাকে এই শহরের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশই বলা যেতে পারে। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ তো বটেই সেই সাথে খুব আপন ও পরিবেশবান্ধব একটি পরিবহন।

আধুনিক নগরায়নে এই পরিবহন বেশি থাকা উচিত বলে আমি মনে করি। কারণ অন্যান্য পরিবহনের বেলায় একটা বিশেষ প্রটোকলের মধ্য দিয়ে আমাদের সেই বাহনে উঠতে হয়, কিন্তু রিকশা একেবারেই বলতে গেলে ঘরের দুয়ারের বাহন। জনমানুষের বাহন।

রিকশা চালক এবং যাত্রীর মধ্যে যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে তা কিন্তু শহরের রিকশা আর গ্রামের নৌকা ছাড়া অন্য কোনো পরিবহনের বেলায় তেমন একটা চোখে পড়ে না।

তবে এই রিকশা পেইন্টিং আমার কাছে একটি সাংঘাতিক কর্মযজ্ঞ। এই শিল্পের সাথে জড়িত শিল্পীরা শুধুমাত্র দক্ষ শিল্পীই নয় বরং তাদের মধ্যে শিল্পের প্রতি সংবেদনশীলতা ও বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ রয়েছে।

সমসাময়িক যেকোনো কিছুর প্রভাব তাই চট করে তাদের পরিসরের মধ্যে সহজেই জায়গা করে নেয়। বাস্তবতার প্রভাব যেমনটা চোখে পড়ে, কখনো কখনো কল্পনা, ভাবনা কিংবা আধ্যাত্মিকতার প্রসার ও ঘটে রিকশা পেইন্টিংয়ের ভেতরে।

শহুরে জীবনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে রিকশাকে এই শহরের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশই বলা যেতে পারে। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ তো বটেই সেই সাথে খুব আপন ও পরিবেশবান্ধব একটি পরিবহন।

রিকশা পেইন্টিং ও অলংকরণের দিকে খেয়াল করলে আমরা দেখতে পাবো, এর পরিবর্তন কীভাবে ক্রমান্বয়ে হয়ে এসেছে। পঞ্চাশের দশকে রিকশা পেইন্টিংয়ে প্রাধান্য পেয়েছিল জ্যামিতিক নকশা, গ্রামীণ দৃশ্য, ফুল, পাখি।

পরবর্তীতে জনপ্রিয় সিনেমার নায়ক নায়িকার ছবি, স্বাধীনতা প্রেক্ষাপট এবং সমসাময়িক ভিন্ন ভিন্ন বিষয়বস্তু উপস্থাপন দেখা যায় রিকশা পেইন্টিংয়ে।

রিকশা মোটিফ; ছবি : সংগৃহীত

রিকশা নিজেই যেন একটি ইনস্টলেশন আর্ট। রিকশায় যে কেবল ছবিই থাকে তা কিন্তু নয়। এর গঠন, গড়ন ও সাজ-সজ্জায় নান্দনিকতার একটা ছোঁয়া দেখা যায়। ফ্লাট সারফেসে তুলির আঁচড় যেমনটা চোখে পড়ে তেমনি এর অন্যান্য জায়গায় স্কাল্পচারাল রিলিফ, এমনকি এপলিকের কারুকার্যও এতে স্পষ্টত।

যেমন—রিকশা হ্যান্ডেলে কিছু বাহারি ধরনের ঝালর, আবার কখনো চালকের সামনে একটা কাগজের রঙিন পাখা, রিকশার হুডে সাজানো নান্দনিক কারুকাজ, যা ব্যক্তিগতভাবে আমার ‘মায়ের ঘোমটা’ পরার কথা মনে করিয়ে দেয়।

রিকশা যেন মায়ের মতোই আগলে রাখে যাত্রীকে তার যাত্রা পথে। একজন শিল্পী হিসেবে আমি যখন একটি রিকশাকে দেখি, আমাকে এটি প্রকৃতি ও মায়ের সাথে সম্পৃক্ত করে।

তবে রিকশার পেছনের অংশে লেখা ‘মায়ের দোয়া’ বা ‘মায়ের আশীর্বাদ’ এবং ‘মা’ আমাকে দারুণভাবে মুগ্ধ করেছে। যার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আমি ‘Traveling with mother’ (‘মা’-কে নিয়ে ভ্ৰমণ) সিরিজটির যাত্রা শুরু করি।

আমার কাছে মা এবং প্রকৃতি দুটোই খুব রঙিন অথচ সরল। রিকশা পেইন্টিংয়ের সবচেয়ে বড় মজার ব্যাপার হলো এর সরলতা। এমনকি চালকের সাথে কথোপকথনও যে কাউকে সম্পর্ক স্থাপনে জায়গা করে দিতে পারে ক্ষণিকের ভেতরে।

রিকশা পেইন্টিং ও অলংকরণের দিকে খেয়াল করলে আমরা দেখতে পাবো, এর পরিবর্তন কীভাবে ক্রমান্বয়ে হয়ে এসেছে। পঞ্চাশের দশকে রিকশা পেইন্টিংয়ে প্রাধান্য পেয়েছিল জ্যামিতিক নকশা, গ্রামীণ দৃশ্য, ফুল, পাখি....

হয়তো এই কারণে আমরা অনায়াসে ডাকতে পারি ‘এই খালি যাবে’ কিংবা ‘এই মামা যাবে’। মামা কিংবা মা এই দুটোর মাঝেই একটি বিশেষ সম্পর্ক আছে। অনেকটা কান টানলে মাথা আসার মতো। তাই আমি রিকশা পেইন্টিংয়ের ‘মা’ মোটিফকে একটি হার্ট শেপে খুব সরল, সাধারণ এবং রঙিনভাবে উপস্থাপন করেছি। যা সবাইকে খুব সহজেই আকৃষ্ট করে। মূলত যেকোনো জায়গায় ভ্রমণ কালে যেকোনো নারী কিংবা স্থানের সাথে আমার সম্পর্ক জুড়ে দিতে এই মোটিফ খুব কার্যকরী ভূমিকা রাখে।

ছবি : সংগৃহীত

পরবর্তীতে আমার কাজের মধ্য দিয়ে এই মোটিফ বিভিন্নভাবে রূপান্তরিত হয়। যেমন বৃহত্ত্ব আর্ট ফাউন্ডেশনে এই ফর্মটি ভিন্ন ভিন্নভাবে রূপায়িত হয়েছে। প্রক্রিয়াগতভাবে যেখানে মাটি, পাথর, লোহা, কাঁচ, পরিত্যক্ত চামড়া প্রভৃতির ব্যবহার লক্ষণীয়।

‘মা’ জানালা যেন সবার প্রথম আলিঙ্গন। সকাল বেলা রোদের সাথে আমার আলাপচারিতা, দিনে সবটুকু যেন আমার কর্মস্থলকে আরও উজ্জীবিত করতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এমনকি যেকোনো দর্শক কিংবা গোষ্ঠীর সাথে একটি সম্পর্ক স্থাপন করে দেয়।

একজন শিল্পী হিসেবে আমি মনে করি শুধুমাত্র তাদের কাজ সংরক্ষণ নয়, বরং তাদের কাজের যথাযথ সম্মান এবং অনুপ্রেরণা দেওয়ার মধ্য দিয়ে এই শিল্পী এবং শিল্পকর্মকে আমাদের মাঝে টিকিয়ে রাখা সম্ভব। সেই জায়গা থেকেই আমরা বৃহত্ত্ব আর্ট ফাউন্ডেশনে সচেষ্ট থাকি, তাদের এবং আমাদের মধ্যে সংযোগ ও সম্পর্ক তৈরি করতে।

'ঐ' একটি সমন্বিত প্রকল্প, ‘দ্বৈধ’, ‘মুক্তি’ এইসব প্রকল্প ঠিক তেমনি আমাদের আরও উজ্জীবিত করে স্ব স্ব জায়গায় অবস্থানকে প্রসারিত করতে, যা কি না আমাদের যেকোনো শিল্পচর্চাকে বাঁচিয়ে রাখতে এবং সামনের দিকে অগ্রসর হতে সাহায্য করে।

বিশ্বজিৎ গোস্বামী ।। সহকারী অধ্যাপক, চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়