ছবি : সংগৃহীত

সারা পৃথিবী এখন যুদ্ধ দ্বারা আক্রান্ত। পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার, দমন, পীড়ন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তারপর বিবর্তনের ধারায় পৃথিবী একসময় রাষ্ট্র কাঠামোতে অনেকগুলো সার্বভৌম দেশে পরিণত হলো। কিন্তু দমন পীড়ন কিছুতেই থামলো না শুধু ভিন্নতর রূপ ধারণ করলো। অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশগুলো দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলোর ওপর খবরদারি করছে।

বর্তমান পৃথিবীতে অর্থনৈতিকভাবে এবং সমরাস্ত্রের সম্ভারে পরিপূর্ণ দেশ হিসেবে পৃথিবীতে এক নম্বর দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে ধরা হয় এবং এই ব্যাপারে কারও দ্বিমত আছে বলে আমার মনে হয় না।

তার সাথে জোটবদ্ধ জি-৭ ভুক্ত অন্য ছয়টি দেশ কানাডা, ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, জাপানের সঙ্গে আরও কিছু দেশ আছে যেমন অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভুক্ত অন্যান্য দেশগুলো। যারা সবাই যুক্তরাষ্ট্র যা বলে সেই একই সুরে কথা বলে, একই নীতি অনুসরণ করে।

কিন্তু বর্তমান বিশ্বে ভূ-রাজনীতি অনেক পরিবর্তিত হয়েছে, যেমন অর্থনৈতিক সুপার পাওয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে চীন। যুক্তরাষ্ট্রের পরেই যার অবস্থান, ধীরে ধীরে নিজস্ব টেকনোলজিতে বলিয়ান হয়ে নিউক্লিয়ার পাওয়ার, স্যাটেলাইট পাওয়ার, সমরাস্ত্রের সম্ভার শক্তিশালী করে আমেরিকা এবং তার জোটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে!

তারপর স্নায়ু যুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে রাশিয়া কয়েক দশকের দুর্বলতা কাটিয়ে এখন নতুন শক্তিতে বলিয়ান হয়ে উঠেছে! পৃথিবীর চতুর্থ শক্তি হিসেবে আগমন ঘটেছে ভারতের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থার কারণে আমেরিকার ইন্দো প্যাসিফিক স্ট্রাটেজির বড় অংশীদার হয়ে আবির্ভূত হয়েছে।

বর্তমান বিশ্বে বেশ কয়েকটি চলমান যুদ্ধ যার সবকটির সূত্রপাত হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র আমেরিকার বাইডেন প্রশাসনের যুদ্ধের মাধ্যমে তাদের নীতির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশে বাধ্য করার কৌশল থেকে! ঐ যে আদিম যুগের কৌশল ‘শক্তি দিয়ে বাগে আনা’।

বাইডেন প্রশাসনের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, রাশিয়ার ইচ্ছে ছিল তাদের দাবিকৃত ইউক্রেনের কয়েকটি প্রভিন্স তাদের দখলে আনা, আর আমেরিকার ইচ্ছে ছিল রাশিয়ার এই চেষ্টা বন্ধ করা।

দেখতে দেখতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বছরের উপরে চলে গেলেও কোনো ফলাফল নেই। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার হলো সারা পৃথিবীতে। বন্ধ হয়ে গেল ইউক্রেন থেকে খাদ্য সামগ্রী বিভিন্ন দেশে রপ্তানি!

অন্যদিকে তেল এবং গ্যাস সম্পদে সমৃদ্ধ রাশিয়ার আংশিক তেল গ্যাস রপ্তানি বন্ধ করায় ইউরোপসহ সারা পৃথিবীতে প্রাকৃতিক গ্যাস এবং তেলের সংকট সৃষ্টি হলো—হু হু করে বেড়ে গেল জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম।

যার পরিণতিতে বাংলাদেশ করোনার সময় জমানো রিজার্ভের ঊর্ধ্বগতিতে ভীষণভাবে ছেদ পড়ল, জ্বালানি আমদানিতে প্রচুর রিজার্ভ ব্যবহার হলো, বাংলাদেশের রিজার্ভে টান পড়ল। মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে গেল পৃথিবী জুড়ে। বাংলাদেশে প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়ে গেল।

দ্বিতীয় যুদ্ধ বাধালো ইসরায়েল-হামাসের মধ্যে, যদিও শুরুটা হামাসের মাধ্যমে হয়েছে। কিন্তু বাইডেন প্রশাসন ও জোট চাইলে সহজেই যুদ্ধ বন্ধ করতে পারত, কিন্তু তারা তা না করে ইসরায়েলকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে হামাস দমনের নাম পুরো গাজা উপত্যকা ফিলিস্তিন মুক্ত করার প্রতিজ্ঞায় মেতে উঠল।

ফলাফল প্রায় ২৬০০০ ওপর সাধারণ ফিলিস্তিন এবং ২০০০ এর কাছাকাছি সাধারণ ইসরায়েলি সৈন্যের মৃত্যু এবং অসংখ্য আহত! আন্তর্জাতিক আদালত ইসরায়েলকে যুদ্ধ বন্ধের আদেশ দিলেও ইসরায়েল যুদ্ধ বন্ধে অস্বীকৃতি জানাল। তবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আমেরিকার চোখ রাঙানো উপেক্ষা করে রাষ্ট্রীয়ভাবে ফিলিস্তিনের প্রতি জোরালো সমর্থন জানিয়েছে। তবে বাংলাদেশের বিরোধী দল আমেরিকার প্রতি নতজানু হয়ে ফিলিস্তিনকে সমর্থন দান থেকে বিরত থেকেছে যেটা খুবই দুঃখজনক!

বর্তমানে চলমান তৃতীয় যুদ্ধ—আমেরিকা এবং তার জোট রাষ্ট্রগুলো একত্রিত হয়ে ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের উপর আক্রমণ করছে, উদ্দেশ্য একটাই তাদের লোহিত সাগর থেকে বিতাড়িত করা। লোহিত সাগর এশিয়া এবং আফ্রিকার মধ্যে সংক্ষিপ্ত পথে যোগাযোগের মাধ্যম। আবার লোহিত সাগরের প্রায় এক হাজার কিলোমিটার পার হয়ে সুয়েজ খাল দিয়ে ইউরোপের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়।

বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলে খরচ অনেক কম। হুতি বিদ্রোহীদের যোদ্ধারা লোহিত সাগরে চলা জাহাজের উপর মাঝে মাঝে আক্রমণ চালাচ্ছে, কিন্তু এই যুদ্ধের ফলে লোহিত সাগর দিয়ে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল বিঘ্নিত হলে আবারও খাদ্যপণ্য ও জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

আবার আমেরিকার তাইওয়ান পলিসিতে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সামরিক মহড়া চলমান! উভয় দেশই তাদের নিজস্ব শক্তি বৃদ্ধি করছে। চীন এখনো তাইওয়ানকে তাদের অংশ বলেই মনে করে, আর তাইওয়ান নিজেদের সবসময়ই স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসাবে মনে করে। যুক্তরাষ্ট্র সমরাস্ত্র দিয়ে সমর্থনে তাইওয়ানের এই দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন দিয়ে চলেছে।

২০২৪ সালের শেষে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এর জোরালো সম্ভাবনা আছে আবার প্রেসিডেন্ট হওয়ার। অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে হয়তো ডোনাল্ড ট্রাম্প পৃথিবীর সব যুদ্ধ পরিহার করে অর্থনৈতিক ভূ-রাজনীতির দিকেই নজর দেবে বলেই মনে করা হচ্ছে। দেখা যাক পৃথিবীর সুবাতাস ফিরত আসে কি না!

আব্দুল্লা রফিক ।। সাবেক প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ কানাডা এসোসিয়েশন, ক্যালগেরি
arafique@cirrea।ty.ca