ছবি : সংগৃহীত

ডা. সামন্ত লাল সেন দেশের নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী, টেকনোক্র্যাট, রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত নন। একদশক পর রাজনীতিবিদ মোহাম্মদ নাসিম ও ব্যবসায়ী শিল্পপতি জাহিদ মালেকের পর টেকনোক্র্যাট চিকিৎসক মন্ত্রী।

পূর্বতন দুই মন্ত্রীর আমলে স্বাস্থ্যখাতে অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে; অনেক হাসপাতাল হয়েছে, অনেক মেডিকেল কলেজ হয়েছে, অনেক ডাক্তার নার্স নিয়োগ হয়েছে, অসংখ্য যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হয়েছে, অনেক স্বাস্থ্য সূচকের অগ্রগতি হয়েছে আবার জ্ঞাত-অজ্ঞাত অনেক অনিয়ম দুর্নীতি হয়েছে। তবে যেটা হয়নি তা হলো স্বাস্থ্য সেবার মান, জন মানুষের সন্তুষ্টি, নিজ পকেটের চিকিৎসা ব্যয় এবং মানবিকতা।

এত এত হাসপাতাল হওয়া সত্ত্বেও লক্ষ লক্ষ মানুষ চিকিৎসা নেওয়ার জন্য ভারত যাচ্ছে, সিঙ্গাপুর থাইল্যান্ড যাচ্ছে। হতে পারে চাহিদার তুলনায় আমাদের প্রয়োজনীয় সংখ্যক হাসপাতাল এখনো যথেষ্ট নয়, হতে পারে সেবায় অসন্তুষ্টির কারণে রোগীরা বিদেশে যাচ্ছে।

চিকিৎসা ব্যয় ভয়ানকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরীক্ষা নিরীক্ষার উচ্চহার, অন্যবশ্যক অতিরিক্ত টেস্ট করানো, হাসপাতালে মাত্রাতিরিক্ত সব ফিস এবং ওষুধের উচ্চ মূল্য সামগ্রিক চিকিৎসা ব্যয় রকেট গতি পাচ্ছে।

খরচ যে শুধু বাড়ছে তাই নয় বিপর্যয়কর স্বাস্থ্য খরচে ধসে পড়ছে মানুষ, দারিদ্র্যের চক্রায়নে নিপতিত হচ্ছে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা সূচকে বাংলাদেশ বহু যোজন পশ্চাতে। স্বাস্থ্যের এই প্রেক্ষাপটে ডা. সামন্ত লাল সেন যিনি একজন সেলেব্রিটি, একজন মানব দরদী, পোড়া রোগ চিকিৎসায় একজন কিংবদন্তি, যার হাত ধরে গড়ে উঠেছে শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটের মতো বিশাল এক প্রতিষ্ঠান, তার কাছে আমাদের প্রত্যাশা কী হতে পারে।

চিকিৎসা ব্যয় ভয়ানকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরীক্ষা নিরীক্ষার উচ্চহার, অন্যবশ্যক অতিরিক্ত টেস্ট করানো, হাসপাতালে মাত্রাতিরিক্ত সব ফিস এবং ওষুধের উচ্চ মূল্য সামগ্রিক চিকিৎসা ব্যয় রকেট গতি পাচ্ছে।

স্বভাবত এখানে জনগণের প্রত্যাশা তাদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। তবে গ্রহীতার বাইরে প্রত্যাশীর বাইরে সেবাদানকারীদের প্রত্যাশাও ফেলে দেওয়ার নয়। স্বাস্থ্য সেবার কথা আসলেই নাম আসে ডাক্তারদের নাম, আসে নার্সদের নাম, আসে হাসপাতাল-ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নাম।

চিকিৎসাকে বাণিজ্যিকরণের ধারাবাহিকতায় সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা প্রত্যাশীর সংখ্যা ক্রম নিম্নমুখী, এখন তা ২০ শতাংশেরও নিচে। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে আসা এই স্বল্প সংখ্যক মানুষও হাসপাতালে এসে সব পরীক্ষা হাসপাতালে করাতে পারছেন না, সব ওষুধপত্রাদি হাসপাতাল থেকে পাচ্ছেন না।

ডা. সামন্ত লাল সেনের কাছে প্রত্যাশা হতে পারে দেশের সব সরকারি হাসপাতালে যত রোগী আসবেন, ডাক্তার তাদের রোগ নির্ণয়ে যত পরীক্ষা করতে উপদেশ দেবেন তা যেন সরকারি হাসপাতালে হয়। কথাটি ছোট হলেও বিষয়টা কিন্তু ছোট নয়, অনেক অনেক বড়।

দেশে প্রায় পাঁচশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স আছে। এখানে মেডিকেল অফিসার আছেন, বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শক আছেন। তারা প্রতিদিন যে রোগী দেখেন তাদের রোগ নির্ণয়ে অসংখ্য পরীক্ষা করার দরকার হয়। সেইসব পরীক্ষার জন্য প্রয়োজন হয় নানা যন্ত্রপাতি, রিয়েজেন্ট, ফিল্মসহ নানান জিনিসের।

বর্তমানে আমাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোয় নামমাত্র পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়ে থাকে। মলমূত্র থেকে রক্তের সাধারণ পরীক্ষা কিছু বায়োকেমিস্ট্রি সাধারণ এক্সরে কোথাও কোথাও আলট্রাসনোগ্রাম। সব ধরনের প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে করতে হলে বড় আকারের বিনিয়োগ লাগবে এবং তা এককালীন হলে হবে না তা চলমান থাকতে হবে।

এখানে প্রথম বাধা হবে বাজেটের অপর্যাপ্ততা; বছর দুয়েকের হ্রাসকৃত স্বাস্থ্য বাজেটে এই স্ফীত বাজেট চাহিদা বরাদ্দ করতে নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হবে। বরাদ্দের পর আসবে এই বিশাল সংখ্যক যন্ত্রপাতি এবং অন্যান্য জিনিসপত্র ক্রয় করা। এটা স্বচ্ছতার সাথে দুর্নীতিমুক্ত প্রক্রিয়ায় সময়মতো করতে পারা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।

এই ক্রয়ের সাথে যে খেলোয়াড়রা জড়িত, তারা বাপকে ছেড়েও কথা বলে না এবং মন্ত্রী মহোদয় নিজে যেহেতু ক্রয়ে থাকতে পারবেন না, সুতরাং স্বাস্থ্য বিভাগের নিয়োজিত ব্যক্তিগণ আগের চেয়ে শ্রেয়তরভাবে ক্রয় করতে পারবেন তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। সুতরাং যে প্রত্যাশার কথা বললাম তা নিজেই অনেকটা অসম্ভব বলে প্রমাণের চেষ্টা থেকে বুঝতে পারা যায় কত জটিল সমস্যা তা।

...এই ক্রয়ের সাথে যে খেলোয়াড়রা জড়িত, তারা বাপকে ছেড়েও কথা বলে না এবং মন্ত্রী মহোদয় নিজে যেহেতু ক্রয়ে থাকতে পারবেন না, সুতরাং স্বাস্থ্য বিভাগের নিয়োজিত ব্যক্তিগণ আগের চেয়ে শ্রেয়তরভাবে ক্রয় করতে পারবেন তা বিশ্বাসযোগ্য নয়।

আমি এখন পর্যন্ত শুধু উপজেলা হাসপাতালের কথা বলেছি। এরপর আছে দেশে চৌষট্টি জেলায় সদর হাসপাতাল, তারপর মেডিকেল কলেজ ও বিশেষায়িত হাসপাতাল। সেই জায়গার রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা নিরীক্ষা অনেক জটিল ধরনের টেস্ট দ্বারা আবৃত। তা বাস্তবায়ন করতে গেলে বড় আটঘাট বেঁধে নামতে হবে। সুতরাং প্রথম যে প্রত্যাশা ‘সরকারি হাসপাতালে যে রোগিরা আসবে তাদের রোগ নির্ণয়ের সব পরীক্ষা যেন সরকারি হাসপাতালেই হয়’ তা অর্জন দুরূহ একটি কাজ। এই দুরূহ কাজটি কেন একটি প্রত্যাশা তা বিবেচনার দাবি রাখে।

নিজের পকেট থেকে অর্থ ব্যয়ের বড় একটি অংশ যাচ্ছে বাইরের পরীক্ষা-নিরীক্ষায়। সুতরাং এগুলো সরকারি হাসপাতাল থেকে করা গেলে তা নিম্নমুখী হবে এবং ক্রমান্বয়ে বেশি হারে মানুষ সরকারি হাসপাতালমুখী হবে, বিনা পয়সায় মানসম্মত সেবা পাবে, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা বেশি বাস্তবায়িত হবে, দেশের মানুষের স্বাস্থ্য উন্নতি হবে যা প্রকারান্তে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।

দ্বিতীয় জনপ্রত্যাশা সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকগণ যত ওষুধপত্রের কথা দেবেন বহির্বিভাগ, অন্তঃবিভাগ বা জরুরি বিভাগে তার সমস্তই সরকারি হাসপাতাল থেকে দেওয়ার ব্যবস্থা করা। এটা ততটা কঠিন নয়। সব হাসপাতালে জরিপ করে ওষুধপত্রের চাহিদা নিরূপণ করে তার ক্রয় পরিকল্পনা করতে হবে। অনেক অর্থের প্রয়োজন হবে।

ডা. সামন্ত লাল সেনকে তার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা নিতে হবে, সেইটা তিনি পারবেন বলে অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে মনে হয়। ওষুধপত্র ক্রয় ও তার নির্ভুল হিসাবপত্র একটি কঠিন বিষয়, তার ব্যবস্থা নিতে হবে।

স্বাস্থ্যখাতে জনপ্রত্যাশা আরও আছে, সেইগুলো ক্রমান্বয়ে বলা যাবে। তবে স্বাস্থ্যখাতে পরিবর্তন আনতে হলে সব পর্যায়ের কর্মকর্তা, কর্মচারীদের একসাথে কাজ করতে হবে। সেই সদিচ্ছা কি সবার আছে?

অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ ।। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ; প্রাক্তন পরিচালক, রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর