ছবি : সংগৃহীত

ঢাকা থেকে আকাশপথে মাত্র ২ ঘণ্টা দূরত্বে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার একটি দেশ থাইল্যান্ড—যারা তাদের স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে নাগরিক সম্পৃক্ততার এক অনন্য দৃষ্টান্ত থাই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা।

আশির দশক থেকে থাইল্যান্ডে একটি দর্শন ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে। তা হলো ‘দ্য ট্রায়াঙ্গেল দ্যাট মুভস টু দ্য মাউন্টেন’। অর্থাৎ, একটি ত্রিভুজের তিনটি কোণের সঠিক সমন্বয় হলে পর্বত জয় করা সম্ভব। ত্রিভুজের একটি কোণ যথাক্রমে রাজনৈতিক অঙ্গীকার, নাগরিকের অংশীদারত্ব ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের যথোচিত ব্যবহার।

স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে এই তিনটির সমন্বয় সাধন করে স্বাস্থ্য সূচকের অনেকগুলো দিকে তারা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। মানুষের অংশীদারত্ব অর্থাৎ সমাজের বিভিন্ন অংশের সম্পৃক্ততা যার মধ্যে অন্যতম। সম্প্রতি থাইল্যাল্ডের হেলথ কমিশন এবং থাই হেলথের আয়োজিত ৫ দিনের কর্মশালার মাধ্যমে জানার সুযোগ হয়েছে সেখানকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পরিবর্তনের ইতিহাস।

৬৭ মিলিয়ন জনসংখ্যার দেশ থাইল্যান্ডে প্রায় শতভাগ জনগণ বিভিন্ন সুরক্ষা স্কিমের মাধ্যমে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার আওতায় এসেছে। (সর্বজনীন সুরক্ষা স্কিমের আওতায় ৬৯ শতাংশ, সামাজিক সুরক্ষা স্কিমের আওতায় ১৯ শতাংশ, সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তা চিকিৎসা সুবিধা স্কিম ০৮ শতাংশ, অভিবাসী এবং অভিবাসী শ্রমিক ফান্ড ০৩ শতাংশ, ভাসমান জনগণের সুরক্ষা স্কিম ১ শতাংশ)।

রাজনৈতিক অঙ্গীকার তৈরি ও বাস্তবায়নে যাদের প্রয়োজন, তারা হলেন রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সরকারি আমলা ও টেকনোক্রেট। নাগরিক সম্পৃক্ততা অর্জনে যাদের দরকার, তারা হলেন সুশীল সমাজ, বেসরকারি খাত ও সংবাদমাধ্যম। জ্ঞান-বিজ্ঞান খাতে যাদের জড়িত হওয়া প্রয়োজন, তারা হলেন গবেষক, বিজ্ঞানী, উচ্চশিক্ষিত নাগরিক প্রমুখ। যেকোনো ব্যবস্থাপনায় এই তিনের সমন্বয় হলে সেই ক্ষেত্রে সাফল্য অনেকাংশে নিশ্চিত।

থাইল্যান্ডের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পরিবর্তনে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে কয়েক দশক ধরে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়নে সকলের সমন্বিত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

২০০১ সালে গঠিত হয় হেলথ প্রমোশন ফাউন্ডেশন নামে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। যার প্রধান হলেন সরকার নিজেই। হেলথ প্রমোশন ফাউন্ডেশনের কাজ হলো মূলত জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়ে সচেতন করার জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা। এরপর ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ন্যাশনাল হেলথ সিকিউরিটি অফিস (এনএসএইচও)।

সরকারের পাবলিক হেলথ মন্ত্রণালয়ের অধীনে এই অফিসের আওতায় ‘ন্যাশনাল হেলথ সিকিউরিটি অ্যাক্ট’ তৈরি হয়। এটি সর্বজনীন স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিভিন্ন স্কিমে জনগণকে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করে। অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে ২০০৭ সালে ন্যাশনাল হেলথ কমিশনের অধীনে প্রণীত হয় 'হেলথ অ্যাক্ট'। যা থাইল্যান্ডের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আরও উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে।

এই অ্যাক্টের অধীনে ২০০৮ সাল থেকে সব স্তরের জনগণের সম্পৃক্ততায় প্রতিবছর ডিসেম্বরে একটি কার্যকর পন্থা হিসেবে ‘ন্যাশনাল হেলথ অ্যাসেম্বলি’ আয়োজন করা হচ্ছে। এই অ্যাসেম্বলি’তে প্রান্তিক থেকে জাতীয় পর্যায়ের সব স্তরের জনগণের সম্পৃক্ততা এবং স্বাস্থ্যের অগ্রাধিকারের বিষয়গুলো নির্ধারণ করা হয় এবং সেই অনুযায়ী নীতিনির্ধারণী কর্তৃপক্ষকে প্রভাবিত করা হয়।

এই অ্যাসেম্বলিতে কথিত তিনটি কোণের সমান সংখ্যক প্রতিনিধি (জনগণ, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ ও গবেষক) যোগদান করেন। এখানে যেসব আলোচনা বা সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, তাতে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। হেলথ অ্যাসেম্বলির মাধ্যমে নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে নাগরিক অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত হয়, চর্চা হয় জবাবদিহিতার।

হেলথ কমিশনের মূল দায়িত্ব হলো প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভাকে স্বাস্থ্যনীতি ও কৌশল সম্পর্কে উপদেশ দেওয়া এবং ন্যাশনাল হেলথ অ্যাসেম্বেলি সংক্রান্ত সব কার্যক্রম দেখভাল করা। অ্যাসেম্বেলিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় যেমন—শিক্ষা, শিল্প, পরিবেশ, কৃষি, স্বরাষ্ট্র ইত্যাদির প্রতিনিধিত্ব থাকে। ফলে, আন্তঃসেক্টর সহযোগিতা ও সমন্বয় বাড়াচ্ছে এই ব্যবস্থা।

একটি সুষম টেকসই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়তে থাইল্যান্ডের অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। এখনো বাংলাদেশে স্বাস্থ্য বলতে অধিকাংশ মানুষের ধারণা ডাক্তার, স্বাস্থ্যপরীক্ষা এবং ওষুধ। কিন্তু প্রকৃত স্বাস্থ্য হলো শারীরিক, মানসিক, সামাজিক এবং আত্মিক সুস্থতা। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর সময় এসেছে। চিকিৎসার জন্য জনগণের মাত্রারিক্ত পকেটের টাকা খরচ কমিয়ে আনতে হবে। দক্ষ জনবল, নিয়মিত এবং মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে।

অনিয়ম, দুর্নীতি, কর্মস্থলে অনুপস্থিতি এবং সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা চর্চা করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন সামগ্রিক উদ্যোগ। নাগরিক সম্পৃক্তকরণ (whole of society approach) হতে পারে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পরিবর্তনের প্রধান পদক্ষেপ।

সুশীল সমাজের কার্যকর পদক্ষেপ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পরিবর্তনের দাবিকে জোরালো করতে পারে। সর্বোপরি রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন কোনভাবেই সম্ভব নয়।

আমরা এখনই সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিনির্মাণে পথচলা শুরু করতে পারি। চিকিৎসার পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে প্রাধান্য দিয়ে হেলথ প্রমোশন মূলক কার্যক্রম হাতে নেওয়ার মাধ্যমে। ব্যাপকভিত্তিক স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক কর্মসূচির মাধ্যমে নাগরিক সম্পৃক্ততাকে জোর দিয়ে স্বাস্থ্য অধিকারের জন্য সামাজিক আন্দোলনে হেলথ প্রমোশন যেভাবে ভূমিকা রাখতে পারে—

১. স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পণ্যের ওপর সারচার্জ ও উচ্চহারে করারোপের মাধ্যমে ‘হেলথ প্রমোশন ফাউন্ডেশন’-এর স্থায়িত্বশীল আর্থিক জোগান নিশ্চিত করতে পারে।

২. কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো ‘হেলথ প্রমোশন ফাউন্ডেশন’-এর সাথে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে।

৩. বনাঞ্চল, জলাধার ও উন্মুক্ত গণপরিসর সংরক্ষণ, তামাক, অস্বাস্থ্যকর খাবার ও প্লাস্টিকজাত পণ্য নিয়ন্ত্রণ, নিরাপদ খাদ্য ও সুপেয় পানি নিশ্চিত ইত্যাদি বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়-বিভাগগুলো ‘হেলথ প্রমোশন ফাউন্ডেশনের’ সাথে সমন্বয় করতে পারে।

৪. পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন, মনিটরিং, মূল্যায়নসহ সব প্রক্রিয়ায় সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলো সম্পৃক্ত করা যেতে পারে।

৫. কোভিড-১৯, অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যৎ অতিমারি প্রতিরোধে এখনই প্রস্তুতিসহ অসংক্রামক রোগসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য ঝুঁকি হ্রাসে উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।

৬. মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যাগুলো চিহ্নিত এবং তা নিরসনে পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।

৬. মাতৃমৃত্যু রোধে এবং মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নয়নে অপ্রয়োজনীয় সিজার বন্ধ এবং নরমাল ডেলিভারির জন্য সারাদেশে প্রচার-প্রচারণা চালানো যেতে পারে।

রাজনৈতিক অঙ্গীকার, নাগরিক অংশগ্রহণ এবং জ্ঞানবিজ্ঞানের সম্মিলন হলে যেকোনো সমস্যা সমাধান করা যায়। যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ থাইল্যান্ড। করোনাকালীন মহামারি মোকাবিলায় ‘দ্য ট্রায়াঙ্গেল দ্যাট মুভস টু দ্য মাউন্টেন’-এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। যে কয়টি পার্শ্ববর্তী দেশ আমাদের কাছে মডেল হিসেবে পরিচিত থাইল্যান্ড তাদের একটি। তাদের এই প্রচেষ্টার অনুকরণে জনগণের সম্পৃক্ততার মাধ্যমে বাংলাদেশও এগিয়ে যেতে পারে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের চূড়ান্ত লক্ষ্যে।

রাজেশ অধিকারী ও মাহরুবা খানম ।। উন্নয়নকর্মী