ছবি : সংগৃহীত

বিদ্যায়তনে সন্তান নিরাপদে নেই। বিশেষ করে কন্যা সন্তান। ঢাকার অভিভাবক-শিক্ষার্থী প্রিয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘিরে ক্ষোভ-বিক্ষোভ চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে। নিকট অতীতেও ঐ বিদ্যালয় আলোচনায় এসেছিল একই কাণ্ডে। অর্থাৎ শিক্ষকের দ্বারা শিক্ষার্থীর যৌন নিপীড়ন বিষয়ে।

আরেকটি জনপ্রিয় বিদ্যালয়ও আলোচনায়—সেইখানে শিক্ষক নন, পরিচালনা কমিটির কর্তার সঙ্গে শিক্ষার্থীর সম্পর্ক নিয়ে চলছে হুলুস্থূল কাণ্ড। তা কোনো এক শ্রেণির বিনোদনের খোরাক হয়ে উঠেছে।

এদিকে ঢাকার পার্শ্ববর্তী এক জেলা থেকে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর একযোগে মদ্যপানের খবর এলো। আমরা সাধারণ বিদ্যায়তনের পাশাপাশি মাদ্রাসা থেকেও যৌন নিপীড়নের অভিযোগ ও প্রমাণ, সংবাদে পেয়ে আসছি। এটা নিয়মিত ঘটছে। কোনো কোনোটি জাতীয় সংবাদে পরিণত হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই ধরনের অভিযোগ, ক্ষোভ-বিক্ষোভের খবর অনিয়মিত নয়। তা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডোর, আঙিনা প্রতিবাদ মুখর হয়ে ওঠে প্রায়শ। অতএব একথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই-শিক্ষক দ্বারা যৌন নিপীড়নের ঘটনা সাম্প্রতিক কোনো ‘ভাইরাস’। বা শিক্ষকদের অনৈতিক কোনো বিষয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া হালের কোনো ‘ফ্যাশন’।

বরং আমরা বলতেই পারি, অবশ্যই বলা যায় কিছুদূর অতীত বা তারও অতীতেও বিদ্যালয়ে শিক্ষকরা এই কাণ্ডকীর্তি ঘটাতেন। তবে ঘটনার আওয়াজ বাইরে আসতো কম। শিক্ষার্থী তার শিক্ষা জীবন স্বাভাবিকভাবে সম্পন্ন করার স্বার্থে গোপন করে যেত।

অভিভাবকদের পর্যন্ত বিষয়টি গড়ালে, তারা পরিবারের সম্মান ও সন্তানের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কথা ভেবে মনের গোপন ফাইলে লাল ফিতা বন্দি করে ফেলতেন ঘটনাগুলো। কোনো কোনো ঘটনা বিদ্যায়তনের উদ্যোগেও চাপা পড়ে যেত। কিন্তু এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে কোনো ঘটনাই শাক দিয়ে ঢেকে রাখার সুযোগ নেই।

সাধারণ বিদ্যায়তনের পাশাপাশি মাদ্রাসা থেকেও যৌন নিপীড়নের অভিযোগ ও প্রমাণ, সংবাদে পেয়ে আসছি। এটা নিয়মিত ঘটছে। কোনো কোনোটি জাতীয় সংবাদে পরিণত হয়েছে।

সন্তান যখন বিদ্যায়তনে তখন তার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হচ্ছি আমরা। কিন্তু সে যখন কাজের জায়গায় গেল? সেইখানে যাওয়ার পথে এবং কাজের জায়গাটিতে কি নিরাপদ থাকছে? সব পেশার ক্ষেত্রেই সংশয় রয়ে যায়। কন্যা বা মেয়েদের কাজ ছেড়ে দেওয়া, কর্মক্ষেত্র বদলের পেছনের কারণগুলোর পেছনে থাকে সহকর্মী এবং ঊর্ধ্বতনের দিক থেকে যৌন হয়রানি।

মেধাবী ও চৌকস অনেক মেয়েই পরিবার ও সমাজের কথা ভেবে আলগোছে কাজ থেকে সরে যান। কোনো প্রতিবাদ না করেই। তবে ধীরে হলেও প্রতিবাদ বাড়ছে। কণ্ঠ ছাড়ছে মেয়েরা। এটা ভালোদিক। তবে খারাপ দিক হচ্ছে এই ধরনের নিপীড়ন শুধু শ্রেণিকক্ষ ও অফিসকক্ষতেই সীমিত থাকছে না। চলে এসেছে যোগাযোগমাধ্যমেও।

শিক্ষকদের নিয়ে কথা বা সমালোচনা বেশি হওয়ার কারণ, তারা সমাজের নৈতিকতার প্রতীক এবং সন্তানকে নৈতিকতার শিক্ষা দিতেই বিদ্যায়তনে পাঠানো হয়; তা হোক প্রাথমিক বা বিশ্ববিদ্যালয়। দেখা যাচ্ছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভালো ফলাফলের প্রলোভন দেখিয়ে বা ফাঁদে ফেলেও শিক্ষার্থীদের যৌন নিপীড়ন করা হচ্ছে। এখন কথা হলো শিক্ষকরা কি শুধু এই প্রকারের নিপীড়নের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েই নৈতিকতা হারাচ্ছেন?

দীর্ঘ সময় ধরেই বলে আসছি আমাদের শিক্ষকরা হারিয়ে যাচ্ছেন। অবহেলায় হারাচ্ছেন স্বীকার করেই বলি, একটা বড় অংশ হারাচ্ছেন লোভে...

সবার জানা, প্রশ্নপত্র ফাঁস, নকল গবেষণাপত্র জমা দেওয়া, নকল সনদ ও অন্যান্য কেলেঙ্কারির সঙ্গেও তারা যুক্ত হয়ে পড়ছেন। কোচিং বাণিজ্য তো ডালভাত মাত্র। সুতরাং সমাজ যখন শিক্ষকদের অন্যান্য অনৈতিককাণ্ডের বৈধতা দেয় নিজেদের স্বার্থে, তখন শিক্ষকরা নিজের পেশাগত পরিচয়ের উচ্চতায় অবস্থান করতে পারেন না। হন নিম্নগামী।

শিক্ষকদের সাম্প্রতিক কাণ্ডগুলো সেই নিচে নেমে যাওয়ারই প্রকাশ মাত্র। কিন্তু আমরা তো শিক্ষক চাই। দীর্ঘ সময় ধরেই বলে আসছি আমাদের শিক্ষকরা হারিয়ে যাচ্ছেন। অবহেলায় হারাচ্ছেন স্বীকার করেই বলি, একটা বড় অংশ হারাচ্ছেন লোভে। সমাজের অন্য পেশার মানুষেরা যেমন লোভে-ভোগে ডুব দিচ্ছেন, তারাও এখন সেইদিকে।

লোভের ইশারা সমাজে সবসময়ই ছিল। একটা সময় পর্যন্ত শিক্ষকরা ভাবতেন, এখনো শিক্ষকদের একটি অংশ ভাবেন—তার কাজ সম্প্রদান করা। জ্ঞান সম্প্রদান। শিষ্যের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাতেই তারা সিক্ত হতে ভালোবাসেন।

ভোগের কোনো আয়োজনে নয়। কিন্তু এই শিক্ষকদের আমরা সম্মান দিতে পারিনি। কারণ ভোগে আসক্ত শিক্ষকদের আমরা রকমারি রাজনীতির খেলনা বানিয়ে রেখেছি। সেই খেলনারা নৈতিকতা হারালেও রক্ষা পেয়ে যান নানা উপায়ে। তাদের ঝনঝনানিতে এখনো যারা ‘শিক্ষক’ তারা বঞ্চিত ও অনেকটা অসম্মানিতও।

আমরা বিদ্যায়তন অনৈতিক শিক্ষকমুক্ত করতে হলে প্রকৃত শিক্ষকদের দিকে সম্মানের আলো ফেলতে হবে এবং শিক্ষক নিয়োগকে রাখতে হবে রাজনীতি ও স্বজনপ্রীতি মুক্ত।

তুষার আবদুল্লাহ ।। গণমাধ্যমকর্মী