ছবি : সংগৃহীত

কোনো একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তারল্য সংকট তখনই দেখা দেয় যখন প্রতিষ্ঠানটি তার আর্থিক বাধ্যবাধকতা পূরণের জন্য নগদ সম্পদের ঘাটতি অনুভব করে। বিভিন্ন কারণে তারল্য সংকট হতে পারে যার মধ্যে ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা, আকস্মিকভাবে বিনিয়োগকারীদের আস্থার অভাব বা অপ্রত্যাশিত অর্থনৈতিক সংকট অন্যতম।

তারল্য সংকটের কারণে ব্যাংকিং খাত খুব ভঙ্গুর অবস্থায় চলে যেতে পারে যার ফলে স্বল্পমেয়াদে উৎপাদন ও মানুষের কল্যাণের উপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।

ব্যাংকের অন্যতম প্রধান কাজ যারা ঋণ নিতে চায় এবং যারা ঋণ দিতে চায় তাদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করা। ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের কাছ থেকে যে আমানত সংগ্রহ করে তার একটা অংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বাধ্যতামূলকভাবে জমা রাখতে হয় আমানত সুরক্ষার জন্য।

তবে বেশকিছু ব্যাংক যাদের মধ্যে বেশিরভাগই শরিয়াভিত্তিক ব্যাংক তারা চাহিদামতো কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আমানতের অর্থ জমা রাখতে পারছে না। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর আমানত সুরক্ষার অর্থে ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় নানা ধরনের অনিয়মের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে গ্রাহকেরা ব্যাংকের উপর থেকে আস্থা হারিয়েছে। ফলে ব্যাংকের আমানত সংগ্রহের হার কমেছে। কিন্তু ঋণ প্রদান যদি সেই হারে না কমে তাহলে ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী আমানতের অর্থ জমা রাখতে পারবে না। ফলে দিন দিন ঘাটতি বাড়তে থাকবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ৩১ জানুয়ারি ২০২৪ এর হিসাব থেকে দেখা যায় ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, আইসিবি ইসলামি ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংকের চলতি হিসাবে বড় ধরনের ঘাটতি আছে।

বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট বাড়ছে। বেশিরভাগ ব্যাংক তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা বাংলাদেশ ব্যাংক এবং কল মানি মার্কেটের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক হচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ধার নেওয়ার অন্যতম উৎস। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২২-২৩ অর্থবছরে রেকর্ড ১৩.০৮ লাখ কোটি টাকার তারল্য সহায়তা দিয়েছে ব্যাংকগুলোকে যা কি না ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় প্রায় সাড়ে সাত গুণের মতো বেশি। এই ধরনের তারল্য সহায়তার মূল কারণই হচ্ছে দেশের আর্থিক বাজারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা।

বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট বাড়ছে। বেশিরভাগ ব্যাংক তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা বাংলাদেশ ব্যাংক এবং কল মানি মার্কেটের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

কল মানি বলতে একটি নূন্যতম স্বল্পমেয়াদি ঋণকে বোঝায় যা চাহিদা অনুযায়ী পরিশোধ করতে হয় এবং এটি ব্যবহৃত হয় আন্তব্যাংক লেনদেনের জন্য।

সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি কল মানি রেট ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাধারণত কল মানি রেট তখনই বৃদ্ধি পায় যখন ব্যাংকগুলোয় তারল্য সংকট দেখা দেয় এবং তাদের বাজার থেকে অর্থ ধার করার প্রয়োজন হয়।

...ব্যাংকগুলোর তদারকি বাড়াতে হবে, বাড়াতে হবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা। এছাড়া ঋণ আদায়ের পরিমাণও বাড়াতে হবে এবং আদায়কৃত ঋণের টাকা দিয়ে নতুন করে উৎপাদনশীল খাতে ঋণ প্রদান করতে হবে।

ডলার সংকটের চাপ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর উপর থেকে কমানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদার ঘাটতির সমস্যার কিছুটা সমাধান হলেও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর স্থানীয় মুদ্রার (টাকা) ঘাটতি অর্থাৎ তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কল মানি রেটের পরিবর্তনের ধারা নিচের ছকে দেওয়া হলো—

সময়কাল সমাপ্তি কল মানি মার্কেট রেটের ভরযুক্ত গড়
ধার নেওয়া ধার দেওয়া
জানুয়ারি ২০২৪ ৯.৩৮ ৯.৩৮
জানুয়ারি ২০২৩ ৬.৬৬ ৬.৬৬
জানুয়ারি ২০২২ ২.৪৩ ২.৪৩

তথ্যসূত্র : বাংলাদেশ ব্যাংক

বাংলাদেশে বর্তমানে তারল্য সংকটের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা বাজারের সংকট, রেকর্ড ঋণ খেলাপি, ঋণ আদায়ে ধীর গতি, কিছু শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকের প্রতি আস্থার অভাব, আমানতের অভাব, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে পারিবারিক সঞ্চয় কমা। তারল্য সংকট বাড়ার পেছনে আরেকটি কারণ হতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসি রেট বাড়ানো।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক পলিসি রেট বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে যা কি না তারল্য সংকটকে আরও তীব্র করে তুলেছে। এছাড়া দীর্ঘ সময় ধরে ব্যাংকগুলো টাকার বিনিময়ে আন্তব্যাংক প্ল্যাটফর্ম ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার কিনছে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি পূরণের জন্য। এছাড়া ট্রেজারি বন্ড ও বিলে সরকারের আকর্ষণীয় সুদ হার দেওয়া ও তারল্য সংকটের আরেকটি কারণ হতে পারে।

এমতাবস্থায়, যে সব ব্যাংক প্রতিনিয়ত ধার নিচ্ছে তাদের নিরুৎসাহিত করতে হবে। ব্যাংকিং খাতে বিশেষ করে বিনিময় হার ও মুদ্রানীতিতে সংস্কার আনতে হবে। ঋণ দেওয়ার সময় ব্যাংকগুলোর সচেতনতার সঙ্গে দেখতে হবে তারা উৎপাদনশীল খাতে ঋণ দিচ্ছে কি না, অর্থাৎ ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে উৎপাদনশীল খাতগুলো বেছে নিতে হবে।

একই সঙ্গে ব্যাংকগুলোর তদারকি বাড়াতে হবে, বাড়াতে হবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা। এছাড়া ঋণ আদায়ের পরিমাণও বাড়াতে হবে এবং আদায়কৃত ঋণের টাকা দিয়ে নতুন করে উৎপাদনশীল খাতে ঋণ প্রদান করতে হবে। তাহলেই তারল্য সংকট ব্যাংকগুলো অতিক্রম করতে পারবে।

সোমা ভট্টাচার্য ।। সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়