ছবি : সংগৃহীত

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মানসিক আর শারীরিকভাবে আহত পরিবারগুলো নিজ তাগিদে সমাজে লড়াই করে বেঁচে আছেন। তাদের কেউ কখনো কোনো ধরনের পোস্ট ট্রমা কাউন্সিলিং করেননি। কখনো কেউ তাদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজও করেনি।

সবার সামনে তাদের যতটা স্বাভাবিক দেখা যায়, তা নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ করে পথ চলতে চলতে সবার মতো হওয়ার চেষ্টা মাত্র। ট্রমা ধামাচাপা দিয়ে জীবনের প্রয়োজনে বাঁচার যুদ্ধে নেমে যেতে হয়েছিল এই মানুষগুলোর।

আঘাতপ্রাপ্ত পরিবারে কখনো কখনো দুর্ঘটনার ঘনঘটা নেমে আসে। ভয়াবহ মানসিক বিষণ্নতা থেকে স্বেচ্ছামৃত্যুর মতো অঘটনও ঘটে। এই ধরনের কিছু ঘটনার পর সমাজের অনেকেই জ্ঞানগর্ভ ভরা কথা বলতে দেরি করেন না। তবে কাজে লাগবে এমন কোনো উদ্যোগে এরা এগিয়েও আসেন না।

সময়ের স্রোতে অথবা আকস্মিক ঘটনায় এক এক করে একাত্তরের স্বজনের মৃত্যু, অপমৃত্যু বা আত্মহত্যার বেদনা শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধে আঘাতপ্রাপ্ত পরিবারকেই সইতে হয়। সত্যি বলতে এসব পরিবারের বেঁচে থাকতে হয় বিধায় তারা বেঁচে থাকেন।

মুক্তিযুদ্ধের ফলশ্রুতিতে এই জনপদে মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবার, অত্যাচারিত পরিবার, পালিয়ে বেড়ানো পরিবার বা উদ্বাস্তু পরিবারগুলো যে ট্রমায় আক্রান্ত ছিল, তা কখনোই ব্যক্তিগতভাবে, সামাজিকভাবে, রাষ্ট্রীয়ভাবে ভাবা হয়নি।

যে সাধারণ মানুষ জীবনে কাউকে হয়তো একটা চড়ও মারেননি, তিনিও দেশের প্রয়োজনে যুদ্ধে গেলেন, সম্মুখ যুদ্ধে নিজেকে বাঁচাতে ও দেশকে স্বাধীন করতে অপরকে গুলি করলেন টানা কয়েক মাস...

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নয় মাসে যে ট্রমা নিয়ে এসেছিল বা এমন কিছু হয়, হতে পারে, সেইটাই অনুধাবন করার মতো সময় রাষ্ট্র বা অন্য কোনো সংগঠনের কখনো হয়নি, রাষ্ট্র বা অন্য কোনো সংগঠন সেই বিষয়ে মাথাও ঘামায়নি। ট্রমা বিষয়ক ব্যাপারটি আসলেই কি কারও বোধগম্যই নয়! এক গভীর ভয়াবহ সংকট তৈরি হয়ে গেছে।

যুদ্ধ শেষে জীবিত মুক্তিযোদ্ধারা বাড়ি ফিরেছেন, আহতরা চিকিৎসা নিয়েছেন, শহীদ পরিবারের বাকি লোকজন জীবন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, বীরাঙ্গনারা পরিচয় লুকিয়েছেন, নিখোঁজ পরিবারের প্রিয়জনেরা ফিরে আসবার অপেক্ষায় দিন শুরু করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনমানুষের যুদ্ধ। কৃষিখেত-খামারে চাষাবাদ করা কৃষক লাঙল, কাঁচি ফেলে বন্দুক হাতে সম্মুখ যুদ্ধে চলে গেছেন। ছাত্ররা বই রেখে ট্রেনিং নিতে ছুটেছেন। মায়েরা ঘরে ঘরে দুর্গ তুলেছেন।

যে সাধারণ মানুষ জীবনে কাউকে হয়তো একটা চড়ও মারেননি, তিনিও দেশের প্রয়োজনে যুদ্ধে গেলেন, সম্মুখ যুদ্ধে নিজেকে বাঁচাতে ও দেশকে স্বাধীন করতে অপরকে গুলি করলেন টানা কয়েক মাস, সেই মানুষটা তো হঠাৎ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে না। তাকে খাপ খাওয়াতে মানসিক বিশেষজ্ঞের সাহায্য প্রয়োজন ছিল।

শহীদ পরিবারগুলোর মূল উপার্জনক্ষম মানুষটাই চিরতরে হারিয়ে গিয়েছিল। স্বজন হারানোর ব্যথা, সংসারের খরচ, আশ্রয়, বিপদ-আপদে পাশে দাঁড়াবার মানুষ, সবকিছু হারিয়ে সমাজের বিড়ম্বনায় স্বাভাবিক থাকা যেকোনো পরিবারের পক্ষে ছিল দুষ্কর। কেউ খেয়াল করেননি, এমনকি মুক্তিযুদ্ধকে বহন করা মানুষগুলোও এদিকে নজর দেননি। বুঝতেই চেষ্টা করেননি যে, এই আঘাত মুছে যাওয়ার নয়।

স্বাধীনতার এত বছরে বাংলাদেশে এখনো শহীদ, মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা, শহীদ বুদ্ধিজীবীর পূর্ণাঙ্গ তালিকা সম্পন্ন হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় প্রতিবছর ২৬ মার্চ এলেই তালিকাগুলো চূড়ান্ত করার ঘোষণা দেয়। কিন্তু এত বছরেও তা সমাপ্ত করার কোনো ইচ্ছে দেখা গেল না।

...এই বিশেষ মানুষদের রাষ্ট্র আর অন্য জনসাধারণের মতোই দেখিয়ে এসেছে। এদের চিনিয়ে না দেওয়ার ব্যর্থতা রাষ্ট্র ব্যতীত আর কারও নয়।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা বা আর্কাইভ করার মতো প্রয়াসও আর তেমন নেই বললেই চলে। এই বিশেষ কাজটি সময় মতো কেন করা হয়নি, তার জবাবদিহি করার কেউ নেই। অথচ ২০০৯ সাল থেকে দেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে।

মুক্তিযুদ্ধে মানসিক এবং শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত মানুষগুলো বহন করে চলেছে সেই ভয়াবহ সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত। অথচ তালিকাগুলো তৈরি না হওয়ায়, এই মানুষগুলোর সঠিক মূল্যায়ন বা স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।

সমাজ বা দেশের মানুষ তাই তাদের বীরত্বের পরিচয় জানে না। তারা কী পরিমাণ আত্মত্যাগ করেছে বা তাদের অবদান অথবা জীবন যুদ্ধের কথা জানেন না। কারণ এই বিশেষ মানুষদের রাষ্ট্র আর অন্য জনসাধারণের মতোই দেখিয়ে এসেছে। এদের চিনিয়ে না দেওয়ার ব্যর্থতা রাষ্ট্র ব্যতীত আর কারও নয়।

এই পরিবার বা মানুষগুলো আজকের প্রজন্মের কাছে অপমানিত, উপেক্ষিত বা নিগৃহীত হলে তার দায় রাষ্ট্রের নিতে হবে। স্বাধীন ভূখণ্ড, আত্মপরিচয়, অস্তিত্ব, পতাকা, নাগরিকত্ব সবই তাদের এবং তাদের পূর্বসূরির হাত ধরে এসেছে।

তারা ভাতা, পদক বা অন্য কোনো ভোগ বা সুবিধার জন্য তাকিয়ে থাকে না। তারা রাষ্ট্র থেকে স্বীকৃতি চায়, যা থেকে স্বাভাবিকভাবেই আজকের বাংলাদেশের মানুষ তাদের চিনে নেবে, সম্মান জানাবে সর্বোপরি সবসময়ের জন্য মানসিকভাবে পাশে থাকবার সাহায্যে হাত এগিয়ে দেবে।  

শাওন মাহমুদ ।। শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা