ছবি : সংগৃহীত

দখল, অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ৮০ বছরে ঢাকা শহর প্রায় ১২০ কি.মি. (প্রায় ৩০৭ হেক্টর) দৈর্ঘ্যের খাল হারিয়েছে। ঢাকা মহানগর বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপ (২০১৬-২০৩৫)-এর জরিপ প্রতিবেদন অনুসারে, ঢাকায় বর্তমান লেক বা খালের পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৮০ একর এবং বিদ্যমান জলাভূমির পরিমাণ প্রায় ১১ হাজার ২০০ একর।

২০০৯ পরবর্তী সময় থেকে এখন পর্যন্ত ঢাকা শহরে প্রায় ২ হাজার ১০০ একর জলাভূমি ধ্বংস হয়েছে। ঢাকা শহরের খালগুলোর অচলায়তনের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে মূলত পাঁচটি কারণ চিহ্নিত করা যায়—

প্রথমত, ঢাকার খালগুলো মূলত বিশদ আন্তঃসম্পর্কিত জলপ্রবাহের (ব্লু নেটওয়ার্ক) অংশ যার ভিত্তিতে খালগুলো বিবেচনা না করলে তাদের উদ্ধার কার্যক্রমের ব্যর্থতা অবশ্যম্ভাবী। ফলে সিএস ম্যাপ অনুযায়ী এই খালগুলোর সীমানা নির্ধারণ পূর্বক অবৈধ দখল উচ্ছেদ, প্রয়োজনীয় পরিষ্কার কার্যক্রম গ্রহণ, দূষণ রোধ এবং সর্বোপরি বর্ষাকালে এই মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে খালগুলোর আন্তঃসংযোগ উদ্ঘাটন করা একান্ত প্রয়োজন যা পরিকল্পিত কর্মসূচি ও বিনিয়োগ ব্যতীত সম্ভব নয়।

দ্বিতীয়ত, খালগুলো এবং তাদের জলধারণ অববাহিকা (Catchment Area), নগর রূপতত্ত্বের (Urban Morphology) এবং নগর ভূতাত্ত্বিক উন্নয়নের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই ভূমি ব্যবহার ও যোগাযোগ ব্যবস্থার সাপেক্ষে এর পরিকল্পিত পুনরুদ্ধার এবং প্রয়োজনবোধে জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে তার জলধারণের উপযোগিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কিন্তু অবারিতভাবে নগরের উপরিতল, গণপরিসরগুলো, সড়ক এবং বিবিধ নির্মাণের মাধ্যমে ঢাকাকে ঢেকে ফেলার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বর্তমানে এই রান অফ ওয়াটারের পরিমাণ বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে।

এই কারণে খালগুলো উদ্ধারের পাশাপাশি বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের সক্ষমতা যথাযথকরণের উদ্যোগ সমান্তরালভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তাই অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বিবেচনায় নিয়ে সেই সাপেক্ষেই নগরীর পানি নিষ্কাশন কার্যক্রম নিশ্চিতে খালগুলোর প্রশস্ততা (অধিগ্রহণ করে হলেও) ও সম্ভাব্য জলধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে অথবা ওয়াসার মাধ্যমে পানি নিষ্কাশন নেটওয়ার্ক (Drainage Network) পরিপূর্ণরূপে বাস্তবায়নে যথাযথ বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

অবারিতভাবে নগরের উপরিতল, গণপরিসরগুলো, সড়ক এবং বিবিধ নির্মাণের মাধ্যমে ঢাকাকে ঢেকে ফেলার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বর্তমানে এই রান অফ ওয়াটারের পরিমাণ বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে।

তৃতীয়ত, এক্ষেত্রে অবশ্যই একটি সমন্বিত ও সময় নির্ভর বাস্তবায়নযোগ্য কর্মধারা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। কারণ ওয়াসার পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নেটওয়ার্ক অসম্পূর্ণ (মাত্র ৩০ শতাংশ এলাকা) থাকার কারণে পয়ঃবর্জ্য মিশ্রিত পানির নেটওয়ার্ক একীভূতকরণের বিষয়টিও বিবেচনায় আনতে হবে।

খালগুলোয় এই তরল দূষণ অবমুক্তকরণের কাজটি ‘দায়বদ্ধ সংস্থার দায়’ হিসেবে নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে সমান্তরাল প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমেই কেবল নিশ্চিত করা সম্ভব। একইসঙ্গে খাল সংলগ্ন সড়ক ও জনপথ এবং সিটি কর্পোরেশনের সড়ক ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ সঞ্চালন খুঁটি ও ব্যবস্থাসহ নানাবিধ সরকারি স্থাপনা ও প্রতিবন্ধকতাগুলোর নিরসন করতে হবে।

চতুর্থত, খালগুলো কঠিন ও তরল বর্জ্যের ভাগাড় হিসেবে রূপান্তরের প্রচেষ্টাকে সম্পূর্ণরূপে প্রতিহত করতে হবে। বাড়ির পার্শ্ববর্তী পয়ঃবর্জ্য যুক্ত ময়লার ভাগাড়ের স্বরূপ খালের রক্ষণাবেক্ষণের দায় কোনোভাবেই সাধারণ জনগণের ওপর বর্তায় না।

সিটি কর্পোরেশনকে অবশ্যই খালে কঠিন বর্জ্য নিক্ষেপের বিষয়টি গুরত্ব সহকারে অনুধাবন করে এই বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নগরীর খাল এবং জলাশয়গুলোর দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনকে হস্তান্তর করে দিয়ে এবং প্রতিটি বাড়িতে ‘পয়ঃআধার বা সেপ্টিক ট্যাংক’ স্থাপনের দোহাই দেওয়া এবং একটি বিচ্ছিন্ন অবাস্তবভাবে পয়ঃশোধন ব্যবস্থা নির্মাণের মাধ্যমে খালে এই ধরনের বর্জ্য নিক্ষেপ করে খাল দূষণ এবং ধ্বংসের দায় আরেকটি সংস্থার উপর চাপিয়ে ওয়াসা’র (পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ) দায়মুক্তির কোনো সুযোগ এখানে নেই।

সিটি কর্পোরেশনকে অবশ্যই খালে কঠিন বর্জ্য নিক্ষেপের বিষয়টি গুরত্ব সহকারে অনুধাবন করে এই বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

মনে রাখা দরকার যে, ব্যবহার্য পানির পাশাপাশি পয়ঃনিষ্কাশনের জন্যও ওয়াসা নগরবাসীর কাছ থেকে বিল গ্রহণ করে। মোটাদাগে ৬/৭টি পানি নিষ্কাশন মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন এবং বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণের পরেও ওয়াসা পয়ঃনিষ্কাশন বিষয়ক সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি।

শুধুমাত্র দাশেরকান্দি ছাড়া আরেকটিও (উত্তরা, ডেমরা, মিরপুর, রায়েরবাজার) পয়ঃশোধনাগার নির্মাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। ওয়াসাকে অবশ্যই অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে এইসব পয়ঃবর্জ্য পরিশোনাগারে পরিশোধন নিশ্চিত করেই নদীতে নিষ্কাশিত করতে হবে।

পঞ্চমত, বিভিন্ন পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা, সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর নগরী নিশ্চিতে দায়বদ্ধ কিন্তু সেই দায়িত্ব এড়িয়ে আজ সেই জনগণকেই দোষী সাব্যস্ত করার মধ্য দিয়ে ‘জনসম্পৃক্ততার’ বুলি আওড়ানো হচ্ছে। জনসম্পৃক্ততা নিশ্চিতে তিনটি বিষয় অত্যন্ত জরুরি—

ক) সময় নির্ভর একটি পরিকল্পনার উপস্থাপন প্রয়োজন, যাতে করে জনগণ পুরো বিষয়টির সাথে অর্থবহভাবে অন্তঃকরণ করতে পারে এবং নির্দিষ্ট সময় পরপর কী কী পরিষেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত হবে তার একটি সুনির্দিষ্ট ধারণা পেতে পারে;

খ) এই কার্যক্রমে ‘সুবিধাভোগী’ হিসেবে জনগণের কী দায়িত্ব রয়েছে সেই বিষয়ে সচেতন করার কাজে বিনিয়োগ করতে হবে। স্থানীয় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকেও সংযুক্ত করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ অন্যান্য মিডিয়া, সাইনবোর্ড, লিফলেট প্রদানসহ যেকোনো গণসংযোগমূলক কার্যক্রম, কাউন্সিলরদের দ্বারা স্থানীয় প্রচারণাসহ জনগণকে সচেতন করার সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।

এবং গ) সামাজিক বনায়নের মতো এই খালগুলোও সামাজিক দায়বদ্ধতার আদলে জন-অভিভাবকত্ব বা পাবলিক স্টুয়ার্ডশিপ ধারণায় বিভিন্ন অংশে জনগণের দায়িত্ব নিশ্চিত করা যেতে পারে। গুলশান এলাকায় প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন সড়কের রক্ষণাবেক্ষণ এবং দৃষ্টি নান্দনিকতা নিশ্চিত করা গিয়েছিল। অতএব, একটি জনসম্পৃক্ত অভিভাবকত্ব তৈরি এবং বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা যেতে পারে।

সর্বশেষ, এই সামগ্রিক কাজটি নির্মোহভাবে রাজনৈতিক কঠোর স্বদিচ্ছা ব্যতীত বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এই ক্ষেত্রে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের তথা কাউন্সিলর এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মাধ্যমে সুনির্ধারিত দায়িত্ব প্রদান/অর্পণের মধ্য দিয়ে পরিকল্পনামাফিক কর্মসূচি প্রত্যাশিত।

ইকবাল হাবিব ।। স্থপতি ও নগরবিদ; সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)