প্রযুক্তি, বিশেষ করে ডিজিটাল প্রযুক্তি, একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের কেনাকাটা থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ বিল দেওয়া, প্রিয়জনের সঙ্গে কথা বলা থেকে সভা-সেমিনার, এমনকি আমাদের ব্যস্ততম জীবন থেকে যেটুকু অবসর বের করে নিয়ে আসা যায়, অনেকক্ষেত্রে সেটুকুও দখল করে নিয়েছে প্রযুক্তি।

প্রাপ্তবয়স্করা তো আছেই, তার সঙ্গে সঙ্গে শিশুরাও বাদ নেই। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিশুদের হাতে পৌঁছে গেছে ট্যাব কিংবা মোবাইল ফোন। আমাদের দেশও এর ব্যতিক্রম না। 

একেবারেই এই প্রযুক্তি ছেড়ে থাকা বা বাদ দেওয়াটা বলতে গেলে অসম্ভব। কারণ, আজকের পৃথিবীটাই প্রযুক্তিকেন্দ্রিক; প্রযুক্তিকে মূল বিন্দুতে রেখেই আবর্তিত হচ্ছে আমাদের সমাজ, সংসার, বিশ্ব। শিশুরা এই পৃথিবীর বাইরের কেউ নয়। অতএব, তাদেরও প্রযুক্তিতে সংশ্লিষ্ট হওয়ার মধ্যে আতঙ্কিত না হয়ে, সেটি কী করে সুনিয়ন্ত্রিত এবং সুপরিকল্পিত করা যায়, সেদিকে নজর দেওয়া উচিৎ।

এই প্রযুক্তির অবির্ভাবে শিশুরা কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে, সেটি নিয়ে একটু বলা যাক। বয়সভেদে এই সমস্যাগুলোর তীব্রতা বা প্রভাব ভিন্ন ভিন্ন হবে।

আগে যে শিশু লেখাপড়ার ফাঁকে, বিকেল বেলায় খানিকটা সময় মুখিয়ে থাকতো বন্ধুদের সঙ্গে পাড়ার মাঠে খেলতে যাওয়ার জন্য, নানারকম কাহিনী আর গল্পে কাটতো তার ছেলেবেলা, সে শিশুর সব খেলাধুলা, গল্প-কাহিনী আজ দখল করে নিয়েছে ছোট্ট একটি ডিজিটাল স্ক্রিন।

প্রথমেই আসি ডিজিটাল প্রযুক্তি যেভাবে কাজ করে, সেরকম একটি টেকনিক্যাল দিক নিয়ে। কম্পিউটার বা সংশ্লিষ্ট ডিভাইস একই সাথে অনেকগুলো কাজ করে, যেটি মাল্টি টাস্কিং নামে পরিচিত। ফলে, একই সাথে স্ক্রিনে অনেকগুলো প্রোগ্রামের আইকন, ইন্টারফেস বা উপস্থিতি দৃশ্যমান থাকে।

অন্যভাবে, বলতে গেলে, কম্পিউটার একই সাথে বিভিন্ন উৎস থেকে আসা ডেটা বা তথ্য প্রসেস করে থাকে। প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে মাল্টি টাস্কিংয়ের ব্যাপারটি সহজবোধ্য হলেও, শিশুদের প্রথমেই এই পদ্ধতির সাথে পরিচিত হওয়া বা এই পদ্ধতিতে চিন্তা করা উচিত কিনা, সেটি নিয়ে বিতর্ক আছে। বিশেষ করে শিশুদের ব্রেইন ডেভেলপিং পর্যায়ে থাকে এবং বলা হয়ে থাকে যে, মাল্টি টাস্কিং নয় বরং যুগ যুগ ধরে শিশুরা একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে তাদের চিন্তা কেন্দ্রীভূত রাখার মাধ্যমে শিখে আসছে।

অন্যদিকে, কম্পিউটার বা প্রোগ্রামের ধাপগুলো আগে থেকেই নির্দিষ্ট করে রাখা থাকে, যেভাবে কোড করে রাখা হয়েছে। প্রোগ্রামের তার বাইরে যাওয়ার সুযোগ কম। এই নির্দিষ্টকরণের মাধ্যমে, মানুষ এবং কম্পিউটারের চিন্তার এই মৌলিক পার্থক্যের কারণেও, শিশুদের সৃষ্টিশীলতা বাধাগ্রস্ত হতে পারে বলেও অনেকে আশঙ্কা করে থাকেন।

প্রযুক্তির সাথে সময় কাটানোর সময় খুব বেশি শারীরিক কসরতও করতে হয় না। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, অতিমাত্রায় প্রযুক্তি ব্যবহারে খাওয়া-দাওয়া, ঘুম এবং স্বাভাবিক দৈনন্দিন কার্যক্রমেও ব্যাঘাত ঘটছে। শুধু তাই নয়, ভিডিও গেইমের আদলে, শিশুদের মধ্যে বিশেষ রকমের আক্রমণাত্মক মনোভাব পরিলক্ষিত হয়, যেখানে এই বয়সে শিশুদের কাছে প্রত্যাশা থাকে সহানুভূতিশীল হওয়ার, সহমর্মী হওয়ার বোধগুলো ধীরে ধীরে জেগে উঠার।

অপরদিকে, ভার্চুয়াল জগতের সাথে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায়, বাস্তব জীবনে পরিবার-পরিজনের, প্রতিবেশী, বন্ধুর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, ভার্চুয়াল জীবনের বন্ধু-বান্ধব, যাদেরকে হয়তো বাস্তবে কখনো দেখার সুযোগই হয়নি। সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পরিবর্তে মুখ্য হয়ে উঠছে তথাকথিত অনলাইন অ্যাকটিভিটিজ।

পর্যাপ্ত প্রযুক্তি জ্ঞান না থাকার কারণে এই শিশুরাই আবার পরিণত হচ্ছে সাইবার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে। ডিজিটাল জগতের অপরিচিত মানুষ বা সাইবার ক্রিমিনাল খুব সহজেই শিশুদের কাছ থেকে সুকৌশলে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হাতিয়ে নিতে পারে, পরবর্তীতে যেগুলো দিয়ে করতে পারে মারাত্মক সাইবার অপরাধ।

তবে ডিজিটাল প্রযুক্তি যে, শিশুদের জন্য শুধু ক্ষতির কারণ হয়েই এসেছে তা কিন্তু নয়। অন্য আর সব প্রযুক্তির মতোই, সমস্যাটা প্রযুক্তির নয়, সমস্যাটা হলো প্রযুক্তি কীভাবে ব্যবহার করা হলো সেখানে। প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শিশুদের জন্য শিক্ষণীয় অনেক কিছুই করা সম্ভব।

বিভিন্ন ধরনের কঠিন ধারণা যেগুলো মুখে ব্যাখ্যা করা কঠিন, প্রযুক্তির সহায়তায় ভিডিও বা অ্যানিমেশনের মাধ্যমে সেগুলো সহজেই শিশুদের নিকট উপস্থাপন করা যায়। সতর্কতার সাথে তৈরি করা শিশুদের জন্য বেশকিছু গেম, অ্যাপ বা প্রোগ্রাম আছে, যেগুলোর মাধ্যমে শিশুদের সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বাড়ানোও সম্ভব। তাছাড়া, বিভিন্ন শিশুতোষ গল্প, ছড়া, কাহিনি ইত্যাদির ডিজিটাল রূপান্তরের মাধ্যমে সেগুলোকে আরও আকর্ষণীয় ও মনোমুগ্ধকর করে উপস্থাপন করা সম্ভব।

অতএব, বলা চলে, প্রযুক্তি নিয়ে শিশুদের মধ্যে ভীতি সঞ্চার না করে, সুনিয়ন্ত্রিতভাবে প্রযুক্তিকে শিশুদের নিকট তুলে ধরাটাই লক্ষ্য হওয়া উচিত। শিশুদের প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে বিশ্বব্যাপী বেশকিছু পরামর্শ বিবেচনা করা হয়ে থাকে। যেমন কোনো অবস্থাতেই দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করতে না দেওয়া।

খাবার গ্রহণের সময়, ঘুম পাড়ানোর সময়, পাবলিক কোনো জায়গায় শিশুদের শান্ত করানোর কৌশল হিসেবে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার না করা। দুই থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে সাধারণত দৈনিক এক ঘণ্টা এবং পাঁচ থেকে আট বছর বয়সীদের জন্য দৈনিক দুই ঘণ্টা ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। সাথে বলা হয়ে থাকে, শিশু ডিজিটাল মাধ্যমে কি দেখছে, কেন দেখছে সে দিকে অভিভাবকের মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।

সর্বোপরি, পারিবারিকভাবে সময় কাটানো, পরিবারের সদস্য, বিশেষ করে শিশুদের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনা এবং তাদের কথাগুলো অভিভাবকদের সাথে শেয়ার করার ব্যাপারে তাদেরকে উৎসাহিত করার প্রতিও যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।

পরিশেষে, এইটুকু না বললেই নয় যে, শিশু তার পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছ থেকে দেখে শিখবে। পরিবারের প্রাপ্তবয়স্করা যদি ডিজিটাল ডিভাইস নিয়ে ব্যস্ত থাকে, শিশুর সাথে সময় না কাটিয়ে, শিশুর সাথে খেলাধুলা না করে, শিশুর সাথে গল্প না করে, ডিজিটাল মাধ্যমেই বেশি সময় কাটাতে পছন্দ করে, তাহলে ডিজিটাল ডিভাইস ছেড়ে আসার কোনো যৌক্তিকতা বা অনুপ্রেরণা খুঁজে পাবে না শিশুমন।

ড. বি এম মইনুল হোসেন ।। সহযোগী অধ্যাপক, তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
mainul@iit.du.ac.bd