ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হারের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। প্রতিবছর দেশে প্রায় ৬৫ হাজার মানুষ এসব রোগে মারা যায়। ফুসফুসের রোগের পেছনে নানান কারণ রয়েছে, এর মধ্যে অন্যতম হলো ধূমপান ও বায়ু দূষণ।

নিয়মিত ধূমপানের ফলে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফুসফুসের ভেতরে ছোট ছোট চুলের মতো সিলিয়া থাকে, যার কাজ হলো ধুলাবালি, জীবাণু পরিষ্কার করে ফুসফুসকে সুস্থ রাখা। ধূমপানের ফলে এগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে, যার কারণে যেকোনো ধরনের জীবাণু ফুসফুসকে আক্রান্ত করতে পারে। ফলে নিউমোনিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জা, যক্ষ্মা এমনকি করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বাড়ে।

সিগারেটের ধোঁয়ায় ক্যানসার সৃষ্টিকারী মিউটাজেন থাকে। এর ফলে মুখ, শ্বাসনালী এবং ফুসফুসে ক্যানসার সৃষ্টি হয়। তাছাড়া ধূমপানের ফলে শ্বাসনালী সরু হয়ে যায় এবং ফুসফুস স্ফীত হয়ে পড়ে, এটাকে এমফাইসিমা বলে। এর ফলে রোগীর শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। ধূমপানের ফলে শ্বাসতন্ত্রের রোগ ছাড়াও ক্যানসার ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে।

ধূমপানের ফলে যে শুধু তারা নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তা নয়। বরং তাদের সংস্পর্শে থাকা অধূমপায়ীও পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়ে ফুসফুসের নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

বর্তমান করোনা মহামারিতেও ধূমপায়ীদের করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। কারণ, ধূমপায়ীরা অপেক্ষাকৃত বেশি নাক-মুখ স্পর্শ করেন। আবার সংক্রমিত হওয়ার পর ধূমপায়ী রোগীদের জটিলতার আশঙ্কাও অধূমপায়ীদের তুলনায় তিনগুণ বেশি থাকে। করোনায় এই রোগীদের মৃত্যুহারও বেশি। তাছাড়া ধূমপানের ফলে যে শুধু তারা নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তা নয়। বরং তাদের সংস্পর্শে থাকা অধূমপায়ীও পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়ে ফুসফুসের নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

শ্বাসতন্ত্রের জটিল রোগ থেকে নিরাপদ থাকতে ধূমপান থেকে বিরত থাকার কোনো বিকল্প নেই। এজন্য ব্যক্তিগত ইচ্ছা যেমন প্রয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধও ধূমপানের হার কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। স্বেচ্ছায় ধূমপান ছাড়লে সে নিজে ও তার পরিবার উপকৃত হবে। অপরদিকে সরকার ধূমপানের হার কমানোর লক্ষ্যে কড়াকড়ি আরোপ করলে তা সকলের জন্য মঙ্গলজনক হবে।

বিশ্বজুড়ে ধূমপান কমানোর বেশকিছু স্বীকৃত পদ্ধতি রয়েছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো, করারোপের মাধ্যমে তামাক পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করা। সাধারণ দৃষ্টিতে, দাম বাড়লে পণ্যের চাহিদা কমবেই, তামাক পণ্যও এর বাইরে নয়। বর্তমান সরকার প্রত্যেক বছর বাজেটেই বিড়ি-সিগারেটসহ সব ধরনের তামাক পণ্যের দাম অল্প পরিমাণে হলেও বৃদ্ধি করে, যা আশাব্যঞ্জক। তবে, এই অল্প পরিমাণে দাম বৃদ্ধির ফলে ধূমপায়ীর সংখ্যা আশানুরূপ হারে কমছে না।

তামাকের ভয়াবহতা উপলব্ধি করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাউথ এশিয়ান স্পিকার্স সামিটের সমাপনী অনুষ্ঠানে আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য বিদ্যমান কর কাঠামো সংস্কার এবং তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি)’র সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার নির্দেশও দিয়েছিলেন তিনি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালের রিপোর্ট অনুসারে, দক্ষিণ এশিয়ায় মিয়ানমারের পরেই বাংলাদেশে সবচেয়ে কম দামে সিগারেট পাওয়া যায়।

সম্প্রতি তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু তামাক কর কাঠামো সংস্কারে এখনো কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি।

বাস্তবতা হলো, ত্রুটিপূর্ণ কর কাঠামো বিশেষ করে সিগারেটে ৪টি মূল্যস্তর থাকায় বাংলাদেশে তামাক পণ্য অত্যন্ত সহজলভ্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালের রিপোর্ট অনুসারে, দক্ষিণ এশিয়ায় মিয়ানমারের পরেই বাংলাদেশে সবচেয়ে কম দামে সিগারেট পাওয়া যায়। আর বিড়ি ও জর্দা-গুলের মতো ধোঁয়াবিহীন তামাক পণ্যগুলো আরও সস্তা।

বর্তমানে দেশে একজন সিগারেটসেবীকে গড়ে প্রতি মাসে ১০৭৭ টাকা ব্যয় করতে হয়। আর বিড়ির জন্য খরচ হয় মাত্র ৩৪১ টাকা। তামাক পণ্যের এই সহজলভ্যতা তামাকের ব্যবহার কমানোর পেছনে অন্যতম বড় প্রতিবন্ধকতা।

গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) ২০১৭ অনুসারে বাংলাদেশে ১৫ বছরের ঊর্ধ্বে জনগোষ্ঠীর ৩৫.৩ শতাংশ, অর্থাৎ পৌনে চার কোটি মানুষ তামাক সেবন করে।

বিপুল এই জনগোষ্ঠীকে তামাক ছাড়তে উৎসাহিত করার জন্য দাম বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। কারণ, নানা দেশের প্রেক্ষাপটে দেখা গেছে, তামাকের দাম বেশি হলে তরুণ জনগোষ্ঠী তামাক ব্যবহার শুরু করতে নিরুৎসাহিত হয় এবং তামাক আসক্তরাও বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠী তামাক ছাড়তে উৎসাহিত হয়।

বাংলাদেশেও নিশ্চয়ই এই পদ্ধতি কার্যকর হবে। সেজন্য দাম বৃদ্ধির পরিমাণ মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। যৌক্তিক হারে করারোপের মাধ্যমে তামাক পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করা হলে একদিকে যেমন বর্তমান ব্যবহারকারীরা তামাক ছাড়বে, অন্যদিকে কিশোর-তরুণরা এই মরণ নেশা থেকে রক্ষা পাবে।

অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান ।। সাবেক পরিচালক, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল