বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির তাণ্ডব প্রায় দেড় বছর ধরে চলমান। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো প্রতিষেধক এখনো পর্যন্ত উদ্ভাবিত না হলেও এই রোগ প্রতিরোধে কার্যকর টিকা আমরা হাতে পেয়েছি। ইতোমধ্যে ফাইজার-বায়োটেক, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা, মডার্ন এবং সিনোফার্মের উদ্ভাবিত টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন পেয়েছে।

মহামারির বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে টিকাই এখন কার্যকর প্রধান হাতিয়ার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, দেশের ৭০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় নিয়ে আসতে পারলে হার্ড ইমিউনিটি তৈরির মাধ্যমে পুরো জনগোষ্ঠীর সম্পূর্ণ সুরক্ষা সম্ভব।

বিশ্বের উন্নত দেশগুলো তাই ইতোমধ্যেই টিকা সংগ্রহের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ, আর চেষ্টা করে যাচ্ছে আমাদের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলোও। ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় ১২ কোটি মানুষকে টিকার আওতায় আনা রীতিমতো এক কষ্টসাধ্য কাজ। এই লক্ষ্যে বারো কোটি মানুষের জন্য ২৪ কোটি ডোজ টিকা সংগ্রহের পরিকল্পনা নিয়ে সরকার কাজ শুরু করে। উপরন্তু, এই ১২ কোটি মানুষকে অল্প সময়ের মধ্যে টিকার আওতায় আনতে না পারলে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ থেকে যায়। অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে পদক্ষেপ নিয়ে, তা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হলে দরকার একটি সমন্বিত টিকা ব্যবস্থাপনা নীতি।
টিকা ব্যবস্থাপনায় প্রথম ও প্রধান ধাপ হলো টিকা সংগ্রহ, যার জন্য প্রয়োজন আন্তর্জাতিক যোগাযোগ এবং কার্যকর টিকা কূটনীতি। এই বিবেচনায়, শুরুতে বাংলাদেশ সরকার টিকা রাজনীতিতে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে টিকা সংগ্রহে সাফল্য বয়ে আনে।

বেক্সিমকো এবং সরকার যৌথভাবে ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউটের সঙ্গে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তিন কোটি ডোজ টিকা ক্রয়ের চুক্তি সম্পাদন করে। চুক্তি মোতাবেক দুই ধাপে দেশে আসে ৭০ লক্ষ ডোজ টিকা। এছাড়াও ভারত থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া যায় ৩২ লক্ষ ডোজ টিকা।

টিকা ব্যবস্থাপনায় প্রথম ও প্রধান ধাপ হলো টিকা সংগ্রহ, যার জন্য প্রয়োজন আন্তর্জাতিক যোগাযোগ এবং কার্যকর টিকা কূটনীতি। এই বিবেচনায়, শুরুতে বাংলাদেশ সরকার টিকা রাজনীতিতে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে টিকা সংগ্রহে সাফল্য বয়ে আনে।

প্রতি মাসে সেরাম ইন্সটিটিউট থেকে ৫০ লক্ষ টিকা প্রাপ্তি নিশ্চিত ভেবে দেশে টিকা কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু পরবর্তীতে সেরাম থেকে প্রতিশ্রুত টিকা না পাওয়ার ফলে এই কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। এছাড়াও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমন্বিত গ্রুপ কোভ্যাক্স থেকে বিনামূল্যে পাওয়া যাবে ৬ কোটি ডোজ টিকা। কোভ্যাক্স থেকে ক্রয় করা যাবে আরও প্রায় তিন কোটি ডোজ।

চীন এবং রাশিয়া থেকে ক্রয় করা হবে তিন কোটি ডোজ। বিভিন্ন দেশ থেকে উপহার হিসেবে প্রাপ্ত টিকার সংখ্যা বাদ দিয়েও আরও প্রায় ছয় কোটি ডোজ টিকা সংগ্রহের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।

টিকা ব্যবস্থাপনার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো টিকা প্রয়োগের সুষ্ঠু অবকাঠামো তৈরি। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি করে ইতোমধ্যেই সারা দেশে সফলভাবে এই কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে যা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। প্রতিদিন প্রায় দুই লক্ষাধিক ডোজ টিকা প্রদানের সক্ষমতা আমাদের তৈরি হয়েছে। তবে পর্যাপ্ত টিকা প্রাপ্তি সাপেক্ষে এই সংখ্যা প্রতিদিন তিন লাখে উন্নীত করতে পারলে তা হবে আরও ফলপ্রসূ।

টিকা কার্যক্রম সফল করার জন্য তৃতীয় করণীয় বিষয় হল জনগণকে টিকা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা এবং নিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজ করা। সামাজিক সচেতনতা তৈরির পাশাপাশি শুধুমাত্র জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদর্শন করে নিকটস্থ কেন্দ্রে গিয়ে টিকা নেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারলে তা হবে অত্যন্ত কার্যকর।

টিকা ব্যবস্থাপনার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো টিকা প্রয়োগের সুষ্ঠু অবকাঠামো তৈরি। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি করে ইতোমধ্যেই সারা দেশে সফলভাবে এই কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে যা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক।

বিশেষজ্ঞদের পরামর্শক্রমে টিকা প্রদানের একটি অগ্রাধিকার তালিকা প্রণয়ন করতে হবে এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এখানে উল্লেখ্য, কোভ্যাক্সের আওতায় প্রাপ্ত ফাইজারের টিকাটি যেহেতু ১২-১৮ বছর বয়সীদের মধ্যে প্রয়োগ করা যায় সেহেতু এই বয়সীদের ফাইজারের টিকা প্রয়োগ করা যেতে পারে।

পরিশেষে, আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা করতে চাই। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকার কারণে ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত  হচ্ছে। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা ঝুলে আছে দীর্ঘদিন। ফলে শিক্ষার্থীরা অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। একই অবস্থা সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও।

অনলাইনের মাধ্যমে ক্লাসগুলো সম্পন্ন করা গেলেও পরীক্ষা নিয়ে দেখা দিয়েছে জটিলতা। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এসএসসি, এইচএসসি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টিকা প্রদান নিশ্চিত করে তাদের পরীক্ষাগুলো স্ব-শরীরে নিয়ে নেওয়া যেতে পারে। আর যদি সেটি সম্ভব না হয় তাহলে অনলাইনে এই পরীক্ষাগুলো নেওয়ার বিধান চালু করা যেতে পারে। শিক্ষা ক্ষেত্রে যে স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছে তা অনেকটাই এভাবে সমাধান করা সম্ভব।

অধ্যাপক ড. ফিরোজ আহমেদ ।। চেয়ারম্যান, ফার্মেসি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়